আমি যাবো না, রওশন বলে; আমার দিকে কোমলভাবে তাকায়।
কেনো যাবে না? আমি জিজ্ঞেস করি।
আমার ইচ্ছে, রওশন বলে, কান্দিপাড়া কী আছে দেখার?
নদী আছে খাল আছে ইলিশ আছে, শওকত হাসে, কিন্তু মাহবুব নেই।
ঠিক আছে, রওশন বলে, তাহলে মনে করো সেজন্যেই আমি যাবো না।
রওশন চিবুকে আঙুল রেখে চুপ করে থাকে, যেনো সে আর কথা বলবে না; তার। চুপ করে থাকার ভঙ্গি দেখে তাকে আমার জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হয়, তার চিবুকে আমার নাক ঘষার ইচ্ছে হয়। রওশন ব্যথা পাচ্ছে, কিন্তু আমার বুক সুখে ভরে ওঠে; রওশন। বেড়াতে যাবে না, আমার জন্যেই যাবে না, কান্দিপাড়া দেখার কিছু নেই আমি সেখানে। নেই বলে। রওশন যদি কথাটি খুব চুপেচুপে আমাকে বলতো, তাহলেই আমার রক্ত। মধু হয়ে উঠতো, বাঁশি বাজতে থাকতো আমার সমস্ত নদীর পারে আর কাশবনে, কিন্তু রওশন চুপেচুপে বলে নি, শওকতকে শুনিয়ে বলেছে, সারা পৃথিবীকে রওশন জানিয়ে দিয়েছে সে কান্দিপাড়া বেড়াতে যাবে না, কেননা সেখানে আমি নেই। আমার ইচ্ছে হচ্ছে বাইরে গিয়ে আমি বন্ধুদের ডেকে জানিয়ে দিই যে রওশন কান্দিপাড়া বেড়াতে যাবে না, কেননা সেখানে দেখার কিছু নেই, কেননা সেখানে আমি নেই। চঞ্চলভাবে ঘর থেকে আমার ছুটে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, কিন্তু আমি বেরোতে পারি না।
শওকত বেরিয়ে যেতেই রওশন আমার হাত ধরে। আমিও ধরার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ছিলাম, ভেবেছিলাম আজ রওশনের হাত আমিই প্রথম ধরবো, অভিমানে রওশন হয়তো আমার হাত ধরবে না। বিষণ্ণ চাঁদের মতো তার মুখ আমার দিকে তুলে ধরে রওশন। বলে, আজ তোমাকে একটি শাস্তি পেতে হবে।
খুব কঠিন শাস্তি? আমি জানতে চাই।
তোমার জন্যে কঠিনই, রওশন বলে, খুব কঠিন। রওশন আমার দুটি হাতই তুলে নিয়েছে তার হাতে।–আমি তৈরি, আমি হাসি আর বলি, দাও, শাস্তি দাও, খুব কঠিন শাস্তি দিয়ো, তারপর ক্ষমা কোরো।
সন্ধ্যা হলেই, রওশন বলে, তুমি আজ বাড়ি যেতে পারবে না, আমার সাথে সন্ধ্যার পরও অনেকক্ষণ তুমি থাকবে। সন্ধ্যার পরও আমি তোমাকে দেখতে চাই, তোমার মুখ দেখতে চাই, তোমার কথা শুনতে চাই। রওশন একটু থেমে বলে, আর সন্ধ্যার পরও তুমি আমাকে দেখো, আমি চাই।
রওশন আমার দিকে তাকিয়ে ধ্রুবতারার মতো জ্বলতে থাকে, তার চোখ থেকে। মুখ থেকে আলো না শিশির না কী যে ঝরতে থাকে, আমি তা বুঝতে পারি না; আমার শুধু ইচ্ছে করে রওশনের চোখ আর মুখ থেকে যা ঝরে পড়ছে, যার নাম আমি কোনো দিন জানবো না, তার সবটুকু আমার হৃদয়ে চিরকালের জন্যে ধরে রাখতে। রওশনের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি, আমার রক্তমাংস সবুজ কোমল ঘাস হয়ে মাঠের পর মাঠে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
শওকত ফিরে এলেই রওশন বলে, জানো, একটি সুসংবাদ আছে, সন্ধ্যার পরও মাহবুব আমাদের সাথে থাকবে। রওশন এমনভাবে বলে যেনো শওকত এ-সংবাদ শোনার জন্যে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে আছে।
শওকত হেসে বলে, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহবুব সারারাত থাকবে না।
তুমি বেশি দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো, রওশন রেগে ওঠে, তার রাগ থেকে বোঝা যায় সত্যিই কষ্ট পাবে একজন; তখন কী সুন্দর যে লাগে রওশনকে।
সন্ধ্যার পর ঘরটিতে আমরা তিনজন
সন্ধ্যার পর ঘরটিতে আমরা তিনজন। চারপাশে অন্ধকার, ঘরের চালের ওপর। নারকেলপাতার শব্দ হচ্ছে মাঝেমাঝে, শিরশিরে বাতাস ঢুকছে কাঁঠালপাতার ভেতর দিয়ে। রওশনের আব্বা একবার উঁকি দেন; আমাকে দেখে তিনি খুশি হন, জানালাগুলো লাগাতে লাগাতে বলেন, ওদের একটু দেখিয়ে দিয়ে তো। বাইরে শীতের বাতাস, কিন্তু ভেতরে আমরা, রওশন আর আমি, উষ্ণ হয়ে আছি। আমার ডান পায়ের পাতার ওপর রওশনের বা পায়ের পাতা, রওশনের ডান পায়ের পাতার ওপর আমার বা পায়ের পাতা। মনে হচ্ছে কনকনে শীতের মধ্যে আমরা কোনো চুল্লির পাশে বসে আছি। আমরা একে অন্যের জন্যে শীতের আগুন, একজনের আগুন পোহাচ্ছি আরেকজন, আমাদের কোনো শীত লাগছে না। রওশন টেবিলের নিচ দিয়ে তার ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছে, উষ্ণ কোমল দুধের পেয়ালার মতো রওশনের হাত, আমাদের পৃথিবীতে কোনো শীত নেই।
শওকত ডান দিকের চেয়ারে চাদর গায়ে দিয়ে একটু একটু কাঁপছে; আর জানতে চাইছে, তোমাদের শীত লাগে না?
কেনো, এটা শীতকাল নাকি? আমি হাসতে হাসতে বলি।
না, এটা গরমকাল, শওকত বলে, মাহবুবের আর রওশনের জন্যে।
রওশন নিজের চাদরটা শওকতের গায়ে চাপিয়ে দিয়ে বলে, আমার গরম লাগছে, শওকত, তুমি এটিও গায়ে দাও।
শওকত রওশনের চাদরটি ফিরিয়ে দেয়, রওশন সেটি চেয়ারের পাশে রাখে, আমরা সবাই হাসতে থাকি। হারিকেনের আলোতে টেবিলের ওই পারে রওশনকে ধানখেতের ওপারে আখখেতের ওপরে শিমুল ডালের পাশে পৌষের চাঁদের মতো মনে হয়। আজ আমি আমার টেবিলে পড়তে বসি নি, আমার সামনে কোনো টেস্টপেপার নেই মেইড ইজি নেই একের ভেতরে পাঁচ নেই অভিজ্ঞ হেডমাস্টার নেই; আমার চোখের সামনে রয়েছে রওশন, যে সব বইয়ের থেকে ভালো, যার মুখে নাকে গালে চুলে ঠোঁটে আমি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পড়ছি, সব অংকের সমাধান পাচ্ছি, পৃথিবীর সব ভাব সম্প্রসারিত দেখছি। কানের পাশ দিয়ে জুলপির মতো একগুচ্ছ চুল ঝুলে আছে রওশনের, মাঝেমাঝে রওশন আঙুলে জড়াচ্ছে ওই চুল, দাঁত দিয়ে কাটছে, তার ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে, আমার দিকে স্থির করে রাখছে তার প্রদীপের মতো চোখ দুটি, আড়িয়ল বিলের উত্তরে যেমন আকাশপ্রদীপ জ্বলে। আজ সন্ধ্যায় আমি যতো পড়ছি, যতো প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করছি, ততো আর কখনো করি নি।