রওশন বলে, রাতে তুমি দেখতে অন্য রকম।
শওকত সাথে সাথে বলে, হ্যাঁ, চাঁদের মতোন। একটু থেমে বলে, এবার তুমি বলো রওশন রাতে দেখতে কেমন, শোনার জন্যে কিন্তু ইনি পাগল হয়ে আছেন।
রওশন রেগে ওঠে, না, আমি শুনতে চাই না। রওশন একটি কাগজে কী যেনো লিখে আমার হাতে দেয়, তাতে লেখা আছে। আসলে আমি শুনতে চাই আমি রাতে দেখতে কেমন?
আমি কাগজটির উল্টো পিঠে লিখি। চাঁদের আলোর মতো।
রওশন কাগজটি পড়ে হাতে ভাঁজ করে রেখে বলে, আমার কবরে একথাটি লেখা থাকবে।
শওকত বলে, এতো শিগগিরই কবরের কথা!
আমরা সবাই চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ; যেনো কোনো প্রিয়জনের জন্যে নীরবতা পালন করি। রওশন নীরবতা থেকে উদ্ধার করে আমাদের।
রওশন বলে, তোমার চাদরটি দেখতে খুব সুন্দর, আমার গায়ে দিতে খুব ইচ্ছে করছে।
গায়ে দিয়ে দেখো না, আমি বলি, তবে চাদরটা খুব খারাপ; এবং পেছন থেকে .চাদরটি তুলে রওশনের হাতে দিই; রওশন চাঁদরের নিচে আমার হাত ধরে থাকে।
রওশন চাদরটি গায়ে জড়ায়, চাঁদরে গাল ঘষে হাত ঘষে, আর বলে, তোমার চাঁদরে মিষ্টি গন্ধ।
শওকত বলে, তিব্বত পাউডারের গন্ধ, মাহবুব তিব্বত পাউডার মাখে।
ওটা আসলে চাঁদের গন্ধ, আমি হাসতে থাকি, মাঝেমাঝে চাদর গায়ে দিয়ে আমি চাদে বেড়াতে যাই।
আমাকে নাও না কেনো? রওশন মধুর হাসিতে টেবিল ভরিয়ে দেয়।
ডানা আছে তোমার, রওশন? আমি জিজ্ঞেস করি, বলি, চাদে যেতে লাখ লাখ ডানা দরকার।
তোমার তো আছে, রওশন বলে, আমাকে তো অন্তত কয়েকটি ধার দিতে পারো। বলো দেবে? আমার চোখের হাজার হাজার মাইল ভেতরে তাকায় রওশন, তাতে আমার চোখ স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে।
আমি শুধু টেবিলের নিচে রওশনের হাত আরো কোমল আরো উষ্ণ আরো উষ্ণ আরো কোমলভাবে মুঠোর ভেতরে জড়িয়ে ধরি।
রওশনের হঠাৎ মনে হয় আমার শীত লাগছে, আমি অবাক হই; আমার শীত। লাগছিলো না, আমি তো শুকনো খড়ের মতো জ্বলছিলাম, আমার শীত লাগতে পারে না; তবে আমার শীত লাগছে কি লাগছে না এটা আমার পক্ষে বোঝ হয়তো সম্ভব নয়, বুঝতে পারে শুধু রওশন; তাই রওশন যখন বলে, তোমার শীত লাগছে, তখন সত্যিই আমার শীত লাগতে থাকে। আমি রওশনের দিকে তাকাই, রওশন বুঝতে পারে আমার শীত লাগছে।
রওশন আবার বলে, তোমার শীত লাগছে; আমার চাদরটি তুমি গায়ে দাও।
আমি একটু বিব্রত বোধ করি, শওকত অবাক হয়ে তাকায় আমাদের দিকে। রওশন। চেয়ার ছেড়ে উঠে তার চাদরটি আমার গায়ে জড়িয়ে দেয়, জড়ানোর সময় আমার গ্রীবা নরমভাবে ছোয়, তাতে আমার শরীর থেকে সব শীত দূর হয়ে যায়। এ-গ্রীবায় আর কোনো দিন শীত লাগবে না। চাদর জড়িয়ে দিয়ে রওশন চেয়ারে গিয়ে বসে টেবিলের। ওপর চিবুক ঠেকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাতে আমাকে কেমন দেখায় রওশন তা চোখ ভরে দেখছে।
শওকত বলে, এবার তুমি বলো রওশনের চাঁদরের কেমন গন্ধ।
আমি রওশনের দিকে তাকাই।
রওশন বলে, শওকত যখন জানতেই চায়, বলোই না, নইলে ও কষ্ট পাবে।
আমি বলি, রওশনের চাঁদরে চাঁদের আলোর গন্ধ।
রওশন টেবিলের নিচে তার মুঠোতে আমার মুঠো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। চাঁদের আলোর গন্ধে আমার বুক ভরে যায়, আমার মাংসের বাগানে কোটি কোটি রজনীগন্ধা। ফুটতে থাকে।
শওকত হারিকেন নিয়ে খেলতে শুরু করেছে, আলো বাড়াচ্ছে আবার কমাচ্ছে; তাতে রওশনকে আরো সুন্দর লাগছে, মনে হচ্ছে সব আলো নিভে গেলে আরো উজ্জ্বল। হয়ে উঠবে রওশন। শওকত আলো বাড়াচ্ছে, কমাচ্ছে, খুব মজা পাচ্ছে; আলো কমাতে গিয়ে হঠাৎ হারিকেন নিভে যায়।
যাও, এবার নিজে হারিকেন ধরিয়ে আনো, রওশন বলে। শওকত দুজনের দিকে তাকিয়ে হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে যায়।
শওকত বেরিয়ে যেতেই আস্তে রওশন বলে, এই, তুমি এদিকে আসো তো একটু।
আমি দাঁড়াই, চেয়ার পেছনের দিকে ঠেলে পা বাড়াই, কিন্তু পা বাড়াতে পারি না; রওশন না এক স্বপ্ন যেনো দু-হাতে সারা শরীরে জড়িয়ে ধরে আমাকে।
আমাকেও ধরো, রওশন আস্তে বলে; আমি জড়িয়ে ধরি রওশনকে। স্বপ্নকে এই প্রথম আমি বাহুর ভেতরে পাই।
রওশন আমার গালে গাল ঘষে, একরাশ কোমল পালকের মতো চুল আমার মুখের ওপর ছড়িয়ে দেয়, এবং তুমি কাল দুপুরেই আসবে বলেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার চেয়ারে গিয়ে বসে।
আমি, খসে-পড়া এক পালক, চেয়ারে বসি আবার, আমরা কোনো কথা বলতে পারি না; যে-অসম্ভব কোমলতার ভেতর কিছুক্ষণ আগে আমার শরীরটি গিয়ে পড়েছিলো, আমি সেখান থেকে উঠে আসতে পারি না, আমি আরো কোমলতার মধ্যে ডুবে যেতে থাকি। এত দিন ধরে যে-পৃথিবীতে বেঁচে আছি আমি, সেটিকে স্পর্শ। করতে গিয়ে আমার কঠিনতার বোধই হয়েছে সাধারণত; কোমলতা যা বোধ করেছি তা আমাকে জলের, মেঘের, তুলোর, ফুলের বোধের বেশি কোনো বোধ দেয় নি; রওশনের হাত ছোঁয়ার পর আমার ত্বক বুঝেছে আরো এক কোমলতা আছে পৃথিবীতে, কিন্তু আজ আমি পরম কোমলতাকে পাই বাহুর ভেতরে বুকের ভেতরে। আমার বুক গলে যায়, আমি এখন আর রওশনকে জড়িয়ে ধরে নেই, কিন্তু আমি আমার পাজরে তাল তাল কোমলতা বোধ করছি, রওশন যে আর আর আর আর আমার আমার আমার আমার আমার কথা লিখেছিলো, সে-দুটির কোমলতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে, পৃথিবীর সব গন্ধরাজ সব গোলাপ সব পালক আমার বুকে জড়ো হলেও এ-কোমলতাকে পাবো না আমি। এ-কোমলতা হচ্ছে রওশন। শওকত হারিকেন নিয়ে ফিরে আসে, আলোতে আমি রওশনকে চিনতে পারি না, রওশনও হয়তো চিনতে পারে না আমাকে।