আমাদের দেশে আছে আরো নানা গণতান্ত্রিক রাজবংশ।
আমাদের গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো যখন প্রার্থী (তাঁরা বলেন ক্যান্ডিডেট) ঠিক করতে শুরু করেন, আমরা, আহাম্মক জনগণরা, মনে করেছিলাম এবার দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যযুগ; কেননা রাজবংশগুলো ন্যায়, নীতি, আদর্শ, সততা, কল্যাণ প্রভৃতি ও আরো অনেক ভালো ভালো কথায় মেতে ওঠেন; তাদের মুখ থেকে শ্রাবণের ধারার মতো (অনেকে বলেন থুতুর মতো) ন্যায়, নীতি, সততা ঝরতে থাকে; জনগণ জনগণ ধ্বনিতে তারা দেশ মুখর করে তোলেন। তারা যতো নীতির কথা বলতে থাকেন, আকাশের মেঘে ততো জলও নেই। তারা বলতে থাকেন রাজনীতিকে উদ্ধার করতে হবে সুবিধাবাদী আর অসৎদের হাত থেকে; নির্বাচিত করতে হবে সৎ ও নীতিপরায়ণ মানুষদের (এই জীবটি কতো দিন ধরে আমরা দেখি না), চোরবদমাশদের বের করে দিতে হবে রাজনীতি থেকে (আমরা বলাবলি করতে থাকি তাহলে দেশে কি রাজনীতি থাকবে না, এটা কি দেশ থেকে রাজনীতি উঠিয়ে দেয়ার চক্রান্ত?); কিন্তু, হায়, আমরা বোকারা দেখতে পাই গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো প্রার্থী মনোনয়নের সময় নীতি ও সতোর কোনো বালাই রাখেন না। তা-ই বা কেমন করে বলি? তারা নীতি ও সততা বলতে যা বোঝেন আমরা বোকারা হয়তো তা বুঝতে পারি না; আমরা, জনগণ, নীতি আর সততার কী বুঝি? আমরা বোকারা শুধু বুঝতে পারি মুখে ভালো ভালো কথা বলা আর কাজে তার উল্টোটা করাই হচ্ছে রাজনীতি। রাজাদের নীতি আর বোকাদের নীতি কখনোই এক হতে পারে না।
এবার বাতাস এমনভাবে বইতে থাকলো যে আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারলেন, এবং এমনকি আমরাও বুঝতে পারলাম, ক্ষমতায় যাবেন দুই বড়ো রাজবংশের এক রাজবংশ–জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশ, নইলে শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশ। তাদের ক্ষমতায় যাওয়া খুবই দরকার; আর সারা দেশের রাজনীতিবিদরা দুই দলে গিয়ে ভেঙে পড়লেন, অনেক নতুন নতুন রাজনীতিবিদেরও উদ্ভব হলো। আমরা মনে করেছিলাম যেই দলের যেই নীতি সেই নীতির লোকেরা যাবেন সেই দলে; কিন্তু যা দেখতে পাই তাতে আমাদের সুখের কোনো শেষ থাকে না। আমরা তো আর সব দেখতে আর শুনতে পাই না, গরিব মানুষ, জনগণ আমরা, দূর থেকে যা দেখতে পাই আর শুনতে পাই সেই কথাই বলছি।
শুনতে পাই জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের বৈঠক বসেছে।
তাঁদের বৈঠক যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা বুঝতে পারি। এইবার তাদের ক্ষমতায় যেতেই হবে, অনেক বছর তারা রাজপথে আছেন। তাদের মুখের দিকে তাকালে আমাদের মায়া হয়, মুখ তাদের দরদভরা; মানুষ ক্ষমতার বাইরে থাকলে মানুষ হয়ে ওঠে, এটা আমরা গরিবরা বুঝতে পারি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে। তাঁরা যখন, অনেক আগে, ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাদের চোখেমুখে এই দরদটা ছিলো না, তখন তাদের দিকে তাকানোই যেতো না; যেমন কয়েক মাস আগেও শক্তির উৎসবাদী রাজবংশের কারো মুখের দিকে আমরা গরিবরা তাকাতে পারতাম না, তাঁদের মুখ থেকে ক্ষমতা ঝিলিক দিয়ে এসে আমাদের মুখ পুড়িয়ে দিতো।
মহাজননেত্রী বললেন, বলেন আপনেরা, এইবার কী নীতি লইতে হবে, কাদের ক্যান্ডিডেট করতে হবে।
আমাগো এইবার ক্ষমতায় যাইতেই হইবো, বললেন রাজবংশের এক বড়ো জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজপুরুষ মোহাম্মদ আবদুর রহমান, ক্ষমতার বাইরে আর থাকন যায় না, বাইরে থেকে থেকে পইচ্যা যাইতেছি। এইবার এমন নীতি আর কৌশল লইতে হবে, যাতে ক্ষমতায় যাইতে পারি।
আবদুর রহমান সাহেবের বয়স হয়েছে, অনেক বিপদের মধ্যেও তিনি এ-বংশ ছেড়ে অন্য বংশে যান নি, গেলে দু-তিনবার মন্ত্রী হতে পারতেন; এখন দাড়ি আর টুপি নিয়েছেন; তাঁর আর সময় নেই।
অনেক বচ্ছর ধইর্যা আমরা রোডে আর রাস্তায় আছি, শ্লোগান দিতাছি মিছিল করতাছি, মাইর খাইতাছি, ভাঙচুর করতাছি, আমাগো কোনো পাওয়ার নাই, অনেক বচ্ছর ধইর্যা আমরা বঙ্গভবনে নাই, গণভবনে নাই, এইবার আমাদের অই ভবনগুলিতে ঢুকতে হইবো, বললেন আরেক রাজপুরুষ কলিমউদ্দিন মৃধা।
তাঁরও বয়স হয়েছে, অনেক ধৈর্যে তিনি টিকে আছেন এ-রাজবংশে; অনেক প্রলোভন পেয়েছেন অন্য রাজবংশ থেকে, দু-একবার যাওয়ার উপক্রম করেছিলেন; কিন্তু সুবিধা হবে না বুঝে যান নি, তার অনেক সঙ্গীই চলে গেছেন।
বলেন আপনেরা, কী নীতি মাইন্যা আপনেরা ক্যান্ডিডেট দিবেন? জিজ্ঞেস করলেন মহাজননেত্রী।
নীতি একটাই–যে জিতবো বইল্যা মনে করুম, তারেই ক্যান্ডিডেট করুম, যে জিতবো না তারে ক্যান্ডিডেট করুম না, বললেন আরেক রাজপুরুষ নিজামউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, এইবার ক্ষমতায় না গেলে আমাগো ভবিষ্যৎ নাই।
তার অনেক বয়স হয়েছে, চলে যাওয়ার আগে একবার অন্তত মন্ত্রী হয়ে যেতে চান; কয়েকবার হজ করেছেন, আজকাল সব সময় মাথায় টুপি পরেন, রোজা নামাজও করেন, এবং মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
ঠিক কথা বলতাছেন, চাচা, যে জিতবো না তারে আমরা নিব না, এইবার আমাদের ইলেকশনে উইন করতেই হবে, বললেন মহাজননেত্রী, আমরা স্বাধীনতা আনলাম আর ফলটা খাইলো অরা। যেভাবেই হোক আমাদের জিততে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর আসন বা সিংহাসনটি একবার ঝলমল করে ওঠে চোখের সামনে।
কয়টা জিনিশ আমাগো দ্যাখতে হইবো, বললেন এক রাজপুরুষ মোহাম্মদ রজ্জব আলি, ওইগুলিন না দ্যাখলে ক্ষমতায় যাইতে পারুম না।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো