আমাদের পুবের পুকুরটি বেশ বড় ছিলো, সেটি ঘিরে ছিলো অনেকগুলো ঘাট। আমাদের ঘাটটির থেকে দক্ষিণে, পুকুরটি যেখানে পুব দিকে বাঁক নিয়েছে, সেখানে। ছিলো মোল্লাবাড়ির ঘাট; ওই ঘাটে একদিন খুব ভোরবেলা, আমার যখন আট বছর বয়স হবে, আমি ওই বাড়ির একটি নতুন বউকে গোসল করতে দেখি। সে-দিন খুব। ভভারে ঘুম ভেঙে গেলে আমি আমাদের দোতলা ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুকুরের দিকে তাকাই, শুপুরি আর নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখি নতুন বউটি গোসল করছে। সেটা শীতকাল ছিলো, জলের ওপর ধুয়োর মতো কুয়াশা উড়ছিলো, শিশিরে শুপুরি আর নারকেলগাছগুলো ভিজে গিয়েছিলো, সে-কনকনে ঠাণ্ডায় এতো ভোরে বউটি কেনো গোসল করে ভেবে আমি অবাক হই। বউটি গোসল করে শাড়ি বদলায়, পরার শাড়িটি পানিতে ছুঁড়ে মেরে দু-তিনবার ধোয়, তারপর শাড়িটি দু-হাতে চেপে একটি বলের। মতো বানিয়ে সিঁড়ির মাথায় রেখে দিয়ে বাড়ির দিকে চলে যায়। সে কেনো অতো ভোরে গোসল করলো? মাকে কি জিজ্ঞেস করবো ঘুম থেকে উঠলে? কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই জিজ্ঞেস করে কোনো সত্য জানতে আমার ইচ্ছে করে না, সত্য আমি নিজে। জানতে চাই, নিজে বের করতে চাই। বিকেলবেলা আমি একবার মোল্লাবাড়ি যাই; মাঠে যাবো বলে আমি বেরিয়েছিলাম, কিন্তু মোল্লাবাড়ি গিয়ে উঠি। বউটিকে আমি আগেও দেখেছি, একদিন সে আমাদের বাড়ি এসেওছিলো; আমাকে দেখেই সে ঘর থেকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। তার জড়িয়ে ধরা আমার ভালো লাগে, কিন্তু আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। বউটি আমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে, এবং আমার আরো ভালো লাগতে থাকে।
আপনি এতো ভোরে গোসল করেন কেনো?
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি।
বউটি অবাক হয়, বিব্রত হয়, এবং হেসে ফেলে।
আমি ভোরে গোসল করি তুমি জানো কীভাবে? বউটি নিচু গলায় বলে।
ভোরে ঘুম ভাঙলে আমি বারান্দায় দাঁড়াই, তখন দেখি আপনি গোসল করছেন, আমি বলি।
নতুন বউরা ভোরেই গোসল করে, বউটি হেসে হেসে আমার গাল টিপতে টিপতে বলে, তোমার বউও ভোরে গোসল করবে।
আমি তার বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড় দিই।
নতুন বউরা কেনো ভোরবেলা গোসল করে?–প্রশ্নটি ঘুরতে থাকে আমার মাথার মধ্যে। নতুন বউরা সুন্দর থাকতে চায়, ভোরবেলা গোসল করলে বউরা সুন্দর হয়ে ওঠে; নতুন বউদের চামড়া খুব ঝলমল করে, ভোরবেলা গোসল করে বলেই হয়তো, এমন একটা উত্তর আমার ভেতরে তৈরি হয়ে যায়। পরের দিন ভোরেও তাকে আবার আমি গোসল করতে দেখি, কুয়াশার ভেতরে সে গায়ে পানি ঢেলে গোসল করছে, তার শরীর থেকে ধুয়োর মতো কুয়াশা উড়ছে, সে বদনা দিয়ে মাথায় পানি ঢালছে, বাঁ হাত দিয়ে বারবার বুক ঘষছে, তার দু-পায়ের মাঝখানে তলপেটের দিকে পানি ঢালছে, ঘষছে, কুয়াশা উড়ছে; আমার শরীর কেনো যেনো হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠে; আমি ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ি। পরে আমি বুঝতে পারি বউটির সাথে তার পুরুষটির একটি সাঁকো তৈরি হয়েছে। বিয়ে একটা ব্রিজ, এমন একটা ধারণা আমার তখনি হতে থাকে; বউটির বাড়ি শিমুলিয়া আর লোকটির বাড়ি দক্ষিণের মোল্লাবাড়ি, তাদের কখনো দেখা হয় নি, কিন্তু একটা সাঁকো তৈরি হয়ে গেছে তাদের মধ্যে, তাই তারা এখন এক ঘরে। ঘুমোয়, আর বউটি প্রত্যেক ভোরে উঠে কুয়াশার মধ্যে গোসল করে। আমি বুঝে উঠতে থাকি মানুষ দু-প্রকার, পুরুষ আর মেয়েমানুষ, আর তাদের মধ্যে একটা রহস্যজনক সাঁকো তৈরি হয়। তখন থেকে পৃথিবী আমার চোখে দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়, মেয়ে আর পুরুষমানুষ, এবং আমি তাদের মধ্যের ব্রিজগুলো খুঁজতে থাকি, দেখতে থাকি, মাঝেমাঝে আগুনের মতো জ্বলে উঠি আর কখনো বরফ হয়ে যাই।
পাশের বাড়ির মোহাম্মদ আবদুর রহমানদের ঘর ছিলো একটি। মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বাবা ছিলো মৌলভি, সিলেটে চাকুরি করতো; বাড়ি আসতো আট-দশ মাস। পরপর; রহমানকে সে বাবা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলে ডাকতো, আমরা রহমানকে রহমান বললে আমাদের ডেকে বুঝিয়ে দিতো যে সে রহমান নয়, সে মোহাম্মদ আবদুর রহমান, তাকে ওই নামেই ডাকা উচিত, নইলে কবিরা গুনাহ হবে; সে-মোহাম্মদ। আবদুর রহমানের বাবা বাড়ি এলে একটা ঘটনা ঘটতো। মোহাম্মদ আবদুর রহমানের মাও মৌলভি ছিলো মনে হয়; মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বাবা বাড়ি এলেই সে লম্বা। করে ঘোমটা দিতো, সন্ধ্যার আগেই সুন্দর করে চুল আঁচড়াতো, চোখে সুরমা পরতো, আর সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর মোহাম্মদ আবদুর রহমান, তার একটি ছোটো ভাই ও একটি বড়ো বোন আমাদের পশ্চিমের ঘরে ঘুমোনোর জন্যে কাঁথাবালিশ নিয়ে উঠতো। বোনটি আমার থেকে বড়ো ছিলো, বালিশ নিয়ে এসে আমাদের ঘরে ঘুমোতে সে লজ্জা পেতো। মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বাবা বাড়ি এলেই মোহাম্মদ আবদুর রহমানের মা। ভোরবেলা গোসল করতো, উঠোনের তারে শাড়ি ঝুলিয়ে দিতো; মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বোনটি মায়ের ঝোলানো শাড়ি দেখে লজ্জা পেতো। কিছু দিন পর মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বোনটির বিয়ে হয়, সেও ভোরবেলা গোসল করতে শুরু করে। ভোরবেলা গোসল করে তার কালো রঙ ঝলমল করে ওঠে। মোহাম্মদ আবদুর। রহমানের মা আর বোন কিছু দিন ধরে একই সাথে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে থাকে, ঘাটে গিয়ে একসাথে গোসল করতে থাকে; মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বোনের গালে অনেকগুলো দাঁতের দাগ ফুটে থাকতে দেখি আমি, তবে তার মায়ের গালে কোনো দাগ দেখতে পাই না।