বলেন চাচা, কী কী জিনিশ আমাগো দেখতে হইবো? জিজ্ঞেস করেন মহাজননেত্রী।
তার চোখের সামনে থেকে দূরে মিশে যেতে থাকে সিংহাসনটি।
আমি বোঝতে পারতাছি আমাগো ক্যান্ডিডেট খালি আমাগো দল হইতে লইলে চলবো না, চাচা বলেন, আমাগো কিছু আর্মির লোক দরকার, কয়টা রিটায়ার্ড জেনারেল ব্রিগেডিয়ার কর্নেল মেজর দরকার, অই পাড়াটা যাতে আমাদের লগে থাকে, জনগণরা যাতে বোঝে অই পাড়াটার লগে আমাদের গোলমাল নাই; আমাগো কয়টা আমলা দরকার, অরা আমাগো এইবার অনেক সাহায্য করছে আর অরাই কলকাঠি ঘুরায়; আমাগো কয়টা ব্যাংক ডিফল্টার দরকার–ট্যাকা তো লাগবো, আর কয়টা রাজাকার দরকার, অরা ইসলাম দেখবো; আর পারলে অন্য দল থেকে কয়টারে ভাগাইয়া আনন দরকার। আর মহাজননেত্রীর আত্মীয়স্বজনরাও থাকবেন। তাইলেই খালি আমরা ক্ষমতার মুখ দ্যাখতে পারুম।
ঠিক কথা বলতাছেন, চাচা, ঠিক কথা বলতাছেন, চাচা, বলেন মহাজননেত্রী, এবং সবাই। তাদের মনে হয় ক্ষমতায় যাওয়ার মূলসূত্র তারা পেয়ে গেছেন।
তবু তারা একবার কেঁপে ওঠে, তবু তারা সবাই উদ্বিগ্ন, তবু তাঁরা সবাই চিন্তিত; তাদের চোখেমুখে তা ধরা পড়ে। এর আগেও একবার তাদের মনে হয়েছিলো ক্ষমতা হাতের মুঠোয় এসে গেছে, দেশটা তাঁদের হয়ে গেছে; তারা সবাই ক্ষমতাসীন রাজবংশের মতো আচরণ করতে শুরু করেছিলেন; কিন্তু ভোটের পর দেখা যায় তারা নেই। জনগণের বিশ্বাসঘাতকতার কোনো শেষ নেই। তাই এবার সাবধান হতে হবে, সবগুলো প্যাঁচ ঠিকঠাক মতো দিতে হবে।
খালি নীতি লইয়া থাকলে হইবো না, বলেন এক রাজপুরুষ মোহাম্মদ আবদুল হাই, খালি স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর বাঙালি লইয়া থাকলে আমরা ক্ষমতায় যাইতে পারুম না। এইগুলির কথা আমাগো বলতে হবে কম কম, আর ইসলামের কথা বেশি বলতে হবে, এমনভাবে বলতে হবে যেনো আমরা মক্কা জয় করে এইমাত্র মদিনা থেকে ফিরলাম; ইসলাম ছাড়া আইজকাইল রাজনীতি নাই।
খোজারাজবংশ আর রাজাকার রাজবংশের লগেও আমাগো গোপন সম্পর্ক দরকার, নাইলে শক্তির উৎসওলারা তাগো ভাগাইয়া লইয়া যাইবো, বলেন কলিমউদ্দিন মৃধা, আর অগো লইয়া তো অনেক বচ্ছর আমরা আন্দোলন করছি, অগো আমাদের সঙ্গে রাখতে হবে। অগো আর রাজাকার স্বৈরাচার বইল্যা দূরে রাখন যাইবো না।
ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্রের নাম কেহ মোখেও আনবা না, বলেন মোহাম্মদ আবদুর রহমান, অইগুলিনই আমাগো ডুবাইছে; আমরা আর ডুইব্যা থাকতে চাই না।
এইবার আমাগো ধর্মেকর্মে মন দিতে হইবো, বলেন মোহাম্মদ রজ্জব আলি, মহাজননেত্রী আর কয়জনের ওমরা কইরা আসতে হইবো, অগো মতন বকতিতায় বকতিতায় আল্লা আর ইসলামের কথা বলতে হইবো, রাস্তায় রাস্তায় নমাজ পড়তে হইবো, মইধ্যে মইধ্যে জনগণের লিগা কানতে হইবো।
জনগণের জন্যে কাঁদতে গিয়ে মোহাম্মদ রজ্জব আলির নিজের জন্যে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। মোহাম্মদ রজ্জব আলি আরো বলেন, আল্লার নাম লইলে আল্লা আমাগো দিকে মোখ ফিরা চাইবো।
তারা সবাই একবার মনে মনে মোনাজাত পাঠ করেন। তারা জানেন আল্লা ছাড়া রাজনীতিতে কোনো ভরসা নেই।
এই ছাড়া আর আমাগো উপায় নাই, বলেন মোহাম্মদ আবদুর রহমান, অগো মতন ইসলামের নাম ভাঙ্গাইতেই হইবো, দ্যাশটা আসলে মুসলমানের এই কথা মনে রাখতে হইবো; অগো দেশনেত্রী কোনো দিন পশ্চিমে মাথা ঠ্যাকায় না, ব্যাংকক থেকে আইন্যা পাঁচটা বিউটিশিয়ান রাখে, কিন্তু দাঁড়াইলেই কয় ইসলাম; অগো জেনারেল আর আমলাগুলি দিনরাইত মদে ডুইব্যা থাকে, কিন্তু খাকারি দিলেই কয় ইসলাম; আমাগোও তাই করতে হইবো।
এভাবে ক্রমশ কয়েক ঘণ্টায় তাদের নীতি স্থির হয়ে যায়।
শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশের বৈঠক বসতে একটু দেরি হয়, কেননা মহাদেশনেত্রীর ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়; আমরা গরিবরা শুনতে পাই তিনি দুপুরের আগে ঘুম থেকে জাগতে পারেন না। সুখী মানুষ, সুখ বেশি, ঘুমও বেশি; আর তাতে শরিলটাও ভালো থাকে। এটা আমাদের জাতীয় গর্ব, একধরনের জাতীয়তাবাদ; আমরা যখন পাখপাখালির ডাকের আগে ঘুম থেকে উঠে মাঠে ময়দানে যেতে থাকি, আর ঘুমোতে পারি না, ঘুমোলে আমাদের পেট খালি থাকে, সেখানে মহাদেশনেত্রী একটা পর্যন্ত ঘুমোন, আমরা গরিবরা শুনি, আর গর্বে আমাদের পেট ভরে ওঠে। ঘুমে তিনি হয়তো আমাদেরই স্বপ্নে দেখেন, আমরা ফুলের মালা নিয়ে এসেছি, কাঁধে করে সিংহাসন নিয়ে আসছি, ঘুম থেকে উঠে তিনি তাতে বসবেন। মহাদেশনেত্রী সম্রাজ্ঞীর মোন, গরিবরা শুনতে পাই তার রাজবংশের কেউ তার সামনে বসারও সাহস করেন না, দাঁড়ানোরও সাহস করেন না; আমরা গরিব জনগণরা বুঝতে পারি না কীভাবে। তাহলে তারা মহাদেশনেত্রীর সাথে কথা বলেন। প্রাইমারি ইস্কুলে আমরা যেমন নিলডাউন হতাম, সেই কথাটি শুধু আমাদের মনে পড়ে।
মহাদেশনেত্রী হচ্ছেন ওই রাজবংশের মূর্ত রূপ।
দেরি হলেও ওই রাজবংশেরও সভা বসে; না বসে উপায় নেই; সকালে জাগার থেকে ঘুম বড়ো, আর ঘুমের থেকে সিংহাসন বড়ো।
মহাদেশনেত্রী তার আসনে বসে একবার হাসেন, কোনো কথা বলেন না।
তিনি চোখের সামনে একটা সিংহাসনের ছায়া দেখতে পান; এখন তিনি সিংহাসনে নেই ভেবে তার চোখ ঘোলা হয়ে আসে।
তার হাসিটি ম্লান হয়ে আসে; সভাকক্ষের বাতিগুলো যেনো নিভে আসে।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো