পাথর বোঝাই একটি ট্রাক এসে সেখানে থামে। ট্রাক থেকে পাথর নামিয়ে এক জায়গায় স্থূপ করে রাখা হয়। ধন্য পাথরের টুকরো। যে-লোকটি সারার অপরাধের বিবরণ পড়েছিলো, সে জনতাকে পাথর ছোঁড়া শুরু করতে বলে।
জনতা সমস্ত প্রশংসাপ্রাপকের প্রশংসা করতে করতে পাথরের স্তূপের দিকে তীব্র বেগে ছুটে যায়।
এই পুণ্যের জন্যে তারা এতো মাস ধরে আর এতক্ষণ রোদের ভেতরে অধীর হয়ে। অপেক্ষা করছিলো, তারা পাথরের পর পাথর নিয়ে সারার দিকে ছুঁড়তে শুরু করে। সমস্ত প্রশংসা প্রশংসাপ্রাপকের। চার দিকে থেকে পাথর এসে লাগতে থাকে সারার মুখে মাথায় শরীরে, পাথরের ঘায়ে সারা এদিক সেদিক দুলতে থাকে, শেষে বালুর ওপর লুটিয়ে পড়ে।
সারাকে একটানা পাথর মারা হয় না। এইটা ত আর মইধ্যযুগ না, আইয়ামে জাহেলিয়া না, এইটা হইল আধুনিক যুগ (তয় মনে হয় ওইখান থিকা আইয়ামে জাহেলিয়া দূর হয় নাই, আরো জমা হইতেছে), মরুভূমিতেও একটু মানবতা আছে, তাই মাঝেমাঝে পাথর ছোঁড়া বন্ধ করা হয়, আমরিকার কায়দায় একজন ডাক্তার পরীক্ষা করে সে বেঁচে আছে কি না। সারা পাঁচ মিনিটে মরে গেলেই ভালো হইত, কিন্তু মাইয়ামানুষ সহজে মরতে চায় না; প্যাটলিরা পাথরের থেকেও শক্ত, পাথরের থেকেও প্রাণহীন, তাগো জন্মের সময় প্রাণই দেয়া হয় নাই, জানই দেয়া হয় নাই, তাই মরবো কেমনে? তাগো মারনের জইন্যে পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুরুষপোলাগো জান বাইর হইয়া যাইতেছে।
প্রথমবার ডাক্তার দেখে সারা মরে নাই। জনতা প্রশংসাপ্রাপককের প্রশংসা করে আবার পাথর ছুঁড়তে শুরু করে।
দয়াশীলেরা আবার পাথর ছোঁড়া বন্ধ করে, ডাক্তার সারার নাড়ি পরীক্ষা করে দেখে। না, সারা মরে নাই, পুইত্যা না ফেললে বোধ হয় মরবো না। খালাশের সময়ই বালিতে পুইত্যা ফেলা দরকার আছিল এইটারে।
আবার শুরু হয় পাথর ছোঁড়া, সমস্ত প্রশংসা প্রাপ্য প্রশংসাপ্রাপকের।
তবু সারা মরে না। কিন্তু এতো বিকট পাথরের মুখোমুখি কতক্ষণ টিকবে এই ভঙ্গুর তুচ্ছ পাপিষ্ঠ নিষ্পাপ সুন্দর? এই ফিত্নাটা কতক্ষণ লড়াই করবে পুণ্যবান হিংস্র পাথরের সঙ্গে?
মরতে তাকে হবেই, পাথর তাকে ক্ষমা করবে না, হুদুদের কোনো মাফ নাই। পাথরের থেকে সে বেশি শক্তিমান নয়। পাথরের ক্রোধে সে নিশ্চয়ই নিশ্চিহ্ন হবে, সমস্ত প্রশংসা প্রাপ্য প্রশংসাপ্রাপকের।
ঘণ্টা দুয়েক পর ডাক্তার জানায় সারা মারা গেছে। সফল ধার্মিক পুণ্যশীলেরা পাথর ছোঁড়া বন্ধ করে।
সমস্ত প্রশংসা প্রাপ্য প্রশংসাপ্রাপকের।
পাপিষ্ঠাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে, ধর্ম রক্ষা পেয়েছে। রুব আল-খালির সমস্ত বালু পবিত্র হয়েছে।
মহাদেশনেত্রী ওমরা করতে গেছেন, সারার সংবাদ তিনি পান নি।
মহাদেশনেত্রী যখন ফিরে আসেন
মহাদেশনেত্রী যখন ফিরে আসেন তার অপরূপ রূপ দেখে আমরা মুগ্ধ হই। মাথা ঘিরে কী চমৎকার আবায়া পরেছেন, কোনো শয়তান ঢুকতে পারবে না চুলে, কাঁধের নিচ দিকে কী যেনো ঝুলিয়ে দিয়েছেন, আমরা গরিব জনগণ, ধর্ম হজ ওমরা জানি না, আল্লা আমাগো মাফ করবেন, এইসব পোশাক আশাক জানবো কেমনে? আমরা মুগ্ধ হই, শিউরে উঠি, ধর্মে ভাসতে আর ডুবতে থাকি, এবং বিপদে পড়ে যাই–কে বেশি ধার্মিক, মহাজননেত্রী না মহাদেশনেত্রী, কারে ভোট দিলে আল্লা খুশি হইব ড্যামোক্রেসি রক্ষা পাইব এইটা ঠিক করতে পারি না। মহাবিপদের মইধ্যে পইড়্যা যাই আমরা, বিপদে পড়নই ত আমাগো কাম, আমরা গরিব জনগণ; আমাগো মনে হইতে থাকে আমাগো কঠিন পরীক্ষা করনের জইন্যেই আল্লাতাল্লা দুইজনরে পাঠাইছেন, আমাগো বাইর করতে হইব কার ধর্ম বেশি, আর ভোট দিতে হইব সেইভাবে। আমাগো খালি পরীক্ষা দিতে হইব, হাশরের মাঠ পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে হইব–আমরা গরিব জনগণ।
শুরু হইছে রাজপুরুষগো ইন্টারভিউ, আর নমিনেশন দেওন।
দ্যাশ ভইর্যা আমরা পাগল হইয়া উঠছি এইটা দেখার জইন্যে যে জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশ কারে কারে নমিনেশন দেয়, আর শক্তির উৎসবাদী রাজবংশ নমিনেশন দেয় কারে কারে। রাজপুরুষেরা যখন নমিনেশন পাওয়ার জইন্যে দরখাস্ত করছিলেন, তখন আমরা গরিব পিপল হয়ে উঠেছিলাম পাগল পাগল, আর এখন নমিনেশন দেওনের আর পাওনের সময় আমরা হয়ে উঠি আস্ত পাগল। জনগণরে, আমাগো মতন গরিবগো, পাগল না করতে পারলে পলিটিক্স কিসের, ড্যামোক্রেসি হইছে আমাগো পাগল করনের মিঠা অমুদ, এমনভাবে খাওয়াইতে হয় যাতে আমরা পাগল হইয়া যাই, জিতলাম না ঠকলাম বুঝতে না পারি।
আমরা ত ভিতরের সব দেখি না, ছিটাফোঁটা শুনতে পাই, আর একেকজনের নমিনেশন পাওন দেখে ভাবতে থাকি কি হইছে ভিতরে। আমরা যেমন শুনছি তেমন বলতেছি; নিজের চোখে ত দেখি নাই, পরের মুখে শুনছি, দুই একটা ঘোড়ার মুখ থিকাও টুকরাটাকরি শুনছি।
জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ চলতেছে। ইন্টারভিউ নিতেছেন প্রধান রাজপুরুষেরা; মহাজননেত্রী আছেন মাঝখানে, তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে, রিলিজিয়ন আর পলিটিক্সের মিলন ঘটলে যেমন দেখায়, তেমন দেখাইতেছে, তারে ঘিরে আছেন আবদুর রহমান, কলিমউদ্দিন মৃধা, নিজামউদ্দিন আহমদ, রজ্জব আলি, আবদুল হাই সাহেব।
মহাজননেত্রী তসবি পড়তে পড়তে বলেন, বিসমিল্লাহের রহমানের রাহিম, আল্লার কাছে মুনাজাত করি তিনি আমাদের দিকে মুখ তুইল্যা চান।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো