শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশের মহাদেশনেত্রী, কুইন ভিক্টোরিয়া, বেশ ভেঙে পড়েছেন, সিংহাসনে বসা ছাড়া রাজনীতি তিনি বোঝেন না, তার চেয়ে বেশি বোঝেন থাই আর চিনা বিউটিশিয়ানদের, তবু তার মনে হচ্ছে সিংহাসন সরে যাচ্ছে; বেশ উৎফুল্ল আছেন জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের মহাজননেত্রী, রাজকন্যা, সুলতানা রাজিয়া গতবারের কোনো ভুলই তিনি আর করতে চান না, এবার সিংহাসনে বসতেই হবে তাকে; তার রাজপুরুষদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন এবারের সম্ভাবনাকে নষ্ট করা চলবে না। এবার যদি ক্ষমতায় যাওয়া না যায়, তাহলে তাদের আর ভবিষ্যৎ নেই। তাই তার রাজপুরুষেরা খুবই ব্যস্ত, দিনরাত তারা করে চলছেন পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা।
ড্যামোক্র্যাসি আর গণতন্ত্রের কলকাঠি
আমরা জনগণরা ড্যামোক্র্যাসি আর গণতন্ত্রের কলকাঠি বুঝতে পারি না, ভোট দিয়েই কাম শেষ করি; তবে শুনতে পাই শহরে নানা রকম পলিটিকেল পণ্ডিত দেখা দিয়েছেন, ওই পণ্ডিতরা অঙ্ক শিখে এসেছেন বিলাত আর আমরিকা থেকে, তারা নাকি পাঁচশোজন আর হাজারজন মানুষের সাথে কথা বলেই অঙ্ক করেই বলে দিতে পারেন এবার ইলেকশনে কোন রাজবংশ ক্ষমতায় আসবেন। আমাদের খবরের কাগজগুলি ওই সব রাজনৈতিক জ্যোতিষীদের হস্তগণনা ছাপতে শুরু করেছে, আর আমরা একেক দিন একেকদল জ্যোতিষীর হস্তগণনার অঙ্ক পড়ে মাথায় গোলমাল বাধিয়ে তুলছি। ইলেকশন আসলে সবাই দোকান খোলে, একটু ব্যবসা করে নিতে চায়; পানবিড়িআলারা ঘুমানোর সময় পায় না, টানবাজার আর কান্দুপট্টির মেয়েগুলোর পিঠ আর মাজা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়; এখন দেখছি নতুন এই ব্যবসাটি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে–দিনরাত ব্যবসা করছে।
নিরপেক্ষ রাজনৈতিক জ্যোতিষীসংঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন :
উচ্চবিত্তের মতে প্রাপ্ত আসন | মধ্যবিত্তের মতে প্রাপ্ত আসন | নিম্নবিত্তের মতে প্রাপ্ত আসন | গড়ে প্রাপ্ত আসন | |
জনগণমনবংশ | ১৪০ | ১৫০ | ১৬০ | ১৫০ |
শক্তির উৎসবংশ | ১০০ | ৯০ | ৭০ | ৮৬.৬ |
খোজাবংশ | ২০ | ২৫ | ২০ | ২১.৬ |
রাজাকারবংশ | ৫ | ৩ | ১৫ | ৭.৬ |
অন্যান্য বংশ | ৫ | ২ | ৫ | ৪ |
মোট আসন | ২৭০ | ২৭০ | ২৭০ | ২৭১ |
দ্রষ্টব্য : প্রত্যেক শ্রেণীতে অংশ নিয়েছেন ৫০০ ভোটার।
এবার হচ্ছে বাঁচনমরনের নির্বাচন, সারভাইভালের ইলেকশন; কারোই মাথা ঠিক নেই–জিতলে বাঁচুম হারলে মরুম। এই ধরনের হস্তরেখাপাঠ পাওয়া গেলে ভোটারদের মাথা ঠিক থাকে না, যারা ভোট চায় তাদের মগজ ঠিক থাকে না, খুলি ভেঙে মগজ চারদিক দিয়ে বেরিয়ে পড়তে চায়; বিশেষ করে মগজ আর মাথা নষ্ট ভ্রষ্ট দ্রষ্ট প্ৰষ্ট ঘ্রষ্ট হয়ে যায় তাদের, সিংহাসন যাদের অবশ্যই চাই–সেই শক্তির উৎসবাদী আর জনগণমন রাজবংশের মহাদেশনেত্রী মহাজননেত্রী রাজপুরুষ ক্যাডার, এমনকি চিকামারাদের।
একদিন সকালবেলা আমরা জনগণরা দেখতে পাই দেশখানা পলিটিকেল প্যান্ডিট আর অ্যাস্ট্রোলোজারে উপচে পড়ছে; হার্ভার্ড শিকাগো ইউসিএলএ হনুলুলুর সাথে আরো : অজস্র ধনুলুলু ভনুলুলু চনুলুলুর রাজনৈতিক জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বাণীতে কাগজের পাতা ভরে উঠতে থাকে। তাগো লগে পরতিজোগিতা লাগায় আমাগো রাস্তার গলাকাইট্যা জোড়ালাগাইনা ফালফারা বাকবাকম ম্যাজিশিয়ানটা (সে কয়েক ডিগ্রি এগিয়ে যায়, তার হস্তগণনা পত্রিকায় না দিয়া বাক্সের ভেতরে বাক্স তার মইধ্যে আরো বাক্স তার মইধ্যে আরো বাক্স তার মধ্যে আটকাইয়া রেখে আসে ইংরাজি খবরের কাগজের অফিসের লোহার সিন্দুকে), আমলিগোলার পানিপড়ানি বুড়ীটা, ধলেশ্বরীর ফেরিঘাটের দাঁতের মাজনের ক্যানভাসারটা, এমনকি টানবাজারের তিনচারটা দেহশিল্পীও ভবিষ্যদ্বাণী করে। ওপরের পূর্বাভাসটি অত্যান্ত খুবই আপত্তিকর লাগে শক্তির উৎসবাদীদের কাছে, লাগনেরই কথা, তাঁরা এর তীব্র নিন্দা করেন; পরের দিনই আমরা খবরের কাগজে আরেকখানা বিজ্ঞানসম্মত পূর্বাভাস পাই, যাতে হস্তরেখা আরো বৈজ্ঞানিকভাবে গণনা করা হয়েছে। এই পূর্বাভাসটির খুবই উচ্চ প্রশংসা করেন উৎসবাদীরা, আর খুবই নিচ্চ নিন্দা করেন জনগণমন গণতন্ত্রবাদীরা।
বিশুদ্ধগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জ্যোতিষীসংঘের অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত (শক্তির উৎসবাদীদের মতে) পূর্বাভাসটি নিম্নরূপ :
উচ্চবিত্তের মতে প্রাপ্ত আসন | মধ্যবিত্তের মতে প্রাপ্ত আসন | নিম্নবিত্তের মতে প্রাপ্ত আসন | গড়ে প্রাপ্ত আসন | |
জনগণমনবংশ | ১৫০ | ১৬০ | ১৬৫ | ১৫৮ |
শক্তির উৎসবংশ | ৯০ | ৮০ | ৮৫ | ৮৫ |
খোজাবংশ | ১৫ | ২০ | ১২ | ১৫.৬ |
রাজাকারবংশ | ১০ | ৮ | ৬ | ৮ |
অন্যান্য বংশ | ৫ | ২ | ২ | ৩ |
মোট আসন | ২৭০ | ২৭০ | ২৭০ | ২৭০ |
দ্রষ্টব্য : প্রত্যেক শ্রেণীতে অংশ নিয়েছেন ৮০০ ভোটার।
এরকম স্তম্ভিত ভবিষ্যদ্বাণীতে, হস্তগণনায়, সংখ্যাতত্ত্বে, ময়না টিয়া শালিক টুনটুনির পোস্টকার্ড পাঠে, ঝাঁটা খড়ম বাটি সিঁড়ি বঠি চালানে আমরা বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলতে থাকি।
সব ধরনের রাজনৈতিক জ্যোতিষীদের মধ্যে প্রচণ্ডতম সাড়া জাগান এক অভিনব ধারার রাষ্ট্রবিজ্ঞান জ্যোতিষীরা, যাঁরা নিজেদের পরিচয় দেন নন্দনতাত্ত্বিক নির্বাচনবিজ্ঞানী। এই ধারার রাষ্ট্র ও নির্বাচনবিজ্ঞান নাকি এখন খুবই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে উন্নত সেক্সি গণতন্ত্রগুলোতে; আমরা এখনো তার খবর পাই নি, কয়টা ভালো খবরই আর আমরা পাই একশো দুইশো বছর কাটনের আগে; তাঁদের তত্ত্ব হচ্ছে ভোটাররা আর শুধু ইশতেহার ও গলাবাজি শুনে ভোট দেয় না, ওই সব পচা ইশতেহার পড়া আর গলাবাজি শোনার থেকে তারা এক্সএক্সএক্স দেখতে বেশি পছন্দ করে; তারা ভোট দেয় (অন্তত ৪০%) ক্যান্ডিডেটদের পোশাকের রঙ, চিবুকের ভাঁজ, বক্ষের উচ্চতা, চুলের বিন্যাস, কণ্ঠস্বরের মাদকতা, ঠোঁটের বিস্তার, হাসির ঝিলিক–এককথায় তাদের যৌনাবেদন অনুসারে। যার যৌনাবেদন যতো বেশি তিনি ততো ভোট পান। তাঁরা ডিগ্রি দিয়ে সেক্স অ্যাপিল (এসএ) পরিমাপের পদ্ধতিও বের করেছেন; যাঁদের এসএ ৭৫ ডিগ্রির ওপরে, তাঁরা স্টারমার্কপ্রাপ্ত, তাদের জয় নিশ্চিত, ভোটাররা তাঁদের ভোট দেয়ার জন্যে ভোরের আগেই ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়; যাদের এসএ ৫০ ডিগ্রির নিচে, তারা শুধু ফেল নয় তাঁদের জামানত বাজেয়াপ্তি অবধারিত, আগামী নির্বাচনেও তাদের কোনো সম্ভাবনা নেই। ওই সব দেশে সেক্স অ্যাপিল না থাকলে হ্যামবার্গারের মতো আকর্ষণীয় খাদ্যও বিক্রি হয় না, আর রাজনীতিবিদরা তো পচা বাসি খাদ্য, তাঁদের কে খায়? তারা আরো জানান যে সারা দুনিয়াতেই রাজনীতিবিদদের এসএ কমে যাচ্ছে, জনগণ তাই রাজনীতিতে ভোটে নির্বাচনে আস্থা হারিয়ে ফেলছে; পৃথিবীতে শিগগিরই রাজনীতিক সংকট দেখা দেবে। তাদের কাছ থেকে আমরা আরো জানতে পারি এখন সবচেয়ে কম এসএ আছে আরব আর ইউরোপের রাজা রানী রাজপুত্র রাজকন্যাদের, এবং আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশের লৌহমানবদের। তাদের এসএ .০০৫°। নন্দনতাত্ত্বিকদের তত্ত্ব ও বিশ্লেষণপ্রণালি হৈচৈ বাঁধিয়ে দেয় এজন্যে যে আমাদের ইসলামি রাষ্ট্রে, যার ছেঁড়াফাড়া সংবিধানের শুরুতে আল্লাতাল্লার নামে সব কাম করনের কথা বলা হয়েছে, যাকে আমরা ফজরে জোহরে মাগরেবে আসরে আফগানিস্থান সৌদি আরব করে তোলার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছি, সেই পবিত্র ভূমিতে ক্যান্ডিডেটদের যৌনাবেদন বিচার ধর্মসম্মত কি না। একদল ফতোয়াবাজ ওই বিজ্ঞানীদের পাছায় ৪০টা দোররা লাগানোর ফতোয়া দেয়, আরেকদল তাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর সিদ্ধান্ত জানায়। তবে নন্দনতাত্ত্বিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সীমা পেরিয়ে যান না তারা শয়তানের ভাই নন, বুদ্ধিজীবী হলেও তারা বেশ বুদ্ধিমান, তাঁরা বলেন বাঙলাদেশের মতো দেশে, যেখানে যৌনাবেদন সম্পর্কে কথা বলা কপট ট্যাবো (ধর্ম রাখতে হইলে এইটা অত্যান্ত দরকার), সেখানে ওই আবেদন (এসএ) বিচার বা পরিমাপ না করলেও চলে; এখানে বিচারবিশ্লেষণ করা দরকার সৌন্দর্য; আর ধর্মে সৌন্দর্য খুবই প্রশংসিত জিনিশ। তাঁরা অজস্র কেতাব থেকে পাতার পর পাতা হাজির করে দেখান এই মহান ধর্ম সৌন্দর্যের প্রশংসায় মুখর, ভাতের পরই আমাদের ফুল। খাওনের কথা (গোলাপ ফুল? শাপলাফুল? কদুফুল? গন্ধরাজ? রজনীগন্ধা?); এই ধর্ম খ্রিস্টধর্ম নয়, যাতে নোংরা উকুনভরা ছালাপরা সন্তরা সৌন্দর্যের একনম্বর শত্রু। তারা দেখান যারা আচরণে স্বভাবে কথায় (অনিবার্যকারণে শরীরের কথা তারা উল্লেখ করেন না) সুন্দর নন তাঁরা হৃদয়েও সুন্দর নন; আর তারা ক্ষমতায় আরোহণ (আরোহণ শব্দটি লক্ষণীয়) করলে সব কিছুকে অসুন্দর করে তুলবেন। একেই দেশে সুন্দরের অত্যন্ত অভাব, আগামীতে বাকিটুকুও আর থাকবে না।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো