ইস্কুলে পড়নের কালে আমাগো বাঁশমওলানা সাব (তিনি একটা মোটা বড়ুরা বাঁশের আট হাতি লাঠি হাতে লইয়া আসতেন, মাটিতে ঢুশঢাশ শব্দ হইত, আমরা তারে বাশমওলানা সাব বলতাম) একটা মছল্লা বলছিলেন, সেইটা আমাগো মনে পড়তেছে। এক শহরে এক পরহেজগার বান্দা আছিলেন, তিনি দিনে পাঁচবার মক্কাশরিফ যাইয়া নামাজ পড়ে আসতেন, সবাই তাকে ধন্য ধন্য করতো।
তাঁর একটা জিন আছিল, জিনটা তারে লইয়া যাইতে লইয়া আসতো।
জিনটা একদিন তারে মহাসাগরের এক দ্বীপে নিয়া আটকাইয়া বলে, কেয়ামত পর্যন্ত আমি তোমার গোলাম হয়ে থাকবো, তবে আইজ আমারে সেজদা করো, নাইলে এই মহাসাগরের মইধ্যে তোমারে একলা ফেইল্যা যাবো।
জান বাঁচানের জইন্যে ওই পরহেজগার জিনরে সেজদা করেন (হায়, হায়, তিনি কী করেন), জিন তার গোলাম হইয়া থাকে, পরহেজগার সাহেব জিনের কান্ধে চইর্যা পাঁচবার মক্কাশরিফ যাইয়া আইস্যা নামাজ পড়তে থাকেন। কিন্তু যা হইবার তা হইয়া গেছে, জিনরে সেজদা করায় তার সব শ্যাষ হইয়া গেছে।
তাঁর মাবুদ দুইটা, জিনটাও তাঁর মাবুদ। আমাগো তাগো মাবুদ কয়টা?
ওমরা করনের জইন্যে জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের মহাজননেত্রী মক্কার উদ্দেশে ষাইটসত্তরজন লইয়া রওনা হইয়া গেলেন (এইবার পাওয়ারে যাইতে হইবো, এইবার পাওয়ারে যাইতে হইবো, আল্লা, আমাগো পাওয়ারে বসাও), আমরা তার মাথা দেখতে পাইলাম না, মাথার চুলে শয়তান থাকে, চুল ঢাইক্যা রাখতে হয়, মুখের একটুখানি মাত্র দেখলাম, মনে হইল ফেরেশতারা যাইতেছেন। তাঁরা সবাই ফিইর্যা আসলেন আরো বড়ো ফেরেশতা হইয়া, পোশাক বদলাইয়া, মরুভূমি হইয়া, হাতে তসবি লইয়া। তসবি টিপতে টিপতে তাঁরা কী বলেন, আমরা শোনতে পাই না (এইবার পাওয়ারে যাইতে হইবো, এইবার পাওয়ারে যাইতে হইবো, আল্লা, আমাগো পাওয়ারে বসাও)।
শক্তির উৎসবংশের মহাদেশনেত্রী আশিনব্বইজন লইয়া পবিত্র ওমরা করনের জইন্যে মক্কার উদ্দেশে রওনা হইয়া গেলেন (পাওয়ারে ফিরা যাইতে হইবো, পাওয়ারে ফিরা যাইতে হইবো, পাওয়ার ছারা বাচবো না, আল্লা, পাওয়ার দেও), তার পোশাক দেইখ্যাও আমরা তাজ্জব হইলাম, তার বিউটিশিয়ানরা ভালো মেকাপ দিয়াছে, শয়তান ঢোকনের পথ নাই, রিলিজিয়ন, পলিটিক্স ও স্টাইলরে সুন্দরভাবে মিলাইয়া দিয়াছে, আমরা তাঁর মুখ দ্যাখতে পাইলাম না, তবে যতটুকু দ্যাখলাম, তাতে ধর্মের দাগ দেইখ্যা খুশি হইলাম। তাঁর তসবি দেখা যায় না, তাঁরা কী বলেন শোনা যায় না (পাওয়ারে ফির্যা যাইতে হইবো, পাওয়ারে ফিরা যাইতে হইবো, পাওয়ার ছারা বাচবো না, আল্লা, পাওয়ার দেও)।
