আমরা, জনগণরা, খেলতে পছন্দ করি; আর গণতন্ত্র হচ্ছে খুবই মজার খেলা, বাইল্যকালেও এতো মজার খেলা আমরা খেলি নাই, ডাংগুটি হাডুডু গোল্লাছুটের থেকে অনেক মজার এই গণতন্ত্র। এ-খেলারও আছে কতকগুলো সুন্দর সুন্দর নিয়ম; হাডুডু খেলায় যেমন হাডুডু কুকুৎ করতে হয়, গণতন্ত্র খেলায়ও নির্বাচন করতে হয়, কুকুৎ করতে হয়, হাডুডু করতে হয়, নির্বাচনের জন্যে প্রার্থী মনোনীত করতে হয়। এবার যখন প্রার্থী মনোনয়নের সময় আসে আমাদের ডোবার মতো দেশটি জুড়ে সাড়া পড়ে যায়, ঢেউ উঠতে থাকে; আমরা জনগণরা আমোদে আত্মহারা হয়ে যাই, কোনো রকমে বেঁচে থাকি শুধু রাজবংশগুলোকে ভোট দেয়ার জন্যে। রাজবংশগুলো তাদের প্রার্থী ঠিক করতে অর্থাৎ কারা কারা মাঠে খেলবেন অর্থাৎ প্রার্থী মনোনীত করতে শুরু করেন, আমরা চোখ বড়ো করে তাকিয়ে থাকি। তারা জিতলে রাজপুত্র হবেন, বড়ো বড়ো দালানে ঢুকবেন আর বের হবেন, বড়ো বড়ো গাড়িতে উঠবেন আর নামবেন, গাড়ির যেই দিকে বসবেন সেই দিকে পতাকা উড়াইবেন; আর তাঁদের রাজবংশ বা দল যদি জেতে, তাহলে তাদের রাজবংশ বা দলই রাজত্ব করবেন, তাদের দল থেকেই হবেন রাজা (অর্থাৎ রানী); আর তারা হবেন মন্ত্রী, অমাত্য ও কতো কিছু, যা আমরা জনগণরা জানি না। আমরা, জনগণরা, আর কতোটা জানতে পারি? আমরা তো দেশের ভেতরে নাই, আছি বাইরে। তখন তারা যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারবেন, আর আমরা তাদের লাখ রকমের করাকরি দেখে সুখে আহ্লাদে ভরে উঠবো।
আমাদের প্রতিটি রাজবংশ বা দলের আছে একটি করে বিরাট সিন্দুক; ওই সিন্দুকগুলো পরিপূর্ণ হয়ে আছে অজস্র নীতি ও আদর্শে। দুনিয়ায় যতো নীতি আর আদর্শ আছে, তার সব পাওয়া যায় ওই সিন্দুকগুলোতে। আমাদের গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো নীতি আর আদর্শ ছাড়া আর কিছু জানেন না; তাই আমাদের মতো নীতি ও আদর্শে বোঝাই জাতি আর নেই। আমাদের প্রতিটি ছিদ্রের ভেতরে ঢোকোনো আছে অজস্র আদর্শ।
আমাদের গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো নীতি-আদর্শ ও অন্যান্য মহৎ ব্যাপার বোঝানো খুবই কঠিন ব্যাপার; তারা নিজেরাও তা ভালোভাবে বোঝেন না; তাগো কাছে জানতে চাইলে বলেন, বুইঝ্যা লইয়েন। আমরা, মূর্খ জনগণরা গরিব মানুষ, কীভাবে তা বুঝি? আমাদের কয়েকটি গণতান্ত্রিক রাজবংশের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলে তাদের নীতি আর আদর্শ জ্ঞানী মানুষরা বুঝতে পারবেন।
আমাদের একখানা রাজবংশের নাম ‘শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশ বা দল’ : দেশে গণতান্ত্রিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার যে-সূত্রগুলো আমরা আগেই বলেছি, তার দ্বিতীয় সূত্রানুসারে এই সম্ভ্রান্ত দল বা রাজবংশটি প্রতিষ্ঠিত। আমাদের রাজবংশগুলোর নাম হয় ইংরেজিতে, উর্দুতে, আরবিতে, ফার্সিতে, হিব্রুতে, হটেনটটে, বুরুশাস্কিতে; এই বংশের নামটা ইংরেজিতে; বাঙলায় বললে নামটা বোঝা যায় না; মনে হয় মঙ্গোলিয়ার বা আজারবাইজানের কোনো রাজবংশের নাম বলছি। এ-রাজবংশখানি মনে করেন জনগণ হচ্ছে শক্তির উৎস, আর তারা হচ্ছেন শক্তির পরিণতি। তাঁদের এই তত্ত্বটা আমরা খুবই পছন্দ করি; উৎস হচ্ছে মূল, আর মূলই হচ্ছে আসল ব্যাপার; তাই আমরা জনগণরা হচ্ছি আসল ব্যাপার, আর ওই পরিণতিরা হচ্ছেন মেকি ব্যাপার। আমাদের এক অমর (এই শব্দটার অর্থ গত বিশ বছরে বদলে গেছে, হঠাৎ কেউ খুন হয়ে গেলে এখন তাকে আমরা অমর বলি; তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের বুড়ো ভদ্রলোক আর অমর নন, তিনি মৃত, তাঁর খুন হওয়া উচিত ছিলো) সেনাপতি এটি প্রতিষ্ঠা করে দেশে গণতন্ত্রের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন; আমরা, জনগণরা, শুনতে পাই তিনি নাকি রাজনীতিবিদদের জন্যে রাজনীতি কঠিন, আর সুবিধাবাদীদের জন্যে সহজ করে তুলতে চেয়েছিলেন; এবং সফল হয়েছিলেন।
আমরা মূর্খরা অবশ্য রাজনীতিবিদ আর সুবিধাবাদীর মধ্যে কোনো পার্থক্য বুঝতে পারি না; এইটা আমাদের দোষ, আমাদের কাছে দুইটি শব্দই সুন্দর, দুটিরই আওয়াজ মিষ্টি। তাঁর অনেক চকচকে বুট ছিলো আর ঝকঝকে কালো সানগ্লাশ ছিলো; আর যা ছিলো সেই সম্পর্কে আমরা কী জানি? আমরা মূর্খ মানুষ। তিনি মাটি কাটতে খুব পছন্দ করতেন, মাটি দেখলেই কোপাতেন; তাই সঙ্গে সব সময় একটি কোদাল রাখতেন; এক মন্ত্রী এইজন্য তাকে একখানা সোনার কোদাল উপহার দিয়েছিলেন (আমাগো দেশে সোনা ছাড়া আর কিছু নেই)। এই রাজবংশে তার সুন্দর বুট ঘিরে জড়ো হয়েছিলেন দেশের যতো প্রসিদ্ধ রাজাকার (আল্লায় তাগো ভেস্তে নসিব করুন), অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল (আমরা গরিবরা বলি অবজেনারেল), মেজর ও অন্যান্য, অধ্যাপক (কোনো দিন পড়ান নাই), আমলা (ছিএছপি, ডিএছপি, ইএছপি, এফএছপি), ডাক্তার (মানুষমারা কবিরাজ), উকিল, ব্যাংকডাকাত (ডাকাতি করে তারা নিজেরাই ব্যাংক দিছেন), মাস্টার (কোনো দিন পড়েন নাই), ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, দোকানদার, কালোবাজারি, শাদাবাজারি, আর বিভিন্ন বাম ও ডান রাজবংশ থেকে ময়লার মতো গড়িয়ে আসা স্ট্যালিন লেনিন কসিগিন মাওজেদুং ও বোচকামারাগণ। রাজবংশটির জন্ম হয়েছিলো ক্ষমতার প্রসবঘরে, তাই ক্ষমতায় থাকা তাঁদের প্রথম স্বভাব; তারা বিশ্বাস করেন তারা ক্ষমতায় থাকলেই জনগণ ক্ষমতায় আছে। তাঁরা দিনরাত গলা ভেঙেচুরে দাবি করেন তাদের অমর নেতা স্বাধীনতার ঘোষক, তিনি ঘোষণা না করলে দেশে স্বাধীনতা আসতো না, তার ডাক শুনেই স্বাধীনতা পোষা বেড়ালের মতো আসে এই দেশে; আর আমরাও না করতে পারি না। বিসমিল্লাহ এই বংশের প্রধান আদর্শ, সাফারি জ্যাকেট দ্বিতীয় আদর্শ। এই বংশখানি সব সময় ভয়ে থাকেন কখন অন্য বংশ দেশটিকে পাশের দেশের হিন্দুগো কাছে বিক্রি করে দেন। এই দলের প্রধানকে আমরা বলি মহাদেশনেত্রী।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো