শওকত এখন কোথায় কেমন কী করে জানি না, কিন্তু ওকে আমার মনে পড়ে; ও-ই আমাকে স্বপ্নের খুব কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। আমার;–সাধারণত স্বপ্ন দেখি না আমি, কিন্তু দেখলে রওশনকেই দেখি। আমার অন্য কোনো স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু অন্য কিছুই আমি দেখি না, কয়েক মাস পর হঠাৎ স্বপ্ন দেখি, দেখি রওশন, এবং সে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে; আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমি নারকেল গাছের নিচে, অগ্নিগিরির জ্বালামুখের ওপর, একলা পড়ে থাকি। শওকত, রওশনের ছোটোভাই, এক বিকেলে আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়, আমি যেতে চাই নি আর না গিয়েও পারি নি; আমরা বসার ঘরে ক্যারোম খেলতে থাকি। শরৎ শেষ হয়ে আসছে, হেমন্ত দেখা দিচ্ছে, বিকেলটি কোমলতায় ভরে গেছে, পৃথিবীতে এতো কোমল বিকেল হয়তো আর আসে নি; আমি এক সময় অনুভব করি পেছনের জানালা দিয়ে একটি হাত তার পাঁচটি কোমল আঙুল আমার চুলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ওই অনির্বচনীয় আঙুলগুলো তারপর স্থির হয়ে থাকে আমার মাথার। মাঝখানে, আমার শরীর জুড়ে কোমলতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আর আমি খুব ধীরে আমার বাঁ হাত উঠিয়ে আমার পাঁচটি আঙুল রাখি ওই অঙ্গুলিমালার ওপর, এবং পেছনের দিকে ফিরে তাকাই। রওশন হাত সরিয়ে নিয়ে শরতের চাঁদের মতো হাসে। এতো কাছে থেকে আগে কখনো আমি চাঁদ দেখি নি, আমার জানালার এতো কাছে এর আগে কখনো চাঁদ ওঠে নি। রওশন একটু পর ঘরে এসে ঢোকে; শওকত আর খেলবে না, রওশন আর আমি খেলতে থাকি। রওশন যখন স্ট্রাইক করে তার চুল ছড়িয়ে পড়ে, মাঝখানে একটি চাঁদ ভাসতে থাকে; রওশন যখন স্ট্রাইক করে, তার আঙুল ফুলের মতো দল মেলে। স্ট্রাইকার ফেরত নেয়ার সময় আমার আঙুলে লাগে রওশনের আঙুল, আর রওশনের আঙুলে লাগে আমার আঙুল; আমরা মুখে কথা না বলে আঙুল দিয়ে কথা বলতে থাকি। রওশনের প্রতিটি আঙুলের নিজস্ব কণ্ঠস্বর রয়েছে, তাদের গলা থেকে গলগল করে সোনা ঝরতে থাকে, আমি সেই সব স্বর শুনতে পাই; এর আগে আমি কখনো স্পর্শের স্বর শুনি নি। আমার মনে হতে থাকে এর আগে আমাকে কেউ ছোঁয় নি, আর আমিও কখনো কিছু ছুঁই নি, কাউকে ছুঁই নি।
আঙুল, আঙুলের রূপ, আঙুলের স্বর, আমার সন্ধ্যাটিকে এক কোটি দশ লাখ সুরে। ভরে দেয়; আমি যখন বেরিয়ে আসি চারপাশে মহাজগত ভরে কুয়াশায় গাছের পাতায় পাখির ডানায় আমি পাঁচটি আঙুলের স্বর শুনতে পাই। আমার রক্তে ওই স্বর ঢুকে যায়, চারপাশের বাতাসকে আশ্চর্যরকম মসৃণ পরিসুত মনে হয়, নিজেকে এতো হাল্কা লাগে। যে আমি হেঁটে বাড়ি না ফিরে মেঘলোকের ওপর দিয়ে নক্ষত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাড়ি ফিরি; তার আগে একবার নদীর দিকে যাই, মনে হতে থাকে পাঁচটি আঙুল নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে, আর জড়িয়ে আছে আমার পাঁচটি আঙুলের সাথে, মনে হতে থাকে পাঁচটি আঙুল এখনো আমার চুলের ভেতর পাঁচটি স্রোতের মতো ঢুকছে, ঢুকে স্থির হয়ে আছে, সেখান থেকে কোমলতা ছড়িয়ে পড়ছে আমার মাংসের ভেতর রক্তের ভেতর নদীর ভেতর। গাছপালার ভেতর কুয়াশার ভেতর। আমার আঙুলগুলোর দিকে তাকাই আমি, বারবার, দেখে মনে হয় ওগুলো অন্য রকম হয়ে গেছে, জন্মান্তর ঘটে গেছে ওগুলোর, সোনা হয়ে গেছে, ওগুলোর গায় কখনো আর ময়লা লাগবে না। ওইটুকু স্পর্শ নিয়েই আমি বিভোর হয়ে ছিলাম, আর কোনো স্পর্শ আমার জীবনে দরকার পড়বে বলে মনে হয় নি; যতোদিন বাঁচবো ততোদিন ওই স্পর্শ আমি আমার আঙুলে আমার রক্তে বয়ে বেড়াতে পারবো। তাই আমি মেঘের ওপর মেঘে বেড়াতে থাকি, একদিন দু-দিন তিনদিন চারদিন; রওশনের মুখ আমি ভুলে যাই, আঙুলগুলোকে ভুলে যাই, শুধু তার স্পর্শ বয়ে বেড়াতে থাকি। রওশনদের বাড়ির সামনের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার চোখ অন্ধ হয়ে আসতে থাকে, কিছু দেখতে পাই না আমি, শুধু স্পর্শ দেখতে পাই; এবং একদিন বিকেলে যখন আবার চোখে দেখতে পাই দেখি রওশন হাত তুলে ডাকছে আমাকে।
অনেক বছর ধরে যেনো আমি দুর্গম পথ হাঁটছি বা এখনো হাঁটতে শিখি নি, এমন করে আমি হাঁটতে থাকি রওশনদের সড়ক ধরে, রওশনদের বাড়িতে ঢোকার পথের। নারকেল গাছগুলোকে নতুন করে দেখি; রওশনদের বসার ঘরের পাশে একটি বাঁধানো কবর আছে, সেটিকে দেখি অনেকক্ষণ ধরে, এই প্রথম দেখছি বলে মনে হয়, এবং দেখতে পাই রওশন দাঁড়িয়ে আছে। রওশনের সাথে বসার ঘরে ঢুকি আমি, আমাকে বসতে বলে রওশন বেরিয়ে যায়; আমি জানালার পাশের চেয়ারটিতে বসে লক্ষ লক্ষ বছর কাটাতে থাকি, একসময় দেখি রওশন আমার পাশে দাঁড়ানো, এবং আমার বা হাতটি তার ডান হাতের মুঠোর ভেতর। আমি রওশনের মুখের দিকে তাকাই, জ্যো ৎস্নায় আমার চোখমুখ শীতল হয়ে ওঠে; এতো জ্যোৎস্না আমার মুখের ওপর আগে আর কখনো ঝরে পড়ে নি। আমি যদি অনেক আগেই অন্ধ না হয়ে যেতাম তাহলে ওই জ্যোৎস্নায় আমার দু-চোখ সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু জ্যোৎস্নার থেকে আরো অসামান্য ঘটনা রওশনের মুঠোতে আমার বা হাত;–আমি বুঝে উঠছি না আমার হাত নিয়ে আমি কী করবো, সেটিকে কি আমি অনন্তকাল ওই মুঠোতেই রেখে দেবো, ওই মুঠোতে থাকলেই কি সেটি সবচেয়ে শান্তি পাবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আমি। রওশন আমাকে ধরেছে, রওশন আমাকে ছুঁয়েছে; আমি এখনো ধরি নি, আমি এখনো। দুই নি। রওশন আস্তে বলল, আমাকেও ধরো। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম, রওশন তাকালো আমার মুখের দিকে; আমার আঙুলগুলো সজীব হয়ে উঠলো একটু একটু করে, অমনি কী যেনো রওশনের আঙুল থেকে আমার আঙুলে আর আমার আঙুল থেকে রওশনের আঙুলে বইতে শুরু করলো–তা বিদ্যুৎ নয়, বিদ্যুতের থেকে তীব্র ও আলোকময়; তা কার্তিকের কুয়াশা নয়, কার্তিকের কুয়াশার থেকে অনেক কোমল। অনেক কাতর। আমরা সারা বিকেল হাতে হাত রেখে জীবন যাপন করলাম, আমাদের মনে হলো আমাদের হাত দুটি পরস্পরের মুঠোতে থাকলেই শুধু বেঁচে থাকে। রওশন শুধু মাঝেমাঝে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলো কেউ আসে কিনা কেউ উঁকি দেয় কিনা। সেই বিকেলে আমরা দুজন বদলে গেলাম, আমরা দুজন আবার জন্ম নিলাম।