রওশন আর আমি বোবা নই, আমরা যে কোনো কথা বলি নি, তা নয়; অনেক কথাই আমরা বলেছি, কিন্তু আমাদের কোনো কথাই যেনো কোনো অর্থ প্রকাশ করতো না যতক্ষণ আমাদের হাত ধরতে পারতো না পরস্পরকে, আমাদের পায়ের পাতা স্পর্শ করতে না একে অন্যকে। রওশন আর আমি তখন ত্বক আর মাংসের অবর্ণনীয় সুখের। ভেতরে বাস করছি। রওশনের আঙুলগুলো ছিলো দীর্ঘ আর কোমল, যে-কোমলতা, মেঘের নয় পালকের নয় রেশমের নয় গোলাপের নয় বাতাসের নয় জলের নয়, যা শুধু। রওশনের; তার হাতের তালুতে কোমল মাংস, আমার আঙুল ওই দুগ্ধফেনার ভেতর ডুবে যায়; তার ত্বক কচুরি ফুলের পাপড়ির মতো মসৃণ; ওই কোমল মসৃণতা পেরিয়ে। রওশনের হাত থেকে আরেক কোমলতা সঞ্চারিত হয় আমার হাতে, যার কোনো পরিচয় আমি জানি না; হাত বেয়ে ত্বকের ওপর দিয়ে রক্তের ভেতর দিয়ে মাংসের ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে, আর আমার শরীর অলৌকিক হয়ে ওঠে। ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় আমার, মনে হয় চাঁদ গুড়োগুড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমার রক্তে; রওশনের মুখের দিকে তাকিয়েও তার চোখ ভরে মুখ ভরে ভুরুর ওপরে ঠোঁটের। মাঝখানে ঘুমের ঘোলাটে জ্যোৎস্না ছড়ানো দেখতে পাই।
তুমি কেমন আছো? আমি জানতে চাই, বা আমি জানতে চাই না, আমি শুধু জেগে থাকতে চাই। অবাক হয়ে আমি লক্ষ্য করি রওশনকে আমি তুমি বলছি, আমরা তো তুইই বলতাম একে অন্যকে।
ভা-লো, রওশন বলে, কী যে সুখ লাগে তোমাকে ছুঁলে! সেও প্রাণপণে চেষ্টা করে জেগে থাকার, বলে তোমার লাগে না? রওশনও তুমি বলছে আমাকে। আমরা তুই থেকে তুমি হয়ে উঠি।
ঘুম পায় আমার এতো ভালো লাগে, আমি বলি।
চিরকাল ছুঁয়ে থাকবো আমরা, তুমি আমি, রওশন বলে।
তারচেয়েও বেশি, আমি বলি, তারচেয়েও অনেক বেশি।
তুমি সুন্দর, রওশন বলে। আমি খুব বিব্রত বোধ করি, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে আমি সুন্দর, রওশন যা বলে তা কখনো মিথ্যা হতে পারে না।
না, তুমি সুন্দর, আমি বলি।
না, তুমি সুন্দর, রওশন আবার বলে; গানের মতো বলে রওশন, বলতে থাকে। রওশন, তুমি সুন্দর, এতো সুন্দর, কী যে সুন্দর।
রওশনের কথা শুনে আমার মেঘের ওপর ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, আমি ঘুমিয়েই পড়ি, বলি, না, তুমি সুন্দর, রওশন, শুধু তুমিই সুন্দর পৃথিবীতে।
আরো সুন্দর হয়ে ওঠে রওশন,-আমার ওষ্ঠ থেকেও তাহলে উচ্চারিত হচ্ছে চরম সত্য, রওশনের মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও অধিকার পেয়েছি চরম সত্য বলার;–রওশনের মুঠো আরো কোমল হয়ে ওঠে, ওই কোমল মুঠোর ভেতর আমার। আঙুলগুলো আমার হৃৎপিণ্ডের মতো কাঁপতে থাকে। রওশনের মুখের দিকে তাকাই। আমি, জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে থাকে আমার মুখমণ্ডল। মনে হয় শরতের পূর্ণিমা চাঁদের নিচে আমি নৌকো বেয়ে চলছি, বৈঠার শব্দ উঠছে; মনে হয় হেমন্তের পূর্ণ চাঁদের নিচে। পাকা আমন ধানের খেতের পাশে আমি নৌকো লাগিয়ে বসে আছি, শাদা কুয়াশা নেমে আসছে, আমার চুলে শিশির জমছে, কাশবন দুলছে, বাঁশির শব্দ ভেসে আসছে, আর বহুদূরে আড়িয়ল বিলের উত্তরে জ্বলছে একটি আকাশপ্রদীপ। রওশনের শরীর থেকে জ্যোৎস্নার গন্ধ এসে লাগতে থাকে আমার নাকে, কুয়াশার গন্ধ এসে লাগতে থাকে আমার নাকে, ধানের গন্ধ এসে লাগতে থাকে নাকে; আমার শরীর কুয়াশার মতো। ছড়িয়ে পড়তে থাকে ধানখেতের ওপর, আখখেতের ওপর, কাশবনে, নারকেল গাছের পাতায়, দূরের উঁচু উঁচু তালগাছগুলোর পাতায়। রওশন ঝুঁকে পড়ে আমার গ্রীবার ওপর, তার নাক লাগে আমার গ্রীবায়, তার গাল লাগে আমার গালে; আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে হাসে। আমি তখন আর কিছু দেখতে পাই না, চোখ বন্ধ করে ফেলি, এবং বন্ধ আর অন্ধ চোখে দেখতে পাই আকাশজোড়া লাল রঙ।
আমি আর নিজের শরীরের মধু আহরণ করি না, নিজের শরীরের চাক ভাঙি না, ভাঙতে ইচ্ছে করে না; বিস্মিত হই আমি-রওশনের হাতে হাত রাখার আগে নিজের। শরীরের মধুর স্বাদ আমি প্রাণভরে পান করেছি, কিন্তু এখন ইচ্ছে করে না, ঘেন্না লাগে, ওই কথা মনেই পড়ে না। আমি রওশনের হাতের মধু পান করেছি, অন্য কোনো মধু আর আমার কাছে মধুর লাগে না, একমাত্র মধু হচ্ছে রওশনের আঙুলের ছোঁয়া, রওশনের পায়ের পাতায় আমার পায়ের পাতার স্পর্শ, যা আমাকে মেঘের ওপরে। উড়ালের সুখ দেয়। একদিন আমাদের বিয়ে হবে, এমন ভাবনা আসে আমার মনে, তখন আমরা কী করবো? আমি ভাবতে চেষ্টা করি–তখন আমরা হাতে হাত রেখে সারাদিন বসে থাকবো, তখন আমরা হাতে হাত রেখে সারারাত জেগে থাকবো, রওশনের মুখের দিকে আমি তাকিয়ে থাকবো, রওশন তাকিয়ে থাকবে আমার মুখের দিকে। আমরা আর কিছু করবো না। রওশনের শাড়ি থেকে আমার নাকে এসে গন্ধ লাগবে, আমরা হাঁটতে বেরোবো, তখন রওশনের শাড়ির পাড় বাতাসে উড়বে, আমার মুখে এসে পড়বে। আমরা পাশাপাশি শুয়ে থাকবো, রওশনের শরীরের ছোঁয়া লাগবে আমার শরীরে, রওশনের গালে আমি আমার আঙুল বুলোবো, রওশন আমার নাকের ওপর তার আঙুল রাখবে, আর আমরা সারারাত কথা বলবো। আমরা কি আর কিছু করবো? রওশন তখন ব্লাউজ পরবে, লাল ব্লাউজ পরবে, ব্লাউজের ওপর দিয়ে তার গলা দেখা যাবে, তার গ্রীবা দেখা যাবে। আমি কি কখনো তার ব্লাউজ খুলবো? না, না, না; আমি কখনো তার ব্লাউজ খুলব না, রওশন কী মনে করবে, রওশন আমাকে খুব। খারাপ মনে করবে; আমরা অতো খারাপ হবো না। বিয়ে হলে লোকেরা ন্যাংটো হয়ে শোয়, তারা খুব খারাপ কাজ করে, রওশন আর আমি কখনো ন্যাংটো হবো না, কোনো খারাপ কাজ করবো না; আমরা চুমো খাবো-রওশন আস্তে আমার গালে ঠোঁট ছোঁয়াবে, আমি আস্তে রওশনের গালে ঠোঁট ছোঁয়াবো, তাতেই আমাদের ঘুম এসে যাবে, আমরা পাশাপাশি ঘুমিয়ে পড়বো, জেগে উঠে দেখবো আমরা পাশাপাশি শুয়ে আছি, আমাদের একজনের হাতে আরেকজনের হাত। রওশন যদি কখনো ব্লাউজ পরতে গিয়ে পরতে না পারে, যদি আমার চোখের সামনে তার দুধ দুলে ওঠে? আমি চোখ বন্ধ করে ফেলবো, আমি অতো অসভ্য হতে পারবো না, আমরা কোনো অসভ্য কাজ করবো না, আমরা শুধু হাত ছুঁয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবো, আমরা শুধু ভালোবাসবো।