এই সময় হঠাৎ খুন হয়ে গেলো চৌদ্দগ্রামের ভালো ছেলেটি, যে রাজনীতির মতো ভালো কাজে কখনো ছিলো না বলেই জানতাম। সে ক্লাশে ফার্স্ট সেকেন্ড হতো, এইটা খুবই খারাপ, ফার্স্ট সেকেন্ড হলে কেউ পলিটিক্স করে না, পড়ে পড়ে নিজেকে নষ্ট করে, পলিটিক্স করলে কেউ ফার্স্ট সেকেন্ড হয় না, হওয়ার দরকার পড়ে না। তার বাবাটি গরিব, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মা আর বাবা একটু সুখ পেতো। সুখটুখ পাওয়া ঠিক নয়, একটু দুঃখে থাকা দরকার মানুষের, আর এই দুঃখের দেশে আবার সুখ কী; সে ইস্কুল থেকে ফেরার পথে খুন হয়ে গেলো। এটা তার দোষ, তাকে খুন করার কারো ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু সে খুন হয়ে গেছে। দু-চারটা খুন না হলে ইলেকশন জমে না। চৌরাস্তায় একটু গোলমাল হয়েছিলো, গোলমালটা চলছিলো দুই বড়ো রাজবংশের ক্যাডারদের মধ্যে, তখন ছেলেটি সেখান দিয়ে আসছিলো, বেশি নয়, কাটারাইফেলের একটা গুল্লি এসে তার মাথায় লাগে। ছেলেটি পড়ে যায়, তাকে কেউ টেনে তোলে না, হাসপাতালে পাঠায় না; পাঠালেও কোনো লাভ ছিলো, ডাক্তাররা কেউ ছিলেন না, তারা সবাই ঢাকায় প্র্যাকটিস করছিলেন। ছেলেটি মারা যায়। এটা কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়, গুলিটুলি লেগে মৃত্যু আমাদের দেশে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
আমরা আগে বুঝতে পারি নি যে গরিবগর্বার ওই ছেলেটি শহিদ অমর হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলো। কিছুক্ষণ পরই আমরা জানতে পারি ছেলেটি শহিদ ও অমর; তার রক্ত দামি, তার রক্তের কণায় কণায় পলিটিক্স।
সে উল্টেপাল্টে পড়ে গেলে আরো কিছুক্ষণ ফাটিয়ে ফুটিয়ে ঝাঁপিয়ে নড়িয়ে চারপাশ বন্ধ স্তব্ধ করে বীর ক্যাডাররা চলে যায়। একটা পড়ে গেছে, ফেলার ইচ্ছে তাদের ছিলো না, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের আগে তারা রক্ত ফেলতে চায় নি, কিন্তু পড়ে গেছে, এটা তাদের দোষ নয়। তাদের দোষ দিতে পারি না, তারা ছেলেটিকে খুন করতে চায় নি, ছেলেটিই খুন হওয়ার জন্যে সেখানে গিয়ে পড়েছিলো, ওর ভাগ্য খারাপ বা ভালো। ধর্মে আমরা বিশ্বাস করি, বরাতে বিশ্বাস করি, তার জন্যে সারা রাত জেগে থেকে কতো সোনাদানা চাই, পরের বছরই সেই সব সোনাদানায় আমাদের ঘররাড়ি ভরে ওঠে, রাখনের জায়গা পাই না, সেই স্বর্গীয় বিশ্বাস থেকে বলতে পারি আমরা দুঃখ করতে পারি না, আল্লা এটা তার নামে লিখে রেখেছিলো, তাই গুলি লেগে সে মরেছে। না মরলেই বরং বিশ্বাসে গোলমাল দেখা দিতো। ক্যাডারদের কোনো দোষ নেই, কাটারাইফেল তারা চালিয়েছিলো সেটা তাদের নামে লেখা ছিলো। মানুষের করার কিছু নেই, তিনি যা করান মানুষ তাই করে। তাই কাউকে দোষ দিতে পারি না।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো