ঘরে এসে গা থেকে ঘামে-ভেজা গেঞ্জিটা খুলে সেটা দিয়েই গা মুছে নিল শ্রীনাথ। প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে রইল একটু। মাথায় অজস্র চিন্তার ভিড়। কোনওটাই কাজের চিন্তা নয়। মল্লিনাথের এই ভাবন-ঘরের চারদিকেই অজস্র জানালা। আলোয় হাওয়ায় ঘরে ভাসাসি কাণ্ড। ভারী সুন্দর। কিন্তু সারাক্ষণ একটা অস্বস্তির কাটা বিধে থাকে শ্রীনাথের মনে। এ বাড়ি দাদা বানিয়েছিল, এখন এর মালিক তার বউ তৃষা। এসব তার নয়, সে এ বাড়ির কেউ নয়।
গোলপা একটা মুখ উঁকি দিল দরজায়। আবছা একটা ফেঁপানির শব্দ। আধবোজা চোখেই মুখখানা নজবে এল শ্রীনাথের। তার মেজো মেয়ে মঞ্জ।
শ্রীনাথ সোজা হয়ে বসে বলল, কী রে? কাঁদছিস নাকি?
কোনও জবাব নেই। খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে অবশেষে মঞ্জু আড়াল থেকে বেরিয়ে কপাটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। মুখ নিচু। খোলা চুল নেমে এসে খানিকটা আড়াল করেছে মুখখানা।
আগে ছেলেমেয়ের ওপর বড় মায়া ছিল শ্রীনাথের। বাড়ি ছেড়ে দূরে যেতে পারত না। এখন কে যেন আর বুকের মধ্যে তেমন ব্যাকুলতা নেই, টান নেই। ছেলেমেয়েদের দেখলে, হঠাৎ যেন মনে হয়, অন্য কারও ছেলেমেয়ে। আগে খুব মিশত ওদের সঙ্গে শ্রীনাথ, আজকাল গা বাঁচিয়ে থাকে। পারতপক্ষে ওরাও আজকাল তার কাছে ঘেঁষে না। মেয়ে দুটো তবু মাঝে মাঝে একটু-আধটু ডাক-খোঁজ করে, কিন্তু ছেলের সঙ্গে প্রায় পরিচয়ই নেই শ্রীনাথের। ছেলে সজল পুরোপুরি তার মায়ের সম্পত্তি। এইভাবে বন্ধনমুক্তি শ্রীনাথের খুব খারাপও লাগছে না।
শ্রীনাথ আর কিছু বলছে না দেখে মঞ্জু এলোচুল খোঁপায় বাঁধল, চোখ মুছল, তারপর খুব সংকোচে সাবধানি পায়ে ঘরে এসে চৌকির বিছানায় বসে বলল, তোমার এ ঘরের চাবিটা আজ আমাকে দিয়ে যাবে বাবা?
বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলে, কেন?
আমি এখানে দুপুরটা থাকব।
তাই বা থাকবি কেন? ঝগড়া করেছিস নাকি কারও সঙ্গে?
ভাই ভীষণ পাজি। সারাদিন মাকে নালিশ করে মার খাওয়ায়। আজও মা কীরকম মেরেছে দেখো। গাল এখনও ফুলে আছে দেখেছ?
দেখল শ্রীনাথ। তৃষা এরকমই মারে! শ্রীনাথ উঠে দড়ি থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে বলল, এ ঘরে তোকে খুঁজে পাবে না নাকি?
মঞ্জু সংকোচের গলায় বলে, ভাই তো তোমাকে ভয় পায়। এ ঘরে আসতে সাহস পাবে না।
এ কথায় একটু থমকাল শ্রীনাথ। এ বাড়ির কেউ তাকে ভয় পায় এটা নতুন কথা। সজল কে তাকে ভয় পায় তা বুঝতে চেষ্টা করেও পারল না। মাথাও ঘামাল না বিশেষ। বালতি মগ আর সর্ষের তেলের শিশি নিয়ে ঘবের পিছন দিকে টিউবওয়েলে যেতে যেতে বলল, চাবি রেখে দিস, কিন্তু জিনিসপত্র ঘাঁটিস না।
বিশাল উঠোন পার হয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় নিকোনো শানের মেঝেয় পরিপাটি গালচের আসনের সামনে বাড়া ভাত আর ঢাকা-দেওয়া জলের গেলাসটি সাজিয়ে রাখার দৃশ্যটি দেখলে তখনও তার সেই একটি কথাই মনে আসে। এ বাড়িতে সে বড় বেশি অতিথির মতো। তৃষার কাজ নয়, এ হচ্ছে রাঁধুনি বামনির যত্ন-আত্তি। পিছনে অবশ্য তৃষার হুকুম আছে। কিন্তু এক কালে গরিব অবস্থার সময়ে কলকাতার শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের ভাড়াটে বাসায় তৃষা নিজের হাতে বেঁধে তাকে খেতে দিত, তখনও কোনওদিন এত যত্নে ভাত বেড়ে দেয়নি।
তবে তৃষা ভাত বেড়ে না দিলেও আজ কাছেপিঠেই ছিল। শ্রীনাথ খেতে বসার পরই সামনে এসে বসে বলল, কতদিন হয়ে গেল বিলুর চিঠি এসেছে। প্রীতমবাবুর অত অসুখ, তোমার একবার দেখতে যাওয়া উচিত ছিল না? রোজই তো কলকাতা যাচ্ছ। একদিন অফিসের পর গিয়ে ঘুৱে আসতে কী হয়?
ভগ্নিপতির অসুখের খবর একটা কানে এসেছিল বটে শ্রীনাথের। অতটা গুরুত্ব দেয়নি। এখন বলল, কী অসুখ? খুব খারাপ কিছু নাকি?
তৃষা বলল, অত ভেঙে তো লেখেনি। শুধু লিখেছে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না পর্যন্ত।
শ্রীনাথ ভ্রু কোঁচকাল। কতকাল হল সে বিলুর খবর রাখে না? বছরখানেক হবে? তা হবে বোধহয়। গতবার বিলু ভাইফেঁাটায় ডেকেছিল। সেবারই শেষ দেখা। এবার ভাইফোটায় বিলুও ডাকেনি, শ্রীনাথেরও ব্যাপারটা খেয়াল হয়নি। কিন্তু প্রশ্নটা হল, এতকাল মায়ের পেটের বোনকে একেবারে ভুলে সে ছিল কী করে? শ্রীনাথ পাতের দিকে চোখ রেখেই বলল, চিকিৎসার ব্যবস্থা কী করেছে?
কী আবার করবে? স্বামীর অসুখ হলে স্ত্রীরা যেমন করে তেমনই ব্যবস্থা করেছে। নিজে গিয়ে দেখে এলেই তো হয়।
উদাস উদার গলায় শ্রীনাথ বলল, যাব।
আজই যেয়ো পারলে। দেরি করা ঠিক নয়।
আজই?–বলে ভাবল একটু শ্ৰীনাথ। কী হয়েছে তার আজকাল, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে। অভ্যস্ত জীবনের বাইরে এক পা হাঁটতে হলেও কেন যে জড়তা আসে।
কেন, আজ কি কোনও কাজ আছে?
শ্রীনাথ বলে, অফিস ছুটির পর বাসে ট্রামে বড্ড ভিড়। তার চেয়ে কোনও ছুটির দিনে–
তৃষা মাথা নেড়ে বলে, তা তুমি কি যাবে? ছুটির দিনে মানুষকে আলিস্যির ভূতে পায়। ব্যাপারটা ফেলে রাখলে আবার বছর গড়িয়ে যাবে। যেতে হলে আজই যাও। বিলুকে বোলো আমি মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে বড্ড ব্যস্ত। নইলে আমিও যেতাম।
০২. দাওয়াতে দাঁড়িয়েই ঘটিভরা জলে
দাওয়াতে দাঁড়িয়েই ঘটিভরা জলে আঁচাতে আঁচাতে খুব সাবধানে চোখের মণি বাঁয়ে সরিয়ে শ্রীনাথ তার বউ তুষাকে দেখল। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। বেশ লম্বা, প্রায় শ্রীনাথের সমান। গায়ে মেদ নেই, কিন্তু তেজালো একটা শক্তি-সামর্থ্যের ভাব আছে। গায়ের রং শ্যামলা। মুখখানাকে সুন্দর বলা যায়, কিন্তু একটু বন্যভাব আর লোভ আর হিংস্রতা মেশানো আছে। এ বাড়ির ঝি চাকর মুনিশ খামোখা ওকে ভয় খায় না। ভয় পাওয়ার মতো একটা থমথমে ব্যক্তিত্ব আছে তৃষার। এ মেয়ের বর হওয়া খুব স্বস্তির ব্যাপার নয়। শ্রীনাথ কোনওদিন স্বস্তি পায়নি। কী করে তবে এর কাছে স্বস্তি পেয়েছিল মল্লিনাথ? তুষার মুখে যে মধুর আত্মবিশ্বাস আর নিজের ধ্যানধারণার ওপর অগাধ আস্থার ভাব রয়েছে সেটা লক্ষ করলেই বোঝা যায়, সোমনাথ মামলায় হেরে যাবে। তৃষার সঙ্গে কেউ কখনও জেতেনি।