কি মিয়ারা, সিয়ানা অইয়া গ্যাছ বুঝি, তারা বলে, আইজকাইল আর সেলামআদাব দেও না।
সালামাইকুম, বলে আমরা কেটে পড়ি।
তারা থাকবে বিচারে, তারা বিচার করবে। বাবাও থাকবেন, মকবুল আর হান্নানের। বাবাও থাকবেন। কিন্তু আমাদের বিচার দেখতে হবে।
বিচারটা দেখতেই হবে, কোনোদিন তো আমাদের নিয়েও এমন বিচার হতে পারে, মকবুল বলে।
আমি মকবুলের কথা শুনে ভয় পাই, আমাকে নিয়ে এমন বিচার হচ্ছে ভাবতে পারি না।
তুই কার পক্ষে? মকবুল আর হান্নান আমাকে জিজ্ঞেস করে।
এতে আবার পক্ষ নিতে হবে নাকি? আমি জিজ্ঞেস করি।
যদি হয়? ওরা জানতে চায়।
আমি সোনামতি আপা আর ইদ্রিসদার পক্ষে, আমি বলি।
হ, আমরা সোনামতি আপা আর ইদ্রিসদার পক্ষেই, ওরা বলে। মকবুল একটু বেশি করেই জোর দেয় কথাটির ওপর, এবং একটি সিগারেট ধরায়, আমি অবাক হই।
বাবার পকেট থেকে চুরি করেছি, মকবুল হাসতে হাসতে বলে।
সোনামতি আপাদের রান্নাঘরের বেড়ার আড়ালে সন্ধ্যার অন্ধকারে লুকিয়ে আমরা বিচার শুনছি, দেখতে পাচ্ছি না বেশি; তবে তাদের সবার গলাই চেনা আমাদের, কে। কথা বলছে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। আবুল হাশেমের গলাটাই শোনা যাচ্ছে বেশি। বুড়োরা অত্যন্ত অশ্লীল কথা বলতে পারে, তারা তা অবলীলায় বলে যাচ্ছে। খানকি শব্দটি। তাদের বেশ প্রিয়, বারবারই বলছে। হাশেম জোরে চিৎকার করে বলছে তার চোখেই প্রথম ঘটনাটি ধরা পড়ে;–একরাতে সে দেখতে পায় সোনামতি আর সোনামতির মা যে-ঘরে থাকে, ইদ্রিস সে-ঘরের দরোজায় এসে আস্তে হাঁটু দিয়ে তিনবার টু দেয়। তখন ওই ঘরের দরোজা খুলে যায়। আবুল হাশেম ঘটনাটি পরীক্ষা করেও দেখে। একরাতে সে নিজে সোনামতির মায়ের ঘরে গিয়ে তিনবার হাটু দিয়ে টু দেয়, তখন। সোনামতি দরোজা খুলে দেয়; তাকে দেখে সোনামতি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে। সোনামতিকে জিজ্ঞেস করে সোনামতি কেনো দরোজা খুলেছে, সোনামতি মিথ্যা কথা বলে যে বাইরে যাওয়ার জন্যে সে দরোজা খুলেছে। আবুল হাশেমের সাথে আরো। তিনচারজন চিৎকার করতে থাকে। সোনামতি আর তার মা যে-ঘরে থাকে, হাশেম সে-ঘরটির বিস্তৃত বর্ণনা দেয়। সে বলে ঘরটিতে কোনো খাট নেই চৌকি নেই, মাটিতে দুটি বিছানা রয়েছে; একটিতে থাকে সোনামতির আধমরা মা, যার মরার বেশি বাকি নেই, যার হুঁশ নেই; অন্যটিতে থাকে সোনামতি। হাশেম চিৎকার করে বলে যে ইদ্রিস আর সোনামতি মায়ের পাশে শুয়ে কবিরা গুনা করেছে, তাদের লাজলজ্জার বালাই নেই: আর সোনামতির মায়েরও লাজলজ্জা নেই, নিজের পাশে শুয়ে সে নিজের মেয়েকে জিনা করতে দিয়েছে। সোনামতির মাকে ডাকা হয়, কিন্তু তার কোনো হুঁশ নেই; হাশেম বারবার জিজ্ঞেস করে, সে যা বলেছে তা সত্য কিনা; সোনামতির মা কোনো কথা বলে না, হয়তো সে কিছু শুনতে পায় নি। তোতাখা চিৎকার করে বলে যে খানকির ঘরে তো খানকিই হবে, সোনামতির বাপ বছরের পর বছর জাহাজে কাজ করেছে, আর। খানকিটা বছরের পর বছর যারেতারে দিয়ে পেট বানিয়েছে; তার মেয়ে তো খানকিই হবে। এবার মনে হলো সোনামতি আপার মা শুনতে পাচ্ছে, সে আস্তে আস্তে উত্তর দিতে চেষ্টা করছে; সে বলছে, আমি জুদি বছর বছর সোনামতির বাপ ছাড়া অন্যের লগে পেড বানাইয়া থাকি, তয় ত আমি বিদাশ থিকা মরদ ভাড়া কইর্যা আনি নাই, আপনাগো কারো লগেই পেড বানাইছি। একটা হৈচৈ পড়ে যায় চারপাশে, সোনামতির মা আর কথা বলে না। বিচার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। ইদ্রিসদা চিৎকার করে ওঠেন, জিনা আমি বুঝি না, সোনামতির লগে আমার ভাব হয়েছে, আমি তারে বিয়া। করুম। সোনামতির পেটের পোলা আমার। তার দু-দিন পর দু-বাড়িতে সারাদিন ধরে কোরান পড়া হলো, সোনামতি আপার আর ইদ্রিসদার বিয়ে হয়ে গেলো।
মকবুল অনেক খবর রাখে
মকবুল অনেক খবর রাখে, প্রত্যেক ঘরের খবর তার মুঠোর ভেতরে। একদিন সে বললো, আমাদের গ্রামে কমপক্ষে দশটা জারজ আছে। শুনে আমার ভয় লাগলো না, বরং মনে হলো ভাগ্য ভালো জারজ দেখে চেনা যায় না; চেনা গেলে খুব ভয়ঙ্কর হতো। তার মতে বুড়োগুলো কি কম শয়তান, এখন একেকটা দাড়ি রেখে মুরব্বি সেজেছে, টুপি মাথায় দিয়ে নামাজ পড়ে কপালের চামড়া তুলে ফেলছে, কিন্তু সেগুলো কি কম শয়তান ছিলো? সুবিধা পেলে এখনো কি কম শয়তানি করে যাত্রার সময় তারা কী। করে, আমরা জানি না? মকবুল একটি একটি করে জারজের নাম শোনাতে। থাকে-আবুল হাশেম, ইসমাইল মোল্লা…। নামগুলো সে তার দাদীর কাছে শুনেছে, তার দাদী গ্রামে কার সাথে কে শুয়েছে তার পঞ্চাশ বছরের সব খবর রাখে। মকবুল বলতে। থাকে, ওই যে জাহাজে যারা কাজ করে, যারা আসাম আর দিনাজপুর থাকে, বছর বছর বাড়ি আসে না, তাদের বউদের ছেলেমেয়ে হয় কেমনে? যারা সারারাত ইলিশ ধরে। পদ্মায়; তাদের বউগুলো কি একলা থাকে? আমি শুনি আর চোখের সামনে ভেঙে পড়া দেখতে থাকি; পদ্মার পার যেমন করে ভাঙে তেমন করে ভেঙে পড়তে থাকে-কী যেনো ভেঙে পড়তে থাকে, কী সব যেনো ভেঙে পড়তে থাকে, আমি বুঝে উঠতে পারি না; কিন্তু ভাঙনের দৃশ্যে আমার চোখ ভরে যায়।
রওশনদের বাড়ি আমি অনেক বছর যাই নি, যার সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম; তারপর সে শহরে চলে গিয়েছিলো শহরের ইস্কুলে বেশি ভালো করে পড়বে বলে, আবার ফিরে এসেছে; ফেরার পর আর দেখা হয় নি। রওশনের উচ্চশিক্ষা কি শেষ হয়ে গেলো? দূর থেকে রওশনকে মাঝেমাঝে দেখি আমি, যখন ইস্কুলে বা খেলার মাঠে যাই, দেখি রওশন নারকেল গাছের পাশে দাঁড়িয়ে মাঠ দেখছে বা দেখছে আমাকে, বা পুকুরের পানি দেখছে, বা আকাশ দেখছে বা কিছুই দেখছে না, শুধু আমি দেখছি। তাকে। রওশন কী দেখতে পছন্দ করে, তা আমি জানি না; তবে দূর থেকে তাকে দেখে আমরা ধন্য হচ্ছি। গ্রামে রওশন ভিন্ন ছিলো; আমাদের বয়সের একমাত্র সে-ই শুধু। শহরে গেছে, আর ফিরে এসেছে শহর থেকে, এবং সে সালোয়ারকামিজ পরে, গলায় দোপাট্টা ঝুলিয়ে রাখে, শাড়ি পরে না। আর সে সুন্দর। তাকে দেখার জন্যে মকবুল মাঝেমাঝে এমনভাবে ঘুড়ির সুতো ছিঁড়ছে, যাতে ঘুড়িটি গিয়ে ওদের নারকেল গাছে আটকায়। মকবুলের ঘুড়ি মকবুলের কথা শুনছে চমৎকারভাবে, উড়ে গিয়ে আটকে যাচ্ছে রওশনদের নারকেল বা আমগাছে; মকবুল ঘুড়ি আনতে গিয়ে কখনো দেখতে পাচ্ছে রওশনকে, আর যতোক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না ততোক্ষণ সে কিছুতেই ঘুড়ি ছাড়াতে পারছে না। আমি ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবছি না; কিন্তু দেখতে পাচ্ছি আমি ইস্কুলে যাওয়ার সময় রওশন আকাশ দেখার জন্যে এসে উপস্থিত হচ্ছে নারকেল গাছের গোড়ায়, ফেরার সময় সে পুকুরের জলে ঢেউ আর হাঁসের সাঁতার দেখার জন্যে এসে দাঁড়াচ্ছে বাঁধানো ঘাটে। ওই সময় আকাশ আর পুকুরের ঢেউ আর হাঁস ওর নিশ্চয়ই সুন্দর লাগছে সারাদিনের আকাশ আর জলের ঢেউ আর হাঁসের সাঁতার থেকে। কিন্তু। ওকে দেখার পর আমি আর হাঁটতে পারি না; কয়েক দিন আমি অনেক পথ ঘুরে ইস্কুলে গেছি, ঘুরে ফিরেছি, আর মাঠে যাই নি। তারপর খুব শূন্য লাগছে। শূন্য লাগার থেকে। অনেক ভালো সোজা পথে ইস্কুলে যাওয়া, ঠিক সময়ে মাঠে যাওয়া, আর কারো আকাশ আর পুকুরের জলের ঢেউ দেখাকে বিষাক্ত না করা।