চাষাভাই কাঁপতে থাকে আর তার বউ ভয় পেয়ে জেগে উঠে বলে, কি কও, কি আইছে? যা ইচ্ছা আহুক।
চাষাভাই বলে, বাগ আইছে, বাগের গন্ধ পাইলাম, ওট।
তার বউ বলে, কোন জায়গায় বাগ? কোন জায়গায় বাগের গন্ধ পাইলা? বাগ আইব কই থিকা?
চাষাভাই বলে, ক্যান, আমি ত অখনও গন্ধ পাইতাছি, তুই পাছ না?
বউ বলে, বাগের গন্ধ কোনখানে? আমি গরুর চনার গন্ধ পাইতাছি।
চাষাভাই বলে, তুই মাইয়ামানুষ, কোনদিন বাগ দেখছ নাই বাগের গায়ের গন্ধ কেমন তা জানবি কেমনে, চনার গন্ধই ত তুই চিনবি। মাইয়ামাইনষের জন্মই হইছে চনায় প্যাট বোঝাই করনের লিগা।
বউ বলে, আমার নাকে সর্দি হইছে লাগে, হেই লিগা খালি চনা চনা গন্ধ পাইতাছি।
চাষাভাই বলে, তুই চনার গন্ধ পাইতাছছ, আর আমি বাগের গন্ধে মইরা যাইতাছি।
বউ বলে, সগলে যে বলে তোমার মাথায় ছিট আছে সেইটা মিছা না।
বউ আবার ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু ওই চাষাভাই বাঘের গন্ধে আর ঘুমোতে পারে না; সকাল হওয়ার পরও ক্ষেতে যেতে তার ভয় করতে থাকে।
এমন খবর আমরা দেশের নানান জায়গা থিকাই পাইতে শুরু করছি।
আরেক জায়গায় বাচ্চাদের, আহা আমাগো সোনামণিগো, ইস্কুল শুরু হয়েছে, একটি বাচ্চা ওই সময় চিৎকার করে ওঠে, আফা, আমার ডর লাগতেছে, আমার ডর লাগতেছে।
আফা রেগে উঠে বলেন, ক্যান, তর ডর লাগতাছে ক্যান?
বাচ্চাটি বলে, কিয়ের জানি গন্ধ পাইতাছি।
তখন সব বাচ্চাই চিৎকার করে ওঠে, আমাগো ডর লাগতাছে, আমরা গন্ধ পাইতাছি, আমাগো ডর লাগতাছে।
আফা রেগে উঠতে গিয়ে নিজেও গন্ধ পান।
আফা বলেন, সত্যই ত বাগের গন্ধ, মনে হয় বাগ আইছে।
বাচ্চাদের সারা ইস্কুলে চিৎকার কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়, সব দরোজা জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়। তাদের চিৎকার শুনে চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসে।
লোকজন চিৎকার করে বলে, তোমাগো কি হইছে, তোমরা দরজা জানলা আটকাইয়া চিকইর পারতাছ ক্যান, কি হইছে তোমাগো?
বাচ্চাদের চিৎকার আরো বেড়ে যায়।
দুজন আফা এক সময় জানালা খুলে বলেন, আমরা সব বাগের গন্ধ পাইতাছি, মনে হয় বাগ আইছে।
লোকজন চারদিকে তাকিয়ে কোনো বাঘ দেখতে পায় না, গন্ধও পায় না বাঘের; এমনকি কাছে দূরে একটা খট্টাশও তারা দেখতে পায় না।
তারা চিৎকার করে বলে, তোমরা মনে হয় পাগল হইছো, এইহানে বাগ আইবো কোনহান থিকা, দরজা জানলা খোলো।
সব জায়গায়ই যে বাঘের গন্ধ পেতে শুরু করেছি আমরা, তা নয়; কোনো কোনো জায়গায় শুয়োরের গন্ধও পেতে শুরু করেছি আমরা।
ফুলঝুরিয়ার মানুষ কয়েক দিন ধরে শুয়োরের গন্ধ পাচ্ছিলো; প্রথম তারা অবশ্য বুঝতে পারে নি যে ওই গন্ধটা শুয়োরের গায়ের গন্ধ না বোঝার কারণ তো একটাই, তারা কখনো শুয়োরই দেখে নি; তাই তার গায়ের গন্ধ কেমন তারা জানতো না। তারা জানে শুয়োর হারাম, তাই শুয়োরের নাম উঠলেই আমরা সবাই গন্ধ পাই। কয়েক দিন ধরে গন্ধটা বাড়তে থাকে; এবং একজন প্রথম বলে যে গন্ধটা শুয়োরের গায়ের গন্ধ। তখন ফুলঝুরিয়ার মানুষ মাঝেমাঝে বমি করতে থাকে, অনেকে খেতে গিয়ে গন্ধে খাওয়া বন্ধ করে, নানা রকম ঔষধ খেতে শুরু করে তারা। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না কোথা থেকে আসতে পারে শুয়োরের গায়ের দুর্গন্ধ, যাতে বমি না করে পারা যায় না।
তারা আশা করছিলো পাবে পবিত্র সুগন্ধ, কিন্তু শুয়োরের গন্ধে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ফুলঝুরিয়ায় রাজাকারবংশের আমির অধ্যাপক আলি গোলাম পদার্পণ করবেন বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে; জনগণ খুবই উদ্দীপ্ত, অনেকে নতুন টুপিও কিনেছে, দিকে দিকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে তার পবিত্র আগমনের, দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগানো হয়েছে, সোয়াবের কথা ভেবে খুশিতে ভরে উঠতে চাচ্ছিলো লোকজন, কিন্তু তারা শুয়োরের গন্ধ পেতে থাকে। ফুলঝুরিয়ার ঘরবাড়ি বমিতে পিছল হয়ে উঠতে থাকে, পচা টক দুর্গন্ধে ভারি হয়ে ওঠে ফুলঝুরিয়ার বাতাস; মরিচ ধান ধনেপাতা লাউয়ের দিকে তাকালেও মনে হয় তারা বমি করছে।
গন্ধ তাড়ানোর জন্যে তারা বাড়িতে বাড়িতে ধূপ জ্বালাতে শুরু করে।
যেদিন অধ্যাপক আলি গোলাম ফুলঝুরিয়ায় উপস্থিত হন, সেদিন গন্ধটা চরম রূপ ধারণ করে। আলি গোলাম ভাষণ দিতে শুরু করলে লোকজন চিৎকার করে আবেদন
জানাতে শুরু করে, তিনি প্রথম শুনতে পান না।
শুনতে পাওয়ার পর তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনেরা চিৎকার করিছেন কেনো, আপনারা কি আবেদন করিতে চান?
লোকজন বলে, হে হুজুর হে আমির, আমরা শুয়ারের গন্ধ পাইতেছি, গন্ধে টিকতে পারতেছি। আপনে আগে দোয়া পইর্যা গন্ধ খ্যাদাইয়া আমাগো বাঁচান।
তিনি বলেন, আমি কোনো গন্ধ পাইতেছি না।
তারা বলে, হে আমির, আমরা পাইতাছি।
আলি গোলাম সারা বিকেল আর সন্ধ্যা ভরে সকলকে নিয়ে দোয়াদরুদ পাঠ করেন, অনেক দিন ধরে তিনি নিজে দোয়াদরুদ পড়েন না বলে দেখতে পান অনেক দোয়াই তিনি ভুলে গেছেন, তবু তিনি থামেন না; কিন্তু তাতে গন্ধ কমে না, লোকজন বলতে থাকে, হে আমির, আমরা গন্ধ পাইতাছি, আরও দোয়া পড়েন, গন্ধ বাইর্যা যাইতাছে। ক্লান্ত হয়ে আলি গোলাম সভা ছেড়ে দলের অফিসে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন–ঘুমোতে পারেন না, জেগে থাকেন।
পরদিন ভোর হওয়ার আগেই তিনি ফুলঝুরিয়া ছেড়ে যান, ঠিক করেন এখানে আর আসবেন না। আরো তিন চার দিন ধরে ফুলঝুরিয়ার মানুষ শুয়োরের গন্ধ পায়; ধীরে ধীরে গন্ধ কমে আসে। তারা আবার শিশুর মুখে শিশুর গন্ধ ধানক্ষেতে ধানের গন্ধ বাড়া ভাতে ভাতের গন্ধ পেতে শুরু করে।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো