আমাগো দেশের এইখানে সেইখানে পশু না জিন না রাক্ষস না স্কন্ধনাইয়া না শয়তান না কিসের যেনো উৎপাত শুরু হইছে।
কিসের যে উৎপাত আমরা বুঝতে পারি না।
ওই আজব জিনিশগুলো খুবই রহস্যজনক, আমরা দেখতে পাই না, নীরবে নিঃশব্দে চলে যাওয়ার পর বিকট গন্ধ পাই, বিশ্রী গভীর পায়ের দাগ পাই, আর পড়ে থাকে তাদের ধ্বংসলীলার চিহ্ন।
অনেক সময় গন্ধেই আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে।
পার্বতীপুরে এক সন্ধ্যায় বিকট গন্ধে লোকজন পাগল হয়ে ওঠে। এইপাশে ধানক্ষেত আর ওইপাশে রেলের ইঞ্জিনের গন্ধেই তারা অভ্যস্ত ছিলো, ওই গন্ধ তাদের নিজেদের শরীরের গন্ধের মতো মধুর লাগতো, কিন্তু হঠাৎ অন্য রকম গন্ধে তারা আঁৎকে ওঠে। রাস্তায় ছিলো যারা মাঠে ছিলো যারা বাজারে ছিলো যারা রেলস্টেশনে ছিলো যারা তারা প্রথম গন্ধ পেয়ে দৌড়ে বাসায় ফিরতে থাকে, বাইরে থাকতে পারে না। বাসায় ফিরে সব দরোজা জানালা বন্ধ করে দেয়, ছিদ্রে ছিদ্রে তুলো ছেঁড়া কাপড় চট আর আর যা পায় ঢুকোতে থাকে, কিন্তু গন্ধ বন্ধ হয় না, চড়চড় করে গন্ধ ঢুকতে থাকে। তারা নাক চেপে বিছানায় মাটিতে সারারাত পড়ে থাকে, ব্যথায় নাক ফুলে ওঠে। সকালের দিকে দেখে কোনো গন্ধ নেই।
সবাই রাস্তাঘাটে বলাবলি করতে থাকে, রাইতভর কিসের গন্ধ পাইলাম?
কেউ ওই গন্ধের পরিচয় জানে না।
কেউ কেউ বলে, কোনো নতুন পশুর গন্ধ হইব। অই পশু আমরা কোনো দিন দেখি নাই।
কেউ কেউ বলে, আমাগো বাড়ির পিছনে একটা পায়ের দাগ দ্যাকলাম, এমন দাগ আগে দেখি নাই।
কেউ বলে, ইরিখেতে গিয়া দ্যাখলাম একটা প্যাচাইনা দাগ, খুড় আধ হাত মাটিতে ঢুইক্যা গ্যাছে।
এইটা কি কোনো পশুর পায়ে দাগ? কেউ জানে না।
এমন প্যাঁচাইনা আর গভীর কোন পশুর খুড়? কেউ জানে না।
এইটা কি জিন? রাক্ষস? শয়তান? কেউ জানে না।
তারা পুকুরপাড়ে ধানক্ষেতে মাঠে বাড়ির পেছনে পশু না জিন না রাক্ষস না। স্কন্ধনাইয়া না শয়তান না কিসের যেনো অদ্ভুত পায়ের দাগ দেখতে পায়, যেমন পায়ের দাগ আগে তারা দেখে নি।
শিক্ৰামপুরে আসে একটা অদ্ভুত পশু, তার স্বভাব অদ্ভুতভাবে অন্য রকম।
পশুটা রাতের বেলা আসে, কখন আসে কেউ দেখতে পায় না, রাতে সবার গভীর ঘুম পায়, একটা পাখিও জেগে থাকে না; ঘুমের মধ্যে শিক্রামপুরের মানুষ সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখে, সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখে শোচনীয় দৃশ্য।
পশুটার কাজ পুরোনো কবর ভেঙে লাশের হাড়গোড় খাওয়া। ওটি পুরোনো হাড়গোড় খেতেই বেশি পছন্দ করে। তারা জানে শেয়াল কবরে আসে নতুন লাশ খেতে, কিন্তু এই পশুটা অন্যরকম; যে-সব কবর বিশ পঞ্চাশ দশ পাঁচ বছরের পুরোনো, যে-সব কবরের কথা প্রিয়জনেরাও ভুলে গেছে, পশুটা সে-সব কবর খুঁড়ে তুলে আনে হাড়গোড়, রাতভর খায়, কিছু হাড় ফেলে রেখে যায়। সকালে লোকজন উঠে দেখে কয়েকটি কবরের পাশে পড়ে আছে পুরোনো অপরিচিত হাড়গোড়।
লোকজন ভয় পায়, যে-প্রিয়জনদের তারা ভুলে গেছে, তাদের জন্যে বেদনা জেগে ওঠে তাদের মনে; কিন্তু তারা কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।
তারা নানা রকম খতম পড়ায়, কিন্তু পশুটা তার কাজ করে যেতে থাকে।
রসুল্লাগঞ্জের জনগণ একরাতে আক্রান্ত হয় ভয়ঙ্করভাবে।
সন্ধ্যার কাজকর্ম শেষ করে খেয়ে তারা শোয়ার আয়োজন করছে, স্বামীস্ত্রীরা ছোটোখাটো ঝগড়াঝাটিগুলো মিটিয়ে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় তারা ভালুকের প্রচণ্ড গর্জনের শব্দ শুনতে পায়। ভালুকের গর্জনে ও গন্ধে তারা প্রথম ভয় পেয়ে যায়, এবং বিস্মিত হয় যে তাদের পল্লীতে ভাল্লুক আসার কথা নয়, কয়েক শো মাইলের মধ্যে কোনো বন নেই, ভাল্লুক এলো কোথা থেকে? একটা বাড়ি থেকে আর্ত চিৎকার উঠলে তারা বুঝতে পারে ওই বাড়িটা আক্রান্ত হয়েছে; তারা শরকি বর্শা ট্যাটা উঁতি যার যা ছিলো, সে-সব নিয়ে বেরিয়ে ওই বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে।
তারা এগোতে পারে না। পঞ্চাশটির মতো বিশাল বিকট লোমশ ভালুকের মুখোমুখি তাদের সমস্ত সাহস শক্তি শরকি বর্শা ট্যাটা উঁতি নিষ্ক্রিয় হয়ে ওঠে, তারা আক্রান্ত হতে থাকে, ভাল্লুকগুলো তাদের থাবায় তুলে তুলে ছিঁড়েফেড়ে ফেলতে থাকে। ঘন্টাখানেক ধরে সন্ত্রাস আর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ভাল্লুকগুলো দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। লাশের পর লাশ পড়ে থাকে রসুল্লাগঞ্জ জুড়ে, সারা গ্রাম গোঙাতে থাকে কাঁদতে থাকে। সারা গ্রাম মরে যায়।
একরাতে বাঘ পড়ে আমাদের সারা দেশ জুড়ে।
সুন্দরবন না কোন বন থেকে দলে দলে নেমে আসতে থাকে ডোরাকাটা হলদে চকচকে প্রচণ্ড হিংস্র ভয়াবহ বাঘেরা, তারা ঢুকতে থাকে আমাদের পল্লীতে, নগরে, শহরে। তারা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসে, ধানক্ষেত পাটক্ষেত সরষে আলু ক্ষেতের ওপর দিয়ে আসে, আমাদের আলপথ, রাজপথ, পুকুরপাড়ের পথ দিয়ে আসে, তারা নদী সাতরে আসে, বিলের জলাভূমির ওপর দিয়ে আসে, পুকুর খাল পার হয়ে আসে, বাঁশের পুলের ওপর দিয়ে, লোহার সেতুর ওপর দিয়ে তারা আসতে থাকে, দলে দলে আসতে থাকে। আমরা তখন ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন গভীর রজনী নেমেছে, কোনো কোলাহল নেই, তখন বাঘেরা আসে। আমরা কখনো প্রস্তুত নই, প্রস্তুত হওয়ার কিছু ছিলো না। আমরা প্রথম তাদের গায়ের গন্ধ পাই, অজস্র বাঘের গায়ের বন্য আদিম রক্তমাখা গন্ধে আমাদের দেশ বমি করে ফেলতে চায়, আমরা বমি করে ফেলতে থাকি; তারপর আমরা তাদের পায়ের শব্দ পাই, আমাদের মনে হতে থাকে ক্রমশ মৃত্যু এগিয়ে আসছে। আমাদের দিকে, মৃত্যুর পায়ের শব্দে আমরা কুঁকড়ে যাই, আমাদের গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না; তারপর তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে, তাদের মুখ দেখে নখ দেখে দাঁত দেখে থাবা দেখে আমরা আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। আমরা বল্লম শরকি জুতি ট্যাটা কোচের কথা মনে করতে পারি না, আমাদের মনে হতে থাকে বাঘের কাছে নিজেদের সঁপে দিলেই আমরা বাচবো, আমরা বাঘদের শিকার, আমরা বাঘদের খাদ্য। আমাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে, আমরা গেঁথে থাকি তাদের দাঁতে, ঝুলতে থাকি, তারা আমাদের ছিঁড়তে থাকে চাটতে থাকে। হঠাৎ আমরা বাঘেদের বিকট মুখে কাদের যেনো মুখ দেখতে পাই, মুখগুলোকে চিনি আমরা, অনেকখানি চিনি, আবার মনে হয় চিনি না, অনেকখানি চিনি না। বাঘেদের মুখ থেকে মাঝেমাঝে মুখোশ সরে যেতে থাকে, মুখগুলোকে আমরা চিনি মনে হয়, তাদের দাঁত দেখি, দাতে রক্ত দেখি, কষ বেয়ে রক্ত ঝরতে দেখি, জিভ দিয়ে কষ চাটতে দেখি। তাদের মুখে দাঁতে কষে টসটসে রক্ত দেখি। ওই রক্ত কাদের? ওই রক্ত আমাদের রক্তের মতো লাল আর গরম। রক্তের দিকে তাকিয়ে আমরা হাহাকার করে উঠি।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো