মেষদের নিকট থেকে তিনি লাউডগা কচুর লতি শাপলা মুরগি মোরগ ছাগল গরু বাছুর বলদ দশ বিশ একশো পাঁচশো টাকার নোট গুণে গুণে নিচ্ছিলেন, তাদের পানসে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিলেন; ব্যবসা বেশ জমে উঠছিলো। আমাদের দেশে পাঁচ দশ বছর পর পর (বিশেষ করে যখন কোনো বড়ো ক্যাডার দেশ দখল করে) এমন একটা দেখা দেয়, জমিয়ে ব্যবসা করে, তারপর আরেকটা দেখা দেয়, আগেরটার ব্যবসা কমে, নতুনটার ব্যবসা জমে।
এমন সময় খোজারাজবংশের সম্রাট বাবর দেখা দেন। বড়ো ক্যাডাররা ধর্মের ঝান্ডা উড়াতে পছন্দ করেন, বাবর ধর্মের ঝান্ডায় দেশের সব ছাদ ভরে ফেলেন। বাবর খুঁজে পান পুঁটিমারাকে; এবং তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেন একনম্বর রিলিজিয়াস পলিটিশিয়ান হিশেবে। বাবরের এইটা এক বড়ো কীর্তি।
বাবর তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, হুজুর, আমি আপনার দোয়া চাই। কীভাবে আপনার দোয়া আমি পাইতে পারি? আপনার দোয়া নিয়া আমি আগাইতে চাই।
পুঁটিমারা বলেন, নিয়মিত আমার দরগায় আসিবেন।
বাবর বলেন, আমি আসবো, হেলিকপ্টারে উড়ে আসবো; আমরা সঙ্গে জেনারেলরা সেক্রেটারিরা এডিশনাল সেক্রেটারিরা ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা মেয়ররা পলিটিশিয়ানরা স্মাগলাররা আর যা যা আছে তারা পাজেরো নিশান টয়োটা মার্সিডিস চালিয়ে আসবে। আপনি দোয়া করবেন।
পুঁটিমারা বলেন, তাহলে অবশ্যই আমি দোয়া করিব।
বাবর বলেন, আমি এর থেকেও বেশি সেবা করতে চাই, তা কীভাবে করতে পারি? আপনার দোয়া নিয়া আমি মরন পর্যন্ত রুল করতে চাই।
পুঁটিমারা বলেন, আমার পুত্ররা তাহা আপনাকে বলিবে।
পুঁটিমারার চার বিবি আর অজস্র পুত্র; পুত্ররা সবাই বুদ্ধিমান।
একপুত্র বলে, পিতা স্বপ্নে দেখেছেন তিনি এইখানে একটি পবিত্র প্যালেস বানাইতেছেন। এই প্যালেস ইসলামের প্যালেস, এইটা বানাইলে সওয়াবের শেষ থাকবে না।
বাবর বলেন, তা অবশ্যই বানানো হবে, ছয় মাসেই হবে। প্যালেস ছাড়া দেশের উন্নতি নাই, ধর্মের উন্নতি নাই।
আরেক পুত্র বলে, বেহেস্তের আদলে আমরা একটি হাউজিং সোসাইটি করেছি, ওই হাউজিং সোসাইটির নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। তার জন্যে ঢাকা শহরে দশ বিঘা জমি লাগবে।
বাবর বলেন, জমি পাবেন, আমরা জান্নাত চাই।
তার পাশেই মেয়র দাঁড়িয়ে ছিলেন; তিনি বলেন, স্যার, একটাকা দাম দিলে আইন রক্ষা পাবে।
বাবর বলেন, ওই টাকাটা অফিসে বাঁধিয়ে রাখবেন।
আরেক পুত্র বলেন, পিতা স্বপ্ন দেখেছেন আল্লার রহমতে দেশে অনেক তেল পাওয়া যাবে, তাই দশটি অয়েল ট্যাংকার কেনার জন্যে লোন চাই। বেহেস্তেও ট্যাংকার লাগবে।
বাবর দুইটা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দিকে তাকান।
চেয়ারম্যান দুটি বলেন, এই সপ্তায়ই একশো কোটি টাকা দেয়া হবে।
এইভাবে তারা ধর্ম রাজনীতি অর্থনীতির সমন্বয় সাধন করেন। আমাদের ধর্ম কোনো সংকীর্ণ জিনিশ নয়, তা সর্বাঙ্গীন জীবনব্যবস্থা।
কিন্তু বাবরকে খোঁয়াড়ে ঢোকানোর পর ইবনে পুঁটিমারা বলেন, বাবর একটা খবিশ আছিলো, জেনাখোর আছিলো, সে হাবিয়া দোজগে যাইবে।
বাবর খোয়াড় থেকে বেরিয়ে বলে, পুঁটিমারা একটা শয়তান, আস্ত ইলিশ, সে আমার থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়েছিলো, সে ব্ল্যাকমার্কেট স্মাগলিং করতো; মদের ব্যবসা করতো। তারে আমি ছেড়ে দিলাম। এইবার আমি আসল পির ধরলাম, এইবার থেকে আমার পির ইবনে কুচিয়ামারা।
এই ধর্মীয় রাজনীতি দেখতে আমাদের বেশ লাগে।
এক সময় কাচিহাতুড়ির রাজবংশে আমাগো দ্যাশ ভরে গিয়েছিলো; আমরা গরিবরা মনে করেছিলাম আমাদের দিন আসলো। কিন্তু আমাগো দিন আর আসলো না, মনে হয় আমাদের দিন চিরকালের জইন্যে শ্যাষ হলো। কাচি দিয়ে অবশেষে পুচিয়ে পুচিয়ে নিজেদের গলা কাটলাম, হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে নিজেদের মাথা আর কপাল ভাঙলাম। অথচ কতো স্বপ্ন ছিলো আমাদের; কত স্বপ্ন দেখিয়েছিলো আমাদের সেই সব রাজবংশ–মার্ক্সীয় রাজবংশ, লেনিনীয় রাজবংশ, মাওরাজবংশ; সেগুলো ভেঙেচুরে হলো মার্ক্সীয়-আব্দুল রাজবংশ, মার্ক্সীয়-করিম রাজবংশ, মার্ক্সীয়-জব্বর রাজবংশ, লেনিনীয়-মোল্লা রাজবংশ, লেনিনীয়-খা রাজবংশ, লেনিনীয়-শেখ রাজবংশ, মাও-চৌধুরী রাজবংশ, মাও–কাজি রাজবংশ, মাও-সলিমদ্দি রাজবংশ; এইরূপ গণ্ডায় গণ্ডায় কুড়িতে কুড়িতে রাজবংশ। তারা গলা কাটতে কাটতে, ছেলেপেলেদের মরনের দিকে ঠেলে দিতে দিতে, তারপর ভাঙতে ভাঙতে, তারপর আরো ভাঙতে ভাঙতে, চুরমার হ’তে হ’তে তারপর বড়ো ক্যাডারদের পা ধরতে ধরতে এখন তারা বড়ো ক্যাডারদের নোংরা বুটে পরিণত হয়েছেন। কিছু রাজপুরুষ অবশ্য পেরিয়ে গেছেন সবাইকে; তারা ছেলেপেলেদের শিখিয়েছিলেন সমাধান করো ধনীগুলোকে, একবারে সমাধান করে ফেলল, দেশে বিপ্লব ঘইটা যাইবে, দেশে চাষাগরিবের রাজত্ব আসবে, চাষা রাজা হবে কামলা রাজা হবে। তাদের কথায় ছেলেপেলেগুলো সমাধান হয়ে গেলো, শূন্য হয়ে গেলো লাশ হয়ে গেলো হাড় হয়ে গেলো, হাজার হাজার ছেলেকে আমরা খুঁজে পেলাম না, কিন্তু রাজবংশের বড়ো বড়ো রাজপুরুষেরা ধনী হয়ে গেলেন।
তাগো সব গল্প আর বলতে চাই না, দুই একটা ছোটগল্প এইখানে বলা যায়।
লেনিনীয়-খাঁ রাজবংশের বড়ো কাজ ছিলো মস্কো গিয়ে রোগের ফ্রি ট্রিটমেন্ট করানো। তাঁদের সর্দিকাশি হইলে, ছেলেমেয়েবউদের জ্বরজারি হলে অ্যারোফ্লোট জাহাজে উঠে তারা মস্কো চলে যেতেন, তাগো পয়সা লাগতো না; বিনাপয়সায় চিকিৎসা কইর্যা সুস্থ হয়ে ফিরে আসতেন। তারা ভালো ক্লিনিক পাইছিলেন, কিন্তু আমরা গরিবরা তা পাই নাই।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো