আমি যখন চলে আসি তখনো মনে হচ্ছিলো রওশন আমার হাত ধরে আছে, আমি রওশনের হাত ধরে আছি; কিন্তু লেবুঝোঁপের পাশে এসেই আমার হাত আর বুক খুব শূন্য লাগতে শুরু করে, রওশনের হাত আরেকবার ধরার পিপাসা বুকে বোশেখের রোদের মতো কাঁপতে থাকে। রওশনের হাত একবার ধরার পর তারপর না ধরে থাকা কী কঠিন কী কষ্টকর তা আমি লেবুঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে মর্মেমর্মে অনুভব করি। আবার ফিরে যাবো, গিয়ে আরেকবার রওশনের হাত ধরবো? কেউ কি দেখে ফেলবে না? রওশন কি কিছু ভাববে? না, আমাকে ফিরে যেতে হবে, ওই হাত আরেকবার ছুঁতেই হবে, নইলে আমি বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাবো না। সন্ধ্যা নেমে গেছে, আমি আবার রওশনদের বসার ঘরের দিকে পা বাড়াই; রওশন দাঁড়িয়ে আছে বাঁধানো কবরের পাশের ডালিম গাছের নিচে। রওশনের হাতও কি রওশনকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ডালিম গাছের নিচে? আমি কাছে যেতেই আমাদের হাত কখন যে পরস্পরকে ধরে ফেলে, তা আমরা কেউ জানতে পারি না। কোনো কথা বলি না আমরা, আমাদের কোনো কথা নেই, কথা আছে আমাদের হাতদের, তারা কথা বলতে থাকে, তাদের গলা থেকে সোনা ঝরতে থাকে। আমাদের হাতদের কথা অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়, আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করি। এক দুই তিন চার, কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি আর রওশন গৌণ হয়ে যাই, আমরা কেউ নই, আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই; অস্তিত্ব আছে শুধু দুজনের হাতের, রওশনের ডান হাতের আর আমার বাঁ হাতের। আমি গিয়ে রওশনদের বসার ঘরে বসলেই রওশনের ডান হাত আমার বাঁ হাতকে মুঠোতে তুলে নেয়, আমার ডান হাত রওশনের বা হাতকে মুঠোতে তুলে নেয়; আমরা চুপ করে থাকি, হাতেরা কথা বলে। হাতদের কথা বলায় আমরা কোনো বাধা দিই না, আমরা কথা বলে হাতদের কথা বলায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করি না; আমরা শুধু চাই ওরা ঝোঁপের আড়ালে বসে নিজেদের অন্তরঙ্গতম কথাগুলো বলুক; আর চাই তাতে যেনো আর কেউ ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। আমরা দুজন প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে থাকি;–আমি জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি কেউ আসে কিনা, তাকায় কিনা; রওশন দরোজা দিয়ে তাকিয়ে দেখে কেউ আসে কিনা, কেউ তাকায় কিনা। হাতেরা যখন একে অন্যের সাথে কথা বলে তখন তারা বাইরের কিছু দেখতে পায় না, তাদের হয়ে দেখি আমি আর রওশন, আমাদের হাতেরা কথা বলে একে অন্যের সাথে।
পাহারা দেয়া, বুঝতে পারি আমরা, খুব কঠিন কাজ; পাহারা দিতে গিয়ে আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় প্রখর হয়ে ওঠে, ধারালো হয়ে ওঠে শান দেয়া ছুরিকার মতো; দূরে, কোথাও পাতা খসে পড়লে শুনতে পাই, ছায়া কেঁপে উঠলে দেখতে পাই,-অমনি আমাদের হাত সরে যায় পরস্পরের থেকে; যখন বুঝতে পারি ওটি পাতা খসার শব্দ ওটি ছায়া কাঁপার দৃশ্য, তখন আমাদের হাত আবার পরস্পরকে বুকে তুলে নেয়। রওশনের আব্বা মাঝেমাঝেই এদিক দিয়ে বাইরে যান, আবার ফিরে আসেন, তখন আমাদের হাত খুব দূরে সরে যায়রওশনের আম্মা কখনো উঠোনে আসেন, পুকুরের। দিকে যান, তখন আমাদের হাত সরে যায়; আর আছে শওকত, তার কাজ আসাযাওয়া, এই ঘরে ঢুকছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে, তাই আমাদের হাত এই ঠুচ্ছে পরস্পরকে আবার দূরে সরে যাচ্ছে একে অন্যের থেকে। দূরত্ব সম্পর্কে একটি অনুভূতি হয় আমাদের। আমরা বুঝতে পারি দু-ইঞ্চি দূরত্ব আর দু-কোটি মাইল দূরত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; আমাদের হাত যদি পরস্পরকে না ধরে থাকে তখন এক ইঞ্চি দূরত্ব আর এক কোটি মাইল দূরত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যখন আমরা না ছুঁয়ে থাকি তখন আমরা অনন্তের থেকেও বেশি দূরে। আমাদের চোখেরাও তখন সুন্দর ছাড়া আর কিছু দেখতে ভুলে গেছে, আমি রওশনের দিকে তাকাই, দেখি সুন্দর; রওশন আমার দিকে তাকায়, সেও দেখে সুন্দর; যদি সে সুন্দর না দেখতো তাহলে অমন করে এতোক্ষণ ধরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতো না। এর আগে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আমি তাকিয়েছিলাম একটি ফুলের দিকে, দীর্ঘ কয়েক মিনিট তাকিয়ে ছিলাম, অতো সময় ধরে আর কোনো কিছুর দিকে আমি তাকাই নি; অতো সুন্দর ফুলের। দিকেও কয়েক মিনিটের বেশি আমি তাকিয়ে থাকতে পারি নি; কিন্তু রওশনের দিকে। মুখের দিকে আমি সারা বিকেল তাকিয়ে থাকতাম, যেমন রওশন তাকিয়ে থাকতো। আমার মুখের দিকে। রওশন তাকিয়ে থাকতে বলে আমার মুখটি তখন সুন্দর হয়ে উঠেছিলো।
সন্ধ্যা হলে চলে আসতাম আমি। সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা নিষেধ ছিলো আমার; তবে কোনো কোনো দিন, প্রায় প্রত্যেক দিন, শওকত আর রওশন দুজনেই আমাকে থাকতে বলতো আরো কিছুক্ষণের জন্যে, ওদের সাথে পড়ার জন্যে, এবং আমি নিষেধ সত্ত্বেও ওদের সাথে, সপ্তাহে দু-এক দিন-বিশেষ করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, না থেকে পারতাম না। টেবিলে মুখোমুখি বসতাম রওশন ও আমি, ডান দিকে বসতো শওকত; তখন আমরা বেশ দূরে, আমাদের হাত ধরতে পারতো না পরস্পরকে, আমাদের মনে হতো আমরা দুই গ্রহে রয়েছি। রওশন এক বিস্ময়কর আবিষ্কারক, রওশনই তখন স্পর্শের নতুন রীতিটি বের করে। প্রথম সন্ধ্যায়ই, যখন আমি রওশনের থেকে লাখ লাখ আলোকবর্ষের দূরত্বে থাকার কষ্টে কাতর হয়ে উঠছি আর রওশন তা বুঝতে পেরে আরো কাতর হয়ে উঠছে, তখন আমার ডান পায়ের পাতার ওপর আমি অনুভব করি একপ কোমলতার লঘুতা, এবং সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি রওশনের চোখ দুটি কথা বলছে। আমার চোখ তার চোখের কথা সাথেসাথেই বুঝে ফেলে, আমি তখন আমার বাঁ পা রাখি রওশনের ডান পায়ের পাতার একরাশ কোমল মসৃণতার ওপর। আমাদের পা কথা বলতে থাকে। এর পর যে-সন্ধ্যায়ই আমি ওদের সাথে থেকেছি, আমার ডান পায়ের পাতার ওপর রওশন রাখতে তার বা পা, আর রওশনের ডান। পায়ের পাতার ওপর আমি রাখতাম আমার বাঁ পা। কথা বলতো আমাদের পায়েরা। পায়েরাও চমৎকার কথা বলতে পারে, পায়েরাও কোমল হতে হতে গন্ধরাজ হয়ে উঠতে পারে, আমাদের পা গন্ধরাজ হয়ে টেবিলের তলদেশকে সুগন্ধে ভরে দিতে, থাকে। আমাদের দুজনের পায়ের পাতা থেকে সুগন্ধ উঠছে, আমরা তাতে বিভোর হয়ে আছি, সে-গন্ধে আমাদের রক্ত পাগল হয়ে উঠছে মাতাল হয়ে উঠছে বুলবুলি হয়ে উঠছে প্রজাপতি হয়ে উঠছে পদ্ম হয়ে উঠছে চাঁদ হয়ে উঠছে রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠছে। শওকত একদিন আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে টেবিলের নিচে আমাদের পায়েরা মাতাল হয়ে গেছে। কিন্তু সে তো আর টেবিলের নিচে অকারণে উঁকি দিতে পারে না! তাকে একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ বের করতে হয় টেবিলের নিচে উঁকি। দেয়ার জন্যে;–সে তার হাতের পেন্সিলটি নিচে ফেলে দিয়ে হ্যারিকেন নিয়ে টেবিলের নিচে পেন্সিল খুঁজতে থাকে, আমাদের পায়ের পাতা দূরে সরে যায়; আর তখন। টেবিলের ওপরের অন্ধকারে আমাদের হাত খুঁজে পায় একে অন্যকে, শান্তিতে ভরে যায় তাদের প্রতিটি আঙুল, আঙুলের মাংস, নখ, আঙুলের হৃদয়। শওকত হঠাৎ মাথা তোলে টেবিলের নিচে থেকে, আর অমনি আমাদের হাতেরা দূরে সরে যায়, যেনো তারা। কখনো কাছাকাছি আসে নি, আসার কোনো সাধ নেই তাদের; এবং তখন টেবিলের নিচে আমার ডান পায়ের ওপর এসে পড়ে একপ কোমলতার লঘুতা, আর আমার বা পায়ের পাতা গিয়ে পড়ে একস্তূপ কোমল মসৃণতার ওপর। শওকত বারবার পেন্সিল ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, আর আমাদের পায়েরা একে অন্যের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে।