আমার রক্তের মধু প্রাণ ভরে পান করেছি আমি, আমার রক্তমাংস আষাঢ়ের আকাশের মতো বস্ত্র ও বিদ্যুতে খানখান ফালাফালা হয়ে গেছে, আমার ভেতর থেকে নালি বেয়ে বেয়ে মধু ঝরেছে। একটি ধর্মের বই তখন হাতে আসে আমার, তাতে আমি পড়ি ওইভাবে চাক ভেঙে মধু বের করা পাপ, তখন আমার ভয় লাগতে থাকে, দোজগের আগুন দেখতে পাই, কেননা বইটি ভরেই জ্বলছিলো দোজগের আগুন। কিন্তু পাপ আর দোজগের আগুন ওই মধুর প্লাবনে বারবার নিভে যেতে থাকে। সুন্দরের মধ্যে গেলেই আমার ইচ্ছে হতো চাক ভাঙতে। একবার দুপুরে আমার ডাব খেতে ইচ্ছে হয়; আমি আমাদের নারকেল বাগানে যাই। একটি নারকেল গাছ বেয়ে বেয়ে আমি উঠতে থাকি। গাছটিকে জড়িয়ে ধরতেই আমার কেমন যেনো লাগে, একটু ওপরে উঠতেই আমার ভালো লাগতে থাকে গাছটিকে জড়িয়ে ধরে থাকতে, আমি খুব কোমলভাবে গাছটিকে জড়িয়ে ধরি, কোমলভাবে একটু একটু করে ওপরের দিকে উঠি, গাছটিকে। আমার আর গাছ মনে হয় না, বিলকিস মনে হয় কদবান মনে হয় তিনু আপা মনে হয়, আমি চোখে জ্বলজ্বলে অন্ধকার দেখতে থাকি, আমার সমগ্র জগত অন্ধকার হয়ে ওঠে, আমার তীব্র আলিঙ্গনে গাছটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আমি গাছটিকে জড়িয়ে ধরে। গাছের গায়েই যেনো ঘুমিয়ে পড়ি। একবার পদ্মার পারে বিকেলবেলা গিয়ে দাঁড়াই। আমি। আমার পেছনে নারকেল গাছের সারি, আমার পায়ের নিচে কোমল বেলেমাটি, দূরে নদীতে ছোটো ছোটো নৌকো ভাসছে-জেলেরা ইলিশ ধরছে। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে। দেখি পদ্মার জল গলানো সিঁদুরের মতো হয়ে গেছে, পশ্চিমের আকাশ ছুঁয়ে সিঁদুরের ঢেউ উঠছে; সেই সিঁদুরগোলানো পানির ঢেউ লেগে পশ্চিমের আকাশ ভিজে গেছে, আমি ভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠি। আমার লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় পশ্চিমের আকাশের পানিতে, ওই পানির সমস্ত সৌন্দর্য মাংস দিয়ে অনুভব করার। তীব্রতা বোধ করি আমি, কিন্তু বুঝতে পারি কোনো কিছুই চরমভাবে অনুভব করার শক্তি আমার শরীরের নেই, তখন আমি নারকেল গাছের শেকড়ের ওপর বসে পড়ি; পদ্মার পশ্চিম পারের মতো রঙিন মধু ঝরতে থাকে আমার রক্ত আর মাংস থেকে।
সোনামতির প্যাট অইছে, খবরটা মাকে দিচ্ছিলো কালার মা; আমি পাশের ঘর থেকে শুনছিলাম।
তুমি শুনলা কার কাছে? মা জিজ্ঞেস করলো।
চৈদ্দগ্রামের কে না জানে, কালার মা বলছিলো, বাইরে ত এই কিচ্ছায় কান পাতন যায় না।
কে এই কাম করল? মা জিজ্ঞেস করে।
কে আর করব, ইদ্রিসসা জোয়াইনকাই করছে, কালার মা বলে, অই ভাদাইমা ছাড়া আর কে করব।
কালার মা খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছে; পাড়া থেকে পাড়ায় ছড়ানোর মতো একটি ঘটনা সে পেয়ে গেছে, পেয়ে খুব তৃপ্তি পাচ্ছে; কিন্তু আমি কোনো চঞ্চলতা বোধ করছি না, শুধু সোনামতি আপার মুখটা আমার মনে পড়ছে, যাকে আমি মুখোমুখি আপাই বলি, আর মনে পড়ছে ইদ্রিসদার মুখটাও। তারা দুজনে মিলে একটা খুব খারাপ কাজ করে ফেলেছে, আমি বুঝতে পারি, বিয়ে না করে এমন কাজ করা তাদের ঠিক হয় নি। সোনামতি আপাদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে, কলাপুরিনারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা, আর তার পাশেই, একটি ছোটো খালের পাড়ে, ইদ্রিসদাদের বাড়ি, সেটিও ঘেরা কলাপুরিনারকেল গাছ দিয়ে। অনেক দিন তাদের বাড়ি আমি যাই নি, আজ বিকেলে একবার যাবো। সোনামতি আপা আর ইদ্রিসদা একটা খুব খারাপ কাজ করেছে। খুব খারাপ কাজ করেছে তারা?, আমার মনে এমন একটি প্রশ্ন আসছে, অনেকক্ষণ ধরে প্রশ্নটিকে আমি তাড়াতে পারছি না। আমাদের গ্রামের কে কে এমন। খারাপ কাজ করতে রাজি নয়? সোনামতি আপা রাজি হলে কে কে এমন কাজ করতো না? তারপর পালিয়ে যেতো না? বিকেলে আমি সোনামতি আপাদের বাড়ি গিয়ে দেখি তিনি দক্ষিণের ঘরে তার মায়ের পাশে বসে আছেন। তার মা খুব অসুস্থ, বাঁচবে না। আমাকে দেখে বিষণ্ণভাবে হাসলেন সোনামতি আপা; আমার চোখে পড়লো বেশ বড়ো পেট হয়েছে তাঁর। দাঁড়াতে তার কষ্টই হচ্ছিলো। তখন ইদ্রিসদা এলেন। আমাকে তিনি দেখতেও পেলেন না যেনো, পাগলের মতো লাগছিলো তাকে; তিনি, চিৎকার করছিলেন, গ্রামের যেই শালারপোই যেই কথা কউক না ক্যান, আমি সোনামতিরে বিয়া করুমই। ইদ্রিসদা পালিয়ে যায় নি দেখে ভালো লাগলো আমার।
বিচার হবে সোনামতি আপা আর ইদ্রিসদার;–বিচার আমি দেখতে পাবো না, ছোটোদের ওই বিচারে থাকতে দেয়া হবে না। আমার খুব ইচ্ছে বিচার দেখার; মকবুল আর হান্নানেরও খুব ইচ্ছে। ওরাই আমার কাছে প্রস্তাবটি নিয়ে আসে। বিচার হবে। সোনামতি আপাদের উঠোনে, সন্ধ্যার পর; উঠোনের পাশে রয়েছে রান্নাঘর, আমরা চুপ করে রান্নাঘরের বেড়ার আড়ালে লুকিয়ে বিচার দেখতে পারবো। কোনো শব্দ না করলেই চলবে, বড়োরা আমাদের খেয়ালও করবে না, তারা ব্যস্ত থাকবে বিচার নিয়ে। বিচার পেলে বড়োদের আর কোনোদিকে খেয়াল থাকে না। ওই বড়োদের অনেককেই। আমরা তখনই বড়ো বলে বিশেষ মান্যগণ্য করছি না; তাদের দেখলে যদিও সালাম। দিই, আড়ালে অনেককে ছাগল, পাগল, মুরগিচোরা, টাউট বলতে শুরু করেছি। যেমন তোতাখা আর কফিল মাতবরকে বছরখানেক ধরে আমরা সালাম দিই না, পথে দেখা হলে মাথা নিচু করে অন্য দিকে চলে যাই। কিন্তু তোতাখা আর কফিল মাতবর মাঝেমাঝে আমাদের ডাকে।