রওশন, তুমি বসো, আমি বলি।
না, তোমার পাশে আমার দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগে, রওশন বলে।
শুনে আমার ভালো লাগে, এবং আমি জানতে চাই, কেনো?
রওশন হাসে আর হাসে, আমার আঙুল নিয়ে খেলে, আর বলে, তা বলবো না, তা বলবো না।
শুনে আমার আরো ভালো লাগে, অন্তত একজন আছে, তার নাম রওশন, যার। ভালো লাগে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে।
আমি বলি, রওশনকে একটু কষ্ট দেয়ার জন্যেই বলি, যদি না বলো, তাহলে আর আসবো না।
রওশনের চোখে অশ্রুর সৌন্দর্য দেখা দেয়, আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি।
রওশন বলে, তুমি পুরুষ, তাই এতো নিষ্ঠুর কথা বলতে পারলে, আমি কখনো বলতে পারবো না।
আমি পুরুষ, আমার মনে হতে থাকে, রওশনের থেকে আমার স্থান উঁচুতে; আমি নিষ্ঠুর হতে পারি, রওশন পারে না; নিষ্ঠুরতাকে গৌরবের বলে মনে হয় আমার। আমি পুরুষ, নিষ্ঠুর হবো; রওশন নারী, অশ্রু হবে।
রওশন আমার বুকের সিংহকে আরো জাগিয়ে দেয়; বলে, তোমাকে নিয়ে আমি কতো গর্ববোধ করি! তোমাকে নিয়ে আমার কতো স্বপ্ন!
শুনে আমার বুক স্ফীত হয়ে ওঠে, গর্বে আমি পুরুষ হয়ে উঠি। আমাকে নিয়ে রওশন গর্ব বোধ করে, এটা আমার গর্ব। আমি কি গর্ব বোধ করি রওশনকে নিয়ে? হ্যাঁ, আমিও একরকম গর্ববোধ করি রওশনকে নিয়ে, সেটা হচ্ছে রওশন আমাকে ভালোবাসে, আর কাউকে বাসে না; রওশন আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে, আর কারো জন্যে করে না; আমার মাথায় একটি মুকুট আছে, রওশনকে আমার মুকুটের সবচেয়ে দামি মাণিক্য বলে মনে হয়। বন্ধুরা আজকাল আমাকে খুব বেশি ঈর্ষা করছে। আমি যে প্রথম হই, সবাই জানে খুব ভালো করবো প্রবেশিকায়, কোনো অংক আমার ভুল হয় না, ইংরেজি বাঙলা সব আমার মুখস্থ, ব্যাডমিন্টনও আমি খুব ভালো খেলি, এজন্যে ওরা ঈর্ষা করে না; ঈর্ষা করে এজন্যে যে রওশন, যে সবচেয়ে রূপসী বলে বিখ্যাত আমাদের গ্রামে, তার সাথে আমার বিকেলে দেখা হয়, ওরা বুঝতে পারে। রওশন আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। ওরা আমার কাছে জানতে চায় রওশন আসলেই কতোটা সুন্দর, দূর থেকে তাকে যতো সুন্দর মনে হয় রওশন কি ততোটা সুন্দর? ওরা যে-সুন্দরের কাছে কখনো যেতে পারে নি, যার কাছে একবার যেতে পারলে ওরা আর কিছু চাইতো না মনে হয়, তার কাছে আমি প্রতি বিকেলে যাই, এর জন্যে। আমাকে ওরা ঈর্ষা করছে, আমি এটা উপভোগ করি। রওশন যে আমাকে ভালোবাসে আর আমি যে ভালোবাসি রওশনকে, একথা আমি ওদের বলি না, কখনো বলবো না; কিন্তু ওদের ঈর্ষায় আমি গর্ববোধ করি, রওশন আমাকে এ-গর্বের অধিকার দিয়েছে। আর রওশন আমাকে দিয়েছে জয় করার অভিলাষ। রওশন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে, তার গর্ব আমার রক্ষা করতে হবে; তাই আমি ওই বিকেলের সময়টুকু ছাড়া বই ছেড়ে উঠি না। রওশন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ না করলে আমি এতো পড়তাম না, পড়ছি। আমি রওশনের জন্যে, সে যেনো আমাকে নিয়ে গর্ব বোধ করে, চিরকাল গর্ববোধ করে, তাই আমি পড়ি, পড়ে আমি সুখ পাই। আগেও আমি পড়েছি, কিন্তু এতো সুখ পাই। নি; পড়া আমার জন্যে আনন্দ হয়ে উঠেছে, রওশনের জন্যে; ফিরে ফিরে পড়া সুখ হয়ে উঠেছে আমার, রওশনের জন্যে, আমি প্রতিটি অক্ষরে রওশনের মুখ দেখতে পাই, প্রতিটি অক্ষরে দেখতে পাই রওশন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করছে। রওশন আমাকে সৃষ্টি করে চলছে, রওশন আমাকে পুরুষ করে চলছে।
রওশন, একটি চিঠিতে লিখেছে, আমাকে তোমার কেমন লাগে, আমার মুখ তোমার কেমন লাগে, আমার ঠোঁট তোমার কেমন লাগে, আমার চুল তোমার কেমন। লাগে, আমার চিবুক তোমার কেমন লাগে, আর আর আর আর আমার আমার আমার আমার আমার আমার বুক তোমার কেমন লাগে? এটুকু পড়ে আমার চারপাশ দপ করে জ্বলে ওঠে, আমি আগুনের মধ্যে পড়ে যাই, জ্বলতে থাকি; আমার মেঘে মেঘে ঘর্ষণ চলতে থাকে, বিদ্যুতের ঝিলিকে আমার আকাশ ফালা ফালা হয়ে যায়। আমি ঘুমোতে পারি না, শুধু স্কুপ স্তূপ শুভ্রতা, রজনীগন্ধার পাহাড়, ঢেউ, খড়ের গম্বুজ দেখতে থাকি; রওশনের চিঠি পড়ি-আর আর আর আর আমার আমার আমার আমার আমার। পরের শব্দটিতে এসে কেঁপে উঠি আমি। আমি কী লিখবো এর উত্তরে? আমি কি লিখবো যা আমার স্বপ্ন তাকে আমার কেমন লাগে এ-অসম্ভব প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে দেবো? আমার লেখার শেষ নেই এর উত্তরে, আমি হাজার হাজার বছর ধরে এর উত্তর লিখতে পারি। কিন্তু কিছুই আমি লিখে উঠতে পারি না। আমি এই প্রথম কোনো উত্তর দিতে পারি না। আমার আমার আমার আমার ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি আমি, ঘুম থেকে উঠে চারদিকে আমি স্কুপ স্থূপ শুভ্রতা দেখতে থাকি।
বিকেলে রওশনদের বাড়ি যাই, রওশনের মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। রওশন তার চিঠিগুলো আমার হাতে দেয়, আমি কোনো চিঠি দিতে পারি না।
আমারগুলো? রওশন অবাক আর আহত হয়ে বলে।
লিখতে পারি নি, আমি মাথা নিচু করে বলি। কেননা পারো নি?
রওশন খুব দুঃখ পায়, আর বলে, আমাকে তুমি শুধু কষ্ট দিতে ভালোবাসো।
না, তা নয়, আমি বলি, আমি বুঝতে পারি নি…।
রওশন দু-হাতে আমার মুখ ধরে বলে, আমি জানতে চাই, চাই, চাই, কেমন লাগে তোমার আমার মুখ, আমার চোখ, আমার…।
এমন সময় শওকত এসে ঢোকে, আমি মুক্তি পাই।
কালকে আমরা কান্দিপাড়া বেড়াতে যাচ্ছি, শওকত হাসতে হাসতে বলে, কালকে কিন্তু রওশন মাহবুবকে দেখতে পাবে না।