ক্যাডাররা সিগারেট টানতে টানতে নিজ নিজ শিবিরে ফিরে গিয়ে দেখে তাদের নেতারা খুব উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করছেন। নেতাগুলো কাটা চালাতে পারে না, পারে শুধু মিছে মিছে বক্তৃতা দিতে আর উত্তেজনায় টান টান থাকতো। তারা থানার নেতা, দেশেরও নেতা; ইলেকশনের আগে তাই তাদের উত্তেজনা স্বাভাবিক। ক্যাডাররা ঠাণ্ডা, ধীরস্থির, বরফের মতো প্রশান্ত, আর ভয়াবহ।
এক বংশের থানা-নেতা জিজ্ঞেস করেন, খবর কি, শোনলাম একটা লাছ পরছে? ঘটনা কি বুঝাই কও।
বেন্সন টানতে টানতে এক ক্যাডার বলে, হ, পরছে একটা, মাতায় গুলি লাগছে মনে হইতাছে। ফুরাই গ্যাছে লাগতেছে।
থানা-নেতা জিজ্ঞেস করেন, লাছটা কই, লাছটা আনলা না?
ক্যাডার বলে, লাছ দিয়া কি করুম? লাছ ত আনতে কন নাই।
থানা-নেতা বলেন, তোমরা করছো কি? একটা অ্যাছেট ফেইল্যা আসছে। ইলেকশনের আগে এমুন অ্যাছেট আর পামু কই?
ক্যাডার বলে, লাছ ত পুলিশভাইগো প্রপার্টি, সেইজইন্য রাইখ্যা আসলাম।
জ্যাকেটে রক্ত লাগাইতে ইচ্ছা হইল না।
থানা-নেতা বলেন, ইলেকশনের আগে একটা লাছ পাওন ভাইগ্যের কথা, অইটা আমাগো লাছ, আল্লায় দিছে। যাও, বাবারা, তরাতরি যাও, পোলাটার নামের লগে শহিদ আর জিন্দাবাদ লাগাইয়া শ্লোগান দিতে দিতে লাছটা লইয়া আসো। একটা শহিদ আমাগো দরকার।
ক্যাডাররা শ্লোগান দিতে দিতে লাশ কুড়োতে চলে যায়।
আরেক বংশের থানা-নেতা জিজ্ঞেস করেন, ইদ্রিস মোল্লার পোলাটা নাকি মাথায় গুল্লি লাইগ্যা পইর্যা গেছে?
বেন্সন টানতে টানতে এক ক্যাডার বলে, কার পোলা তা ত জানি না, তয় পোলাডার নাম শুনছি সিদ্দিক।
থানা-নেতা বলেন, সিদ্দিক এখন শহিদ সিদ্দিক, সে আমাগো দলের, তার রক্ত বৃথা যাইতে দেওন যায় না।
ক্যাডার বলে, অই ছামরারে কোনো দিন দলে দেখি নাই, শুনছি ক্লাশে ফাস্ট হইত। এই মাল দিয়া দলের কোনো গেইন নাই।
থানা-নেতা বলেন, সে ব্রিলিয়েন্ট ছাত্র, সিদ্দিক এখন শহিদ, তার লাছটা লইয়া আসো। বাবারা, যাও, শহিদ সিদ্দিক জিন্দাবাদ, শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না, সিদ্দিকের রক্তে গণতন্ত্র আনবো বইল্যা শ্লোগান দিতে দিতে যাও, তার লাশ লইয়া মিছিল করুম। বিকালে জনসভা করুম। ফাস্ট বয়ের লাশটা এখন খুব কামে লাগবো। ইলেকশনের আগে একটা শহিদ পাওন ভাইগ্য।
এক ক্যাডার বলে, বাইচ্যা থাকনের সময় মনে হইত ও কোনো কামে লাগবো না, এখন দেখতেছি অর লাছটা কামে লাগবো।
শহিদ সিদ্দিক জিন্দাবাদ, সিদ্দিকের রক্তে গণতন্ত্র আনবো, শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না শ্লোগান দিতে দিতে ক্যাডাররা শহিদ সিদ্দিকের লাশ আনতে যায়।
লাশ তাদের চাই, একটি শহিদ তাদের দরকার।
আবার কাটারাইফেল ফুটান শুরু হয়।
লাশ একটা হয়েই অসুবিধা হয়েছে, আরেকটা লাশ পড়ন উচিত আছিল; তাইলে দুই রাজবংশ দুটি অমর শহিদ পেতো, ভোটের বাক্সে ব্যালেন্স আসতো, ড্যামোক্রেসি থাকতো। লাশ একটা, অতিশয় মূল্যবান লাশ, তার মালিক দুই দল। ওই লাশ বোঝাই ভোটে লাশের উপর ড্যামোক্রেসির সিংগাসন।
রাজবংশগুলো এখন দেশ দখল করতে বেরিয়ে পড়েছেন।
মনে হচ্ছে মঙ্গোলিয়া উজবেকিস্থান কাজাকিস্থান মেসোপটামিয়া আরাবিয়া আফগানিস্থান খোরাশান বদকশান ইরান তুরান থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে তলোয়ার উঁচিয়ে গলা কাটতে কাটতে ছুটে আসছে প্রচণ্ড বীরেরা, চেঙ্গিশ হালাকু খানেরা, বিন কাশেম বখতিয়ার খিলজি তারিক খালেদরা; তবে এইটা আমাগো ভুল, দশ বারো শো বচ্ছর ধইর্যা ঘোম না হইতে হইতে চোখ ভইর্যা দুঃস্বপ্ন দ্যাখতে দ্যাখতে রাইতের বেলা দিনের বেলা মার মার কাট কাট শোনতে শোনতে আমরা এখন ঠিকটা দেখতে পাই না, ঠিকের ছায়াটা দেখি, মানুষ না দেখে তার প্রেতটা দেখি। এইটা আমাগো অসুখ। চোখ আর মগজ খারাপ হয়ে গেছে বইল্যা সত্য না দেখে মিথ্যা দেখি। যারা নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ইলেকশনের ক্যাম্পেইনে বাইর হয়ে পড়ছেন, তাঁরা কেউ অইসব দ্যাশ থিকা আসেন নাই, তাঁরা আমাগোই মানুষ, আমাগোই রাজপুরুষ, আমাগো পুকুরেরই পানি খান, আমাগো ধানেরই ভাত খান, তাগো দয়ার শরীর, তাঁরা জনসভার পর জনসভা মিটিংয়ের পর মিটিং করে আমাগো ভালোবাসা জানাইতেছেন, দ্যাশের সঙ্গে তারা প্রেম করতেছেন, তাঁরা ঘুমাইতে পারতেছেন না আর আমাগোও ঘূমাইতে দিতেছেন না; এইবার মরন বাঁচনের ইলেকশন। এইবার কিয়ামত ঘনাইয়া আসছে দ্যাশ ভইর্যা।
রাস্তায় রাস্তায় পথে ঘাটে মিটিংয়ে মিটিংয়ে জনসভায় জনসভায় খাঁটি প্রকত সেন্ট পার্সেন্ট মোলো আনা নির্ভেজাল নিশ্চিত বিশুদ্ধ আসল সাচ্চা ইমানদার মমিন মুসলমান দেখতে পাইতেছি আমরা। এতো আর একসঙ্গে কোনো কালে দেখি নাই, আমাগো পাপী বাবারা দেখে নাই পাপী দাদারা দেখে নাই। সাতশো বছর আগে দেখি নাই। তিনশো বছর আগে দেখি নাই একশো বছর আগে দেখি নাই মুগলগো আমলে দেখি নাই ইংরাজের রাজে দেখি নাই, যখন কালা কিস্তি টুপি মাথায় দিয়া ‘পাক সরজমিন সাদবাদ তুনিশানে আজমে আলিশানে’ মুখ দইয়ের মতন ফেনায় ভরে তুলতাম, তখনও দেখি নাই। আমাদের সব রাজপুরুষরা বড়ো বড়ো পরহেজগার মমিন মুসলমান সেজে মুখে আর বুকে আর মাথায় ইসলাম নিয়া ড্যামোক্রেসির ইলেকশনের ক্যাম্পেইনে নামছেন, লগে লগে আমরাও নামছি; মনে হইছে ইসলাম এত শ বছর পর খাঁটি অনুসারী পাইয়া জিন্দা হইয়া উঠছে, আমরাও জিন্দা হচ্ছি। ইসলামের এমন সুদিন আর আসে নাই, অন্যরা আনে নাই, আমাগো রাজারা আনছে, আমরা আনছি। রিলিজিয়নটা এই দ্যাশে নতুন কইর্যা পোরচার হচ্ছে; আগে ঠিক মতন হয় নাই, এইবার পোক্ত করা হচ্ছে। শুনছি ঠ্যাকলে নাকি শয়তান সবচাইতে বেশি কইর্যা আল্লার নাম লয়, মোখ থিকা অই নাম সরে না, আমরা সেইটা আমাগো চোখে দেখতে পাইতেছি। ভাত চাই না আমরা, ভাত খাইয়া বাইচ্যা থাইক্যা কি হয়; কাপড় চাই না আমরা, কাপড় পইর্যা কি সুখ, না পড়লে কি হয়; ইস্কুল চাই না আমরা, ইস্কুল দিয়া কোন খাট্টা হয়; হাসপাতাল চাই না আমরা, হাসপাতালে গিয়া বাইচ্যা থেকে গুনা বাড়াইয়া খালি দোজগের পথ বাড়ে; চাকরি চাই না আমরা, সৌদি গিয়া চাকর খাটলেই চলবো; কিছু চাই না আমরা; খালি তারে চাই; নিজেগো লিগা ঘর চাই না আমরা, তার লিগা ঘর বানাইলেই হইব।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো