রওশন একটি চিঠি লিখেছে আমাকে, প্রথমে আমি বুঝতেই পারি নি ওটি কী; আমাকে সে চোখ বন্ধ করতে বলে, আমি চোখ বন্ধ করি, অমন সময় শওকত এসে ঢোকে, আর রওশন বলে ওঠে, চোখ খোলো, খোলো; আমি চোখ খুলে শওকতকে দেখে একটু বিব্রত হই, কিন্তু রওশন বলে, আমরা আজ চোখ খোলা চোখ বন্ধ করা। খেলছি। শওকতও চায় চোখ ভোলা চোখ বন্ধ করা খেলতে। রওশন শওকত ও আমাকে চোখ বন্ধ করতে বলে, আমরা চোখ বন্ধ করি; আমি টের পাই রওশনের হাত ঢুকছে আমার বা পকেটে, রওশন কী যেনো রাখছে। শওকত চোখ বন্ধ রেখে অস্থির। হয়ে ওঠে, বলতে থাকে, চোখ তো বন্ধ করেছি, কিন্তু খেলা তো হচ্ছে না। যে-খেলাকে আমার মনে হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেলা, যা খেলার জন্যে আমি সারাজীবন চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি, তা খেলাই মনে হচ্ছে না শওকতের! রওশন আমার পকেট থেকে হাত বের করে বলে, এবার বলো টেবিলের ওপর কী রেখেছি। শওকত বলে, পেন্সিল; আমি বলি, চাঁদ; তখন রওশন একবার আমার হাত ধরে, তার হাত থেকে আমার হাতে অলৌকিক শিখা সঞ্চারিত হয়, রওশন হাত ছেড়ে দিয়ে আমাদের চোখ খুলতে বলে। টেবিলে পেন্সিল দেখে খুব খুশি হয় শওকত, এবং পেন্সিল নিয়ে। বেরিয়ে যায়। রওশন আমার হাত ধরে বলে, বাড়ি গিয়ে দেখবে কী আছে, এখন কিন্তু দেখবে না। না, আমি দেখবো না; আমার পকেটে এখন রয়েছে চিরকালের চরম। বিস্ময়, কোনো অসম্ভব শূন্যোদ্যান বা পিরামিড বা তাজমহল; সবচেয়ে দামি মাণিক্য, পরশপাথর, যার ছোঁয়ায় আমার পকেট সোনা হয়ে যাচ্ছে, মাণিক্য হয়ে যাচ্ছে, তা দেখার জন্যে আমি যুগযুগ অপেক্ষা করতে পারি। একটি অদ্ভুত কাজ করে রওশন আজ; সে তার দু-মুঠোতে আমার হাতটি পুজোর ফুলের মতো ধরে ওপরে উঠোতে থাকে, আমার হাত বিবশ হয়ে যায়, অঞ্জলিতে আমার হাত নিয়ে রওশন তার ঠোঁটে ছোঁয়ায়, ধীরেধীরে তার বুকের মাঝখানে কোমলভাবে ধরে রাখে। কোমলতা, কোমলতা, কোমলতা; আমার জগৎ কোমলতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়, আমি বোধ করতে থাকি দুটি কোমল গোলাকার স্বর্গীয় গন্ধমের মাঝখানে স্থাপিত রয়েছে আমার হাত, স্থাপিত রয়েছি আমি; আমার পক্ষে ওই কোমলতা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে ওঠে, আমি ফেটে পড়তে থাকি, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাই, আমি গলে যাই, আমি ঝরনা হয়ে বইতে। থাকি। রওশন আমার হাত ছেড়ে দিলে আমি টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আবার আমি হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকি।
আমার বয়স পনেরো, রওশনেরও পনেরো; পাঠ্যবইয়ের বাইরে আমি বেশি কিছু পড়তে পাই নি; রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা পড়েছি চয়নিকায়, তাঁর গল্পও পড়েছি; শর ৎচন্দ্রের চারপাঁচটি উপন্যাস পড়েছি; ওগুলো পড়ে আমার বুক সুখে ভরে গিয়েছিলো; রওশনের চিঠি পড়ার পর মনে হতে থাকে এ-পর্যন্ত আমি যা কিছু পড়েছি তা খুবই তুচ্ছ, খুবই বানানো; রওশনের মতো কখনো কেউ কিছু লিখতে পারে নি। রওশনের। প্রতিটি শব্দ নতুন মনে হয় আমার, ওই সমস্ত শব্দ এর আগে কেউ কখনো ব্যবহার করে নি, রওশন আমার জন্যে নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছে, এবং প্রতিটি শব্দকে মধু মেঘ অমৃত চাঁদ শিশির পাখির পালক ঘুঘুর ডাক কোকিলের গান রজনীগন্ধা শিউলি জ্যোৎস্না জলের শব্দে ভরে দিয়েছে। আমি রওশনের চিঠি পড়তে শুরু করি, একনিশ্বাসে পড়ে ফেলি; লাল লাইন টানা কাগজে মাত্র একপাতা লিখেছে রওশন, হাজার পাতা লিখলেও আমার পড়তে একনিশ্বাসের বেশি লাগতো না। বারবার আমি তার চিঠি পড়ি, একটু পরই আমার মুখস্থ হয়ে যায়; মায়ের ডাক শুনে আমি রওশনের চিঠির ভাষা বুকের ভেতরে আবৃত্তি করতে করতে ভাত খেতে নিচে নামি, খাওয়ার সময়ও বুকের ভেতর তার চিঠি আবৃত্তি করতে থাকি, আমার ভয় করতে থাকে মা হয়তো আমার বুকের আবৃত্তির শব্দ শুনে ফেলবে, খাওয়া শেষ করে টেবিলে ফিরে এসে আবার তার চিঠি মুখস্থ করি। আমি কোনো পবিত্রগ্রন্থের পাতা পড়ছি, যেনো এইমাত্র একটি নতুন পবিত্রগ্রন্থের পাতা আকাশ থেকে পড়েছে, এমন মনে হয় আমার; তার একটি অক্ষরও ভুল পড়া যাবে না, একটি শব্দও ভুল করা যাবে না, তাকে বুকের ভেতর এমনভাবে ধারণ করতে হবে যাতে জন্মেজন্মে অসংখ্য মৃত্যুর পরও কোনো ভুল না হয়। আমার হৃ ৎপিণ্ড রওশনের চিঠি মুখস্থ করে, আমার রক্তকণিকারা রওশনের চিঠি মুখস্থ করে, আমার ওষ্ঠজিভ রওশনের চিঠি মুখস্থ করে, আমার মাংস রওশনের চিঠি মুখস্থ করে; এবং তারা সবাই সম্মিলিতভাবে আমাকে ঘিরে ওই অলৌকিক শ্লোক আবৃত্তি করতে থাকে; ওই অলৌকিক ধ্বনিপুঞ্জে আমার সত্তা মুখর হয়ে ওঠে।
কয়েক মাসে আমরা কয়েক শো চিঠি লিখি, হয়তো চার শো বা পাঁচ শো হবে, বেশিও হতে পারে। প্রথম আমরা প্রতিদিন একটি করেই চিঠি লিখি, কিন্তু তিনচার দিন পর মনে হয় একটি চিঠিতে আমাদের প্রকাশ করা অসম্ভব। এটা রওশনই প্রথম বোধ করে। আমি বিকেলে যাই রওশনদের বাড়ি, গিয়ে আমার চেয়ারটিতে বসি; শওকত ঘর থেকে বেরোলেই রওশন কোমর থেকে চিঠি বের করে আমাকে দেয়, আমি পকেটে রাখি; আর আমি পকেট থেকে বের করে রওশনকে দিই, সে তার। কোমরে রেখে দেয়। একদিন ফিরে এসে দেখি রওশন তিনটি চিঠি লিখেছে। প্রথম চিঠিটি সে লেখে সকালবেলা, দুপুরেই তার বুকে অনেক কথা জমে যায়, সকাল থেকে দুপুরকে এক বছরের থেকে বেশি দীর্ঘ মনে হয়, তাই দুপুরে দ্বিতীয় চিঠিটি লেখে, এবং বিকেল হতে না হতেই আরেকটি চিঠি লেখে, কেননা দুপুর থেকে বিকেল আরেক বছরের থেকে বেশি দীর্ঘ। তখন থেকে আমরা দিনে দুটি তিনটি চিঠি লিখতে থাকি, লিখতে লিখতে আমাদের হাতের লেখা খুব সুন্দর হয়ে ওঠে। সম্বোধনের একটি অন্তরঙ্গ সূত্র বের করি আমরা, যা আমাদের কোনো ব্যাকরণবইতে নেই। রওশন আর আমি যখন একা, তখন আমরা বলি তুমি, যখন আমাদের পাশে কেউ থাকে, তখন বলি। তুই; আর আমাদের চিঠিতে তুমি ফিরে ফিরে আসে গানের মতো। প্রথম দিকে আমাদের চিঠি ছিলো হৃদয়ের, আমাদের হৃদয় গান গাইতো হাহাকার করতো চিঠি। ভরে, স্বপ্ন দেখতে অক্ষরে অক্ষরে; কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের মাংস কথা বলতে শুরু করে। প্রথম কয়েক দিন আমি আমার শরীরের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, হয়ে উঠেছিলাম সম্পূর্ণ আত্মা বা হৃদয়, আমার যে একটি শরীর আছে এটাই ছিলো। আমার কাছে বিব্রতকর; কিন্তু রওশনই মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের দুজনেরই শরীর আছে। শুরু করে রওশনই, একটি চিঠির শেষে রওশন লেখে, তুমিই পান করবে আমার যৌবন সুধা। আমি একথা পড়ে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠি; এর একটি শব্দও বুঝতে পারি না; তুমি, পান, আমার, যৌবন, সুধা-প্রত্যেকটি শব্দকে আমার অচেনা মনে হয়, শব্দগুলো আমাকে মথিত করতে থাকে; আমি বুঝতে পারি না কাকে বলে পান করা, আর কাকে বলে যৌবন সুধা; আমি শুধু রক্তে পদ্মার গর্জন শুনতে পাই। হঠাৎ আমার চোখের সামনে রওশনের শরীরটি ভেসে ওঠে, তার শরীরটিকে একটি ধবধবে পানপাত্র বলে মনে হয়, আমি আর ভাবতে পারি না; আবার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধবধবে পানপাত্র ও রওশনের শরীর, ওই পানপাত্র আর ওই শরীর পরিপূর্ণ হয়ে আছে সুধায়, যৌবন সুধায়, আমি দু-হাতে ধরে ওই ধবধবে পাত্র থেকে সুধা পান করছি-ভাবতেই আমার সমস্ত শরীর জুড়ে রাশিরাশি বজ্রপাত হতে থাকে। আমি একঝলকে রওশনকে সম্পূর্ণ নগ্ন দেখতে পাই।