আমরা, সাধারণ মানুষরা, দেখতে পাই প্রত্যেক রাজবংশে থাকেন অজস্র। রাজনীতিবিদ; এঁরা গণতন্ত্রের রাজপুত্র। পুরোনো রাজবংশগুলোর উত্থানপতনের মতো গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলোরও ঘটে উত্থানপতন; পড়ার ও ওঠার আর্তনাদ ও উল্লাস রয়েছে গণতন্ত্রেও। আমরা, জনগণরা (আমরা সংখ্যায় এতো বেশি যে দুইটি বহুবচন ছাড়া চলে না), এটা খুব উপভোগ করে থাকি। আমরা কারো পড়ে যাওয়া দেখতে যেমন সুখ পাই আবার কারো ওঠা দেখতেও তেমন সুখ পাই। রাজাদের পড়া আর ওঠা দেখা ছাড়া গরিবের আর কী সুখ?
কিছু দিন আগে পড়ে গেছেন একটি বিখ্যাত বড়ো রাজবংশ; অর্থাৎ আমরাই ফেলে দিয়েছি। আমরা, জঘন্য জনগণরা, রাস্তায় রাস্তায় মেতে উঠি তাদের ফেলে দেয়ার জন্যে, আর আমরা নিজেরা রাস্তায় লাশের পর লাশ হয়ে পড়তে থাকি, তবু ফেলবোই রাজবংশটিকে–লাশ হওয়া জনগণের, আমাদের, বিশেষ আনন্দ, এবং ফেলে দিই খালি হাতে আমরা, জনগণ, রাস্তা থেকে ঘরে ফিরি না; তবে আরেকটি রাজবংশ। সরাসরি ক্ষমতায় আসেন না, আসার নিয়ম নেই। কোন্ রাজবংশ ক্ষমতায় বসবেন, তা ঠিক করি আমরাই, রাজারা যাদের বলেন জনগণ; গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো জনগণকে, আমাদের, এই ক্ষমতাটুকু দিতে বাধ্য হয়েছেন। এটুকু ক্ষমতা না দিয়ে উপায় নেই, নিজেদের জন্যেই আমাদের ক্ষমতা দিয়েছেন, পড়ে যাওয়ার পর আমাদের দিয়েই তারা আবার উঠতে পারেন। আমরা না থাকলে তাদের ফেলতো কে, আমরা না থাকলে তাদের তুলতো কে? আমরা, জনগণ, হচ্ছি রাজার রাজা–রাজানিৰ্মাতা; যেমন রাজমিস্ত্রিরা প্রাসাদনির্মাতা।
সব রাজবংশের রাজনীতিবিদরাই বলেন, জনগণ আমাগো সম্পদ, জনগণ আমাগো অ্যাসেট, আমাগো সম্পত্তি।
এই জন্যে অর্থাৎ আমাদের ক্ষমতা বুঝে আমাদের প্রশংসা করার জন্যে আমরা, জনগণরা, খুবই কৃতজ্ঞ আমাদের রাজাদের কাছে; তাদের মহত্ত্বের কোনো শেষ নেই। আমাদেরও তাহলে দাম আছে। আমাদের রাজারা আমাদের মূল্য বোঝেন; এই জন্য আমাদের সুখের শেষ নেই। আমরা শুনেছি এটা হচ্ছে প্রশংসা করার কাল, এই কালে কেউ নিন্দা করে না; দরকার হলে খুন করে।
আমরা, জনগণরা (সম্মানার্থে বা অবজ্ঞার্থে দুই বহুবচন) চমৎকার জিনিশ, বিস্ময়কর ও আদরণীয়ভাবে আহাম্মক; একবার যাকে আমরা নামাই, নামিয়ে বিলের খলশে মাছের মতো ছড়ছড় করে সুখ পাই, কিছু দিন পর তাঁকেই আবার উঠোই, উঠিয়ে গাধার মতো সুখ পাই; আমরা নামাই এবং উঠোই। উঠোনো আর নামানোই আমাদের, আমাগো, মোগো, জনগণের, প্রধান রাজনীতিক কাজ, সবচেয়ে বড়ো বা একমাত্র অধিকার। এ ছাড়া আমাদের আর অধিকার কী? আমরা কি রাজাদের সামনে যেতে পারি? আমরা কি তাদের প্রাসাদে ঢুকতে পারি? ওই সব আমাদের না। তাঁরা মাঝেমাঝে সময় হলে আমাদের কাছে আসেন, তাঁদের দেখে আমাদের বুক ভরে ওঠে। রাজনীতিবিদগণ রাজারা জানেন আমরা, জনগণরা, একেকটি দেখতে মানুষের মতো, মায়ের পেট থেকেই বের হয়েছি, আমাদের মাথা চোখ নাক কান হাত ঠ্যাং সবই আছে, কিন্তু আমাদের মাথার ভেতরে কিছু নেই; আমরা মানুষের সমষ্টি নই, আমরা জনগণ, পত্রিকায় যে লেখে ‘লাখ লাখ জনতা’, হচ্ছি বস্তু, আমাদের ভেতরে নিহিত রয়েছে শক্তি-আগুন, ঝড়, ভূমিকম্প, ঢল, ঠাডা; তাদের জানতে হয় আমাদের ভেতর থেকে ওই শক্তি বের করে কাজে লাগানোর বুদ্ধি। তারা কখনো আমাদের ভেতর থেকে আগুন বের করেন, কখনো ঝড় বের করেন, কখনো ভূমিকম্প বের করেন; আরো কতো কী বের করেন। রাজারা জানেন আমরা জনগণরা পছন্দ করি ঠকতে, যাদের ঠগবাজিতে আমরা সবচেয়ে গদগদ হই, মনে করি এইভাবেই আমরা ঠকতে চাই, এইভাবে ঠকলেই আমরা সুখ পাবো, তাঁদেরই উঠোই আমরা।
এখন আমাদের দেশে চলছে নানা রাজবংশের ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতার পর্ব। প্রতিযোগিতা খুব জমে উঠেছে, আমরা খুব মজা পাইতেছি।
এই পর্বে দেশের রাজা হইতেছেন মহান স্বর্গীয় দেবদূতগণ।
শুনতে পাই এক কবি নাকি বলে গেছেন এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, কবিটা সত্য কথাই বলেছেন বলে মনে হয় (কবিগুলির কাজ কি সত্য কথা আগে আগেই বলে ফেলা?); আমাদের দেশটাই একমাত্র দেশ, যেখানে আছেন একদল মহান দেবদূত, অ্যাঞ্জেল, ফ্যারেশতা, যারা কখনো ভুল করেন না, পাপ করেন না, কাম করেন না অর্থাৎ নিষ্কাম, এ-পক্ষে থাকেন না, ও-পক্ষে থাকেন না, সে-পক্ষে থাকেন না, চুপচাপ থাকেন শুধু নিজেদের পক্ষে, তারাই দেবদূত, অ্যাঞ্জেল, ফ্যারেশতা। আমরা জনগণ বচ্ছরের পর বচ্ছর আমাদের চারপাশে কোনো দেবদূত দেখতে পাই না, আমাদের চোখ নেই বলে; কিন্তু যখন একটা রাজবংশ পইড়া যায়, আমরা ফালাই দেই, তখন দেখতে পাই সোনালি রুপালি পাখা মেলে স্বর্গ থেকে নামছেন দেবদূতরা। তাই দেশে অনেকেই দেবদূত হওয়ার সাধনা করছেন। কীভাবে বস্তায় বস্তায় বিশুদ্ধ দেবদূত পয়দা করা যায়, তা নিয়েও নানা চিন্তাভাবনা চলছে, কেননা চারপাঁচ বছর পর পর বহু দেবদূতের দরকার হয়, তাই দেশে দেবদূতের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা প্রয়োজন। আমরা জনগণরা শুনেছি একটি প্রস্তাব খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে যে একটি জাপানি বা মার্কিন ডিপফ্রিজের মধ্যে পাঁচ বছরের জন্যে বেছে বেছে কিছু লোককে রেখে দিতে হবে, ওই ফ্রিজের নাম হবে ‘দেবদূত ডিপফ্রিজ’, গভীর নিরপেক্ষ ঠাণ্ডায় তারা নিরপেক্ষ ইলিশ মাছের মতো থাকবেন, হয়ে উঠবেন নিরপেক্ষ দেবদূত। খুবই সুন্দর প্রস্তাব বলে মনে হয়। যখন সময় আসবে ডিপফ্রিজ থেকে বের করে তাদের হাতে দেয়া হবে দেশের রাজত্ব; কয়েক মাস ধরে রাজত্ব করবেন দেবদূতরা। স্বর্গীয় দেবদূতদের যেমন মগজ নেই, এ-দেবদূতদেরও তেমনি হয়তো মগজ নেই (এ নিয়ে তর্কাতর্কি বা বিতর্ক রয়েছে, একদল মনে করেন উন্মাদ ও শিশুদের মগজই শুধু তাদের মগজের সাথে তুলনীয়, তাই তাঁরা নিষ্পাপ); স্বর্গীয় দেবদূতদের যেমন ক্ষমতা নেই, এ-দেবদূতদেরও তেমনি কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের একটিই কাজ : কোনো একটি রাজবংশকে নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতায় বসিয়ে আবার নিরপেক্ষ সোনালি রুপালি ডানা মেলে স্বর্গে ফিরে যাওয়া; এবং দেবদূত হওয়ার গৌরব উপভোগ করা (আমরা জনগণরা দেখতে পাইতেছি যে দেবদূতরাও গভীর প্রবল প্রত্যাশায় থাকেন যে-রাজবংশটি ক্ষমতায় আসবেন, সেটি তাঁদের কোনো একটা পরিচারকের, আমরা চলতি ভাষায় বলি চাকরের, কাজ দেবেন, যাতে তারা কবরে কবরে ফুলের তোড়া দিতে পারেন, হোটেলে হোটেলে বক্তৃতা দিতে পারেন, মাসে মাসে মিলাদশরিফ পড়তে পারেন; একটি রাজবংশ তাঁদের একজনকে একটা পরিচারকের কাজ দিয়ে ধন্য করেছেন; তাঁহার স্বাস্থ্য ভাল হইতেছে, চেহারা সুন্দর দেখাইতেছে)। আমরা বুঝতে পারি রাজনীতি খুবই কঠিন, আর শয়তানদের, কাজ; দেবদূত হওয়া–আমাদের মনে হয়–সহজ, তাঁদের কাজও সহজ; রাজনীতি করলে যাদের মুখ আর দেহ হাত আর পা নানা রকম ঘায়ে আর ছুলিতে ছেয়ে যেতো, রেলইস্টিশনের কুষ্ঠরোগীর মতো দেখাতে যাঁদের, দেবদূত হয়ে তাঁরা শরীরকে রাখেন পবিত্র নির্মল, মনে হয় সারাক্ষণ পবিত্র পানিতে গোশল করছেন।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো