মোহাম্মদ ইমাজউদ্দিন ঝন্টু জিজ্ঞেস করেন, আমাগো দল হতে মন্ত্রী করা হইবো না?
শাহ আলম চৌধুরী বলেন, তা অবশ্যই করতে হইবো; আমাগো কয়জনরে মন্ত্রী করতে হইবো। যারা আমাগো মন্ত্রী করবো আমরা তাগো লগেই থাকুম; কিছু ট্যাকাপয়সাও দিতে হইবো।
মনোয়ার হোসেন বলেন, তা ডিপেন্ড করে আমরা কয়জন পাশ করি তার উপর, আমাগো কমপক্ষে পঞ্চাশটা সিট পাইতে হবে।
ব্যারিস্টার শাহেদ মিয়া জিজ্ঞেস করেন, আমরা কি এতগুলা সিট পাবো, আমাদের দলের কি অই অবস্থা আছে।
ব্যারিস্টার শাহেদ মিয়ার আজকের বৈঠকে আসার ইচ্ছে ছিলো না, তিনি আগে ছিলেন শক্তির উৎসবাদী রাজবংশে; আবার সে-রাজবংশে ফিরে যাওয়ার জন্যে তিনি গোপনে প্রাণপণে চেষ্টা করে চলছেন।
মনোয়ার হোসেন বলেন, আমাগো চ্যাষ্টা করতে হবে, উই মাস্ট ট্রাই আওয়ার বেস্ট; লিডার বাইরে থাকলে আমরাই ক্ষমতায় যাইতাম, পিপল তার জইন্যে পাগল; জ্যালে থিকাও একশোটা সিটে দাঁড়াইলে তিনি একশোটা সিটেই পাশ করবেন। কিন্তু আমাগো পঞ্চাশটা সিট পেতে হবে।
সভায় ঠিক হয় মনোয়ার হোসেন মোল্লা মহাজননেতার সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থা নেবেন।
রাজাকার রাজবংশের এক বড়ো নেতা মওলানা রহমত আলি ভিস্তিও খুবই ব্যস্ত। রয়েছেন সেলুরার (আল্লা পরম দয়ালু, যিনি মানুষরে দিয়াছেন এই পবিত্র জিনিশটি, যা নিয়ে এখন, আমরা দেখতে পাই, আমাদের গার্মেন্টস্ আর পলিটিক্সরা খুবই ব্যস্ত) পলিটিক্সে; আল্লাতাআলার রহমতে তাঁর কাছে বাতাসে ভেসে আসছে থরেথরে দলে দলে পলিটিক্স। তৃতীয় বিবি মাঝেমাঝে পান আর শরবত দিয়ে যাচ্ছেন, গিয়ে দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকছেন, আর পলিটিক্স করে চলছেন মওলানা রহমত আলি ভিত্তি। ওই যে আমাদের একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, যার কথা আমরা ভুলেই গেছি, খুব না ঠেকলে যার কথা বলতে আমরা বিব্রত হই, যার কথা বললে অন্যরা কেমন চোখে তাকায়, যাতে পাকিস্থানিরা আমাদের খুনের পর খুন করেছিলো, মাবোনকন্যাদের ঘর থেকে টেনে নিয়ে ধর্ষণ করেছিলো, কিন্তু আমরা জয়ী হয়েছিলাম যে-যুদ্ধে, ভিস্তি সাহেব সেই সময় ছিলেন এক মস্ত বড়ো রাজাকার। শুনতে পাই তিনি ছিলেন খুন আর ধর্ষণের এক বড়ো সিপাহিসালার, ইখতেয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি, আঠারো নম্বর গাধাটিতে তিনি ছিলেন, মাথার ওপর তলোয়ার লড়াইতে লড়াইতে তিনি বঙ্গদেশে। এসেছিলেন; তবে খুন হয়ে আর ধর্ষিত হয়ে আমরা মাথা নিচু করি নি (এটা কেমনে হয়েছিলো আজ আর আমরা বুঝতে পারি না, এখন তো আমরা সব সময় মাথা নিচু করেই থাকি); আমরা জয়ী হয়েছিলাম। জয়! আমাদের জীবনের একমাত্র জয়। জয়ের পর স্বাধীন হই আমরা, আর বছরের পর বছর পরাজিত হতে থাকি; এবং ভিস্তি সাহেবরা পরাজয়ের পর বছরের পর বছর জয়ী হতে থাকেন। একাত্তরের সেই বছরটিতে দেশে এতো রাজাকার ছিলো না, আর এখন আমরা চারপাশে তো দেখতে পাই রাজাকার। এখন আমরা, মূর্খ লোকেরা, দেখি আমাদের পরাজয় আর ভিস্তি সাহেবদের জয়। আমরা এখন ভয়ে ভয়ে কথা বলি, কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছি; আর ভিস্তি সাহেবরা গলা ফুলিয়ে আমাদের খুন করে ফেলার ভয় দেখান; আমরা চোখ বুজে থাকি। আল্লা তাদের খুন করার তওফিক দিয়েছেন।
রাজাকারদের নেতা হয়ে ইমানআমান তিনি প্রথমেই পরীক্ষা করেন বাসার কাজের মেয়েটির ওপর। পাকিস্থানে যার বিশ্বাস আছে, তার আবার ভয় কী, তার আবার খুন জখম জেনা করার দ্বিধা কী। শ্বশুরবাড়ি থেকে মাসখানেক আগে তিনি সালেহা নামের কাজের মেয়েটিকে এনেছিলেন; তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী, কাজকাম করতে পারে না, শুধু চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। আনার পর তিনি মেয়েটিকে মন দিয়ে ধর্মকর্ম শেখান, এবং শেখানোর সময় মাঝেমাঝে মেয়েটির বুকের কাপড়ের নিচে হাত দিয়ে শিক্ষার উচ্চতা পরীক্ষা করেন। মেয়েটি ভিস্তি সাহেবের হাত সরিয়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে ভিস্তি সাহেবের সাথে সাথে শ্লোক আবৃত্তি করতে থাকে।
একদিন তাঁর স্ত্রী গোসলখানায় ঢুকলে ভিস্তি সাহেব তাকে রান্না ঘরে চিৎ করে শোয়ানোর চেষ্টা করেন।
আমরা সাধারণ জনগণ
আমরা সাধারণ জনগণ, গরিব মূর্খ অসহায় মানুষ, সারাক্ষণ খুন হওয়ার ভয়ে আছি, এই ইতিহারে বাকিটা কি আর বলতে পারি? আমাদের কি সেই সাহস আছে? একাত্তর সালে সাহস ছিলো, তখন আমাদের মরার ভয় ছিলো, কিন্তু সাহসও ছিলো, ওই সময়টা আমাদের ছিলো; এখন আমাদের মরার ভয় আরো বেশি, কিন্তু সেই সাহস নেই, এই সময়টা আমাদের না। একাত্তরে ভিস্তি সাহেবরাও আমাদের ভয় পেতেন, আজ শুধু আমরাই তাদের ভয় পাই; তারা আমাদের ভয় পান না। হায়, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় গেলো? তারা সবাই মরে গেছে? তখন যারা যুদ্ধ করেছিলো আর এখনো বেঁচে আছে, তারা তো আর মুক্তিযোদ্ধা না। বাকিটা বললে ভিস্তি সাহেবরা আমাদের টুকরা টুকরা করে ফেলবেন না? তবে মুখে যখন ইতিহাসটা এসেই গেছে, চোখ বুজে একবার বলেই ফেলি; তাতে আমাদের শিরার ভেতরের রক্ত একটু ঠাণ্ডা হবে, একটু সাহস পাবো।
সালেহা চিৎ হতে চায় না, তবু চিৎ হতে হয়; এবং সে চিৎকার করে বলে, হুজুর, এইডা আপনে কী করতাছেন, আল্লায় দ্যাখতাছে। আপনে গুনার কাম করতাছেন, হুজুর, আমারে ছাইড়া দ্যান।
চমৎকার খুব ভাল লাগলো