তবে আমি অমন অসভ্য হবো না, আমরা অমন অসভ্য হবো না; আমরা শুধু হাতে হাত রাখার বেশি কখনো কাউকে ছোঁবো না। অসভ্যরাই অমন করে। বিয়ে করে। অসভ্য মানুষেরা কী করে? একটি বই পড়েছি আমি, খুব নোংরা বই, না অমন নোংরা কাজ আমরা কখনো করবো না। আমরা যখন বিয়ে করবো তখন কি রওশন ভোরবেলা গোসল করবে? রওশন যদি চায়, তাহলে ভোরবেলা গোসল করবে, আমিও করবো; দুজনে ঘুম থেকে উঠে একসাথে ঘাটে গিয়ে গোসল করবো, সাঁতার দিয়ে আমরা। মাঝপুকুরে চলে যাবো, শাড়িতে জড়িয়ে গেলে আমি রওশনকে জড়িয়ে ধরে সাঁতরে ঘাটে নিয়ে আসবো, আমাদের শরীর থেকে কুয়াশা উঠতে থাকবে, সাবানের গন্ধ। বেরোবে শরীর থেকে, রওশন তার শাড়িটা ঘাটে গোল স্কুপ করে রেখে আসবে, দূর থেকে ওটি দেখে আমার ভালো লাগবে; তার লাল পেড়ে শাড়ি যখন ডালিম গাছের নিচের তারে বাতাসে দুলবে, দেখে সুখে আমার বুক ভরে যাবে। কিন্তু আমরা ভোরবেলা গোসল করবো কেনো? সারারাত জেগে জেগে কথা বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে বলে? নাকি বিয়ে করলে ভোরবেলা গোসল করতে হয় বলে? না, ওই বইটায় যে-কথা লিখেছে, সে-জন্যে? আমরা অমন কাজ কখনো করবো না। কিন্তু রওশন যদি চায়? রওশন কি অতো খারাপ হবে? রওশনের সামনে আমি কখনো কাপড় খুলতেই পারবো না, আমার ভীষণ লজ্জা লাগবে; আমি কখনো রওশনকে উলঙ্গ দেখতে পারবো না। কিন্তু রওশন যে লিখেছে, তুমিই পান করবে আমার যৌবন সুধা, তা আমি পান করবো কীভাবে? কীভাবে রওশন আমাকে পান করতে দেবে তার যৌবন সুধা? যৌবন তো আসবে আমাদের দুজনেরই, এসে যাচ্ছে দুজনেরই, কিন্তু কোথায় জমছে কোথায় জমবে সুধাঃ রওশনের সুধা কোথায় জমবে? আমার হাতে আমি দুটি কোমল গন্ধমের ভয়ঙ্কর কোমলতা অনুভব করি, যেখানে একদিন রওশন স্থাপন করেছিলো আমার হাত, সুধা কি জমবে সেখানে? তাহলে তো রওশনের অনেক সুধা জমে গেছে, সুধা তার বুক হয়ে ফুলে উঠেছে। আমি কি পান করবো ওই সুধা, ওই সুধা পান করবো আমি? আমি আর ভাবতে পারি না, আমার রক্ত এলোমেলো হয়ে যায়।
কাদির ভাই আমাকে পছন্দ করছে না আজকাল, আমাকে দেখলে বিব্রত বোধ। করছে, আমাকেও একটু বিব্রত করতে চাইছে। আগে আমাকে দেখলেই দাঁড়িয়ে কথা বলতো, আমি যে প্রবেশিকায় ইস্কুলের জন্যে গৌরব নিয়ে আসবো, যা আমাদের ইস্কুল কখনো পায় নি, তা আমি এনে দেবো, এমন কথা বলতো; এখন কাদির ভাই আমার সাথে কথাই বলতে চায় না। বেশ মজা লাগছে আমার, তবে কাদির ভাইয়ের মজা। লাগছে না, আমি বুঝতে পারি; তার চামড়া আর চামড়ার নিচের মাংস জ্বলছে বলেই মনে হচ্ছে। কাদির ভাই দু-বার আইএ ফেল করে আমাদের পাশের ইস্কুলে পড়ায়; বিকেলে বাড়ি এসে পড়ায় রওশন আর শওকতকে। রওশনকে পড়ায় বলে সে গৌরব বোধ করে; আমাদের সাথে আগে যখন রওশনের