জানো, রওশন তার চোখ দুটি আমার দু-চোখের ভেতরে বল্লমের মতো ঢুকিয়ে দিয়ে বলে, কাদির স্যার আজকাল তোমাকে একদম দেখতে পারছে না।
আমি যে খুব খারাপ ছেলে, লেখাপড়া করি না, তাই, আমি হেসে বলি, আর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি রওশনের চোখের দিকে, তার ঠোঁটের দিকে। রওশন কী চম। কারভাবে যে তার ঠোঁট নাড়ে, নিচের ঠোঁট ছোঁয়ায় ওপরের ঠোঁটের সাথে, আর দাঁত দিয়ে তার ঠোঁট কাটে!
তুমি খুব খারাপ ছেলে হলে আমি খুব খারাপ মেয়ে, রওশন হাসে, আর বলে, কাদির স্যারের আজ খুব শিক্ষা হলো।
এমনভাবে শিক্ষা না দিলেও পারতে, আমি বলি, গুরুজন তো।
না দিয়ে কী করি? প্রত্যেক দিন কাদির স্যার তোমার নিন্দা করে, রওশন বলে, তাই ঠিক করে রেখেছিলাম একদিন স্যারকে ভুল অংক দুটি দেখাবো। ভুল ইংরেজিটা তো বাকিই রইলো। রওশন হাসে, আর আমার দিকে চোখ দুটি স্থির করে বলে, তোমাকে কেউ নিন্দা করলে আমার একদম ভালো লাগে না, কান্না পায়। আমাকে কেউ নিন্দা করলে তোমার ভালো লাগে, বলো?
না, লাগে না, কোনো দিন লাগবে না, আমি বলি।
তোমাকে নিয়ে আমি কত স্বপ্ন দেখি, রওশন বলে, আমাকে নিয়ে কি তুমি স্বপ্ন দেখো?
দেখি, দিনরাত স্বপ্ন দেখি, আমি বলি।
তুমি দূরে চলে যাচ্ছো ভাবলে আমার কান্না পায়, রওশন বলে; এবং আমার। দু-হাতের মুঠো তার মুঠোর ভেতরে নিয়ে তার দু-চোখের ওপর চেপে ধরে; রওশনের দীর্ঘশ্বাসে আমার হাত দুটি কোমল হয়ে ওঠে।
আমি শিউরে উঠে দেখি রওশনের চোখের জলে আর দীর্ঘশ্বাসে আমার আঙুল ভিজে গেছে। রওশনের মুখের দিকে তাকাই আমি; আগে কখনো যা দেখি নি সে-অসম্ভব। সুন্দরকে দেখতে পাই রওশনের চোখে। অশ্রু। শব্দটি আমি জানি; কিন্তু এর সৌন্দর্য আমি কখনো দেখি নি; রওশনের চোখের কোণায় যে-সৌন্দর্য টলমল করে, যা একটি বিন্দু কিন্তু যা মহাসাগরের থেকেও বিশাল, তা-ই অশ্রু। রওশন দুঃখ পাচ্ছে, ওই দুঃখে রওশন সুন্দর হয়ে উঠেছে, আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি তার মুখের দিকে, সুন্দর। দুঃখের দিকে। এতো দিন আমি রওশনের হাসি দেখেছি, তার ঝিলিকে আমার হৃদয় ভরে গেছে, রওশনকে সুন্দর লেগেছে; কিন্তু আজ দেখছি ভিন্ন সৌন্দর্য, যা অশ্রুতে সাজানো; এতো সুন্দর আর কখনো লাগে নি রওশনকে। দুঃখকে আমার সুন্দর মনে হয়, আমি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারি না। এক সময় মনে হয় রওশন নিজেই একটি অশ্রুবিন্দু হয়ে গেছে, আমার পাশে টলমল করে কাঁপছে, এখনই গলে কাঠের পাটাতনের ওপর। মিশে যাবে, আমি তাকে কোথাও খুঁজে পাবে না।
আমি কখনো দূরে যাবো না, আমি বলি।
তুমি চলে যাবে, আমি জানি, তুমি চলে যাবে, রওশন বলে, আর কয়েক মাস মাত্র। তখন আমাকে ভুলে যাবে।
কখনো দূরে যাবো না, তোমাকে কখনো ভুলবো না, আমি বলি; আমার মুঠোতে রওশনের হাত কাঁপতে থাকে।
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, বাঁচার ইচ্ছে হবে না, রওশন বলে, তুমিই আমার সব।
আমি রওশনের মুখের দিকে তাকাই, তার মুখটি আমি সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছি না, সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, দেখতে পাচ্ছি তার ঠোঁট কাঁপছে। আমরা দুজন একই বয়সের, কিন্তু এখন রওশন যেভাবে আমার মুঠো ধরে আছে, যেভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে, ঠোঁট কাঁপছে, তাতে রওশনকে মনে হচ্ছে নারী, নিজেকে মনে হচ্ছে পুরুষ। বাড়ি ফেরার সময় এ-অনুভূতি আমাকে আলোড়িত করে তোলে, মনে হতে থাকে আমি পুরুষ, আমি রওশনের সব, রওশন আমাকে ছাড়া বাচবে না। নিজেকে আমার কেন্দ্র মনে হয়; রওশন আমাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে, আমাকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে। এখন থেকে আমি রওশনকে হাসাতে পারি, আমি চাইলে সে রৌদ্রের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠবে; আমি রওশনকে কাঁদাতে পারি, আমি চাইলে সে শ্রাবণের মতো কাঁদবে। নিজেকে পুরুষ ভেবে একটা বিস্ময়কর সুখ আমি বোধ করি। রওশনের চোখের জল আমার চোখে সুন্দর লেগেছে, তার আরো চোখের জল দেখতে আমার ইচ্ছে হয়, আগামীকালও তার চোখের জল আমার দেখতে ইচ্ছে হয়। কীভাবে দেখবো? আগামীকাল আমি রওশনদের বাড়ি যাবো না; রওশন নিশ্চয়ই আমার জন্যে অপেক্ষা। করবে, অপেক্ষা করে করে কষ্টে রওশনের বুক ভরে যাবে, তার কান্না পাবে, তার চোখ জলে ভরে উঠবে। পরের দিন বিকেলে আমি যাবো, দেখবো রওশনের চোখে জল। কিন্তু আগামীকাল রওশনকে না দেখে থাকতে আমার কষ্ট হবে, তার হাত না। ছুঁলে আমার কষ্ট হবে; আগামীকাল আমি রওশনদের বাড়ি যাবো, পরে যখন রওশনের চোখের জল দেখতে ইচ্ছে হবে, তখন এক বিকেলে যাবো না; আমার কথা ভেবে ভেবে কষ্টে রওশনের বুক ভরে যাবে। রওশন, আমার জন্যে অপেক্ষা-করে–থাকা অশ্রুবিন্দু; রওশন, আমার জন্যে বুক-ভরে-ওঠা দীর্ঘশ্বাস; রওশন, আমার জন্যে টলমল-করা সুন্দর দুঃখ।
রওশন আমাকে সৃষ্টি করে চলছে; প্রত্যেক বিকেলে রওশনের সাথে দেখা হওয়ার পরই আমি বদলে যাচ্ছি একটু একটু করে; রওশন আমাকে যেমন দেখতে চায়, আমি তেমন হয়ে উঠছি; পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষটি হয়ে উঠছি আমি, রওশন আমাকে তা-ই দেখতে চায় বলে। আমি যে পুরুষ, এটা আমার মনে আসে নি; রওশনই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, আমার ভেতরে একটি সিংহকে জাগিয়ে দিয়েছে রওশন। আগে যখন আমরা তুই বলতাম, তখন সমান ছিলাম দুজনেই; কিন্তু তুমি বলার পর থেকে রওশনই একটু একটু করে আমাকে তার থেকে ওপরে উঠিয়ে দিচ্ছে, আমাকে সিংহাসনে বসাচ্ছে, সে বসছে সিংহাসনের পাশে মেঝের ওপর। সিংহাসনে তার বসার। কোনো ইচ্ছে নেই, যেনো সে বসেও সুখ পাবে না; আমাকে বসাতে পারলেই বেশি সুখ পাবে। রওশন কথায় কথায় বলে, তুমি তো ছেলে, তুমি তো পুরুষ; তাই আমি সব। পারি, সব আমার পারা উচিত; রওশন চায় বলেই আমার পারা উচিত বলে আমার। মনে হয়। রওশনের কথায় আমি গর্ব বোধ করি। একদিন আমার হঠাৎ মনে হয় রওশন সব সময় আমার পাশে দাঁড়িয়েই থাকে; আমি চেয়ারে বসে থাকি, রওশন দরোজার পাশে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, বসে না। রওশনের দাঁড়িয়ে থাকার একটি সুবিধা হচ্ছে আমরা যে হাত ধরে আছি সেটা কেউ দেখতে পায় না উঠোন থেকে; কিন্তু আমি অন্য চেয়ারে গিয়েও দেখেছি, রওশন দাঁড়িয়েই থাকে, খুব দরকার না হলে বসে না।