কথা বলতে একটু গর্বই বোধ। করতো, একটু কেঁপে উঠতো। আমি যে আজকাল রওশনদের বাড়ি প্রত্যেক বিকেলে যাচ্ছি, এটা তার ভালো লাগছে না। সে জানে না এটা আমার আর রওশনের খুব ভালো লাগছে; আর এটা যে আমাদের খুব ভালো লাগছে জানলে তার আরো খারাপ লাগতো। আগে চারটার মধ্যেই তার পড়ানো শেষ হয়ে যেতো, এখন সাড়ে চারটা বাজলেও শেষ হতে চাচ্ছে না, কোনো কোনো দিন পাঁচটা বেজে যাচ্ছে।
আমি একদিন সাড়ে চারটার সময় পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকতেই রওশন চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে, স্যার, সাড়ে চারটা বাজে, মাহবুব এসেছে, আর পড়বো না। শওকতও তাই বলে
তোমার আরো অনেক পড়া বাকি আছে, কাদির ভাই একটি খাতা দেখতে দেখতে বলে।
সব খাতা তো আপনার দেখা হয়ে গেছে, রওশন বলে।
না, এখনো সব দেখা হয় নি, কাদির ভাই মন দিয়ে খাতা দেখতে থাকে, এবং আমাকে বলে, মাহবুব, তুমি আজকাল পড়াশোনা করো না মনে হয়।
আমি কোনো উত্তর দিই না, উত্তর দেয় রওশন; বলে, মাহবুবের পড়ার আর কিছুই নেই, সব তো মাহবুবের মুখস্থ।
তুমি মাহবুবের খবর রাখো কী করে? কাদির ভাই বলে।
আমি মাহবুবের সব খবর রাখি, রওশন বলে, আপনি জিজ্ঞেস করে দেখুন না, সব খবর বলে দেবো। বলে রওশন আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমিও হাসি।
তবু কাদির ভাইয়ের খাতা দেখা শেষ করার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না; সন্ধ্যা হয়ে। গেলেও খাতা দেখতে থাকবে মনে হয়। রওশন আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, এবং বলে, স্যার, সেদিন আপনি দুটি অংক ভুল করেছিলেন।
কাদির ভাই চমকে ওঠে, রওশন একটি খাতা বের করে।
স্যার, এ অংক দুটি ভুল হয়েছে। মাহবুব নিচে শুদ্ধ করে দিয়েছে। রওশন একবার আমার দিকে তাকিয়ে খাতাটি কাদির ভাইয়ের সামনে খুলে ধরে। কাদির ভাই খাতাটি ছিনিয়ে নিয়ে নিজের করা অংক দুটি পড়তে থাকে, পড়তে গিয়ে ভুল করে, আবার পড়ার চেষ্টা করে, নিচে আমার করা অংক দুটি পড়তে থাকে, শেষে নিজের করা। অংকের ভুল ধরতে পেরে বলতে থাকে, আইচ্ছা, ক্যামনে এই ভুলটা হইল, আইচ্ছা ক্যামনে এই ভুলটা হইল-বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। খুব বিপর্যস্ত হয়ে। পড়েছে কাদির ভাই; আমার দিকে তাকাতে পারছে না; প্রত্যেক দিন বেরোনোর সময়
সে একবার রওশনের দিকে তাকায়, আজ রওশনের দিকেও তাকাতে পারছে না। রওশন তাকে সালাম দেয়, কাদির ভাই কেঁপে কেঁপে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, সাথে শওকতও; আর অমনি আমাদের বুক থেকে কলকল করে হাসি বেরোয়, এবং আমাদের হাত একে অন্যকে ধরে সুখী হয়ে ওঠে। ওরা অনেকক্ষণ ধরে বড়ো কষ্টে ছিলো।