হবে হবে।
বলে নিতাই রান্নাঘরমুখো হাঁটা দেয়। সঙ্গে ইস্পাত, হাতে মুলো।
বাগানে একটা ছোট্ট পুকুর আছে। গাছে জল দেওয়ার জন্য বাবা কাটিয়েছিল। এখন তাতে কিলবিল করে আমেরিকান কই মাছ। এ বাড়ির কেউ এই মাছ খায় না। সজলের কাজ না থাকলে এসে চুপচাপ ছিপ ফেলে মাছ ধরে। পরে লুকিয়ে সেগুলো বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। কাজ নেই বলে সজল ছিপ হাতে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসল। আটার টোপ ফেলে মাছের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
বদ্রী চলে গেলে শ্রীনাথ উঠল। অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে। বেশ একটু দেরিতেই যায়, রাত করে ফেরে।
বাইরের দিকে নিজের এই আলাদা ছোট্ট ঘরখানা শ্রীনাথের একার। এ ঘরে কদাচিৎ কেউ আসে। দাদা মল্লিনাথ এ বাড়ি বানিয়েছিল নিজের পছন্দমতো। এই ঘরটা ছিল ভাবন-ঘর। চিন্তা-ভাবনা করার জন্য যে বাড়িতে একটা আলাদা ঘর থাকা দরকার এটা একমাত্র তার মাথাতেই আসতে পারে যার মাথার স্কু কিছু ঢিলে। বলতে নেই মল্লিনাথের মাথার কলকবজা কিছু ঢিলেই ছিল। বেশি বয়স পর্যন্ত ব্যাচেলর থাকলে যা হয়। অবরুদ্ধ কাম গিয়ে মাথায় চাড়া দেয়, নারীসঙ্গহীনতায় মনটা হয় ভারসাম্যহীন। পৃথিবীতে মেয়ে এবং ছেলে এই দুই জাতের সৃষ্টি যখন হয়েছে তখন তার পিছনে একটা কারণও থাকার কথা। এককে ছেড়ে আর একের কি পুরোপুরি চলে? শেষ দিকটায় মল্লিনাথের খুব সেবা করেছিল শ্রীনাথের বউ তৃষা। সেই কৃতজ্ঞতাতেই মলিনাথ তার গোটা বাড়ি সম্পত্তি সব তাকে উইল করে দিয়ে গেল। আর সেই থেকেই এ বাড়িতে পর হয়েছে শ্রীনাথ।
মল্লিনাথের এই ছোট্ট ভাবন-ঘরে সে থাকে। তার জাগতিক যা কিছু আছে সব এই ঘরটুকুর মধ্যে। তাও সব কিছু তার নিজের নয়। ওই ইজিচেয়ারটা মল্লিনাথের। লেখার ডেসকটাও তারই। দিশি মিস্ত্রি দিয়ে বানানো মজবুত চৌকিটার মালিক অবশ্য শ্রীনাথ। কিন্তু বইয়ের আলমারিটা মল্লিনাথের। এই ঘরে এই বাড়িতে বাস করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তেই শ্রীনাথের মনে হয়, সে পরের ঘরে বাস করছে। প্রতি মুহূর্তেই সে বোধ করে, এ বাড়ির দখল নিয়ে তারা ঠকাচ্ছে কাউকে।
মল্লিনাথের বিষয়-সম্পত্তির দাবিদার আরও দু’জন আছে। শ্রীনাথের ছোট দুই ভাই দীপনাথ আর সোমনাথ। দীপ অন্য ধরনের মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটন ও অঘটনের দিকেই তার ঝোক, কে কোথায় কবিঘে জমি নিয়ে বসে আছে তা তার মাথাব্যথার বিষয় নয়। দীপ অতিশয় জটিল চরিত্রের মানুষ, তাকে একদম বুঝতে পারে না শ্রীনাথ। কিন্তু ছোট সোমনাথ জটিলতার ধার ধারে না। মানুষের সহজ সরল লোভ হিংসা প্রবৃত্তির বশে সে চলে। অর্থাৎ সোমনাথ খুবই স্বাভাবিক। উপরন্তু তার ভাবের বিয়ের বউ আর শাশুড়ি তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দেয়। সুতরাং, সে প্রথম-প্রথম এসে বড়দার সম্পত্তির ভাগ নিয়ে শ্রীনাথ আর তৃষার সঙ্গে একটা রফা করার কথা বলত। শ্রীনাথ এ সম্পত্তি চায় না, তার আগ্রহ বা কৌতূহল নেই। সে থাকত চুপচাপ। সোমনাথের সঙ্গে লড়ত তৃষা একা। কিন্তু একাই সে একশো। প্রথম-প্রথম সোমনাথ নরম গরম কথাবার্তায় তুতিয়ে পাতিয়ে সম্পত্তি ভাগ করাতে চাইত, পরে সে নরম ছেড়ে গরম হল। রবিবার বা ছুটির দিনে এসে সে তুমুল ঝগড়া বাঁধাত তৃষার সঙ্গে। প্রায় সময়েই সঙ্গে করে আনত তার অল্পবয়সি প্রায় বালিকা বউকে। সে বউটিও গলার জোরে কিছু কম যায় না। কোনও পক্ষকেই কোনওদিন হার মানতে বা ক্লান্ত হয়ে পড়তে দেখেনি শ্রীনাথ। ছুটির দিন এলে পারতপক্ষে সে নিজে আর এ বাড়িতে থাকত না। দূরে কোনও গ্রামগঞ্জে চাষ-আবাদ দেখার নাম করে চলে যেত।
খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই একদিন সোমনাথের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। গত বছর শীতকালে এক রবিবারে এসে সারা দিন সোমনাথ আর শমিতা থেকেছিল এ বাড়িতে। দফায় দফায় প্রবল ঝগড়াঝাটি হল দু’পক্ষে। সন্ধেবেলা যখন স্বামী-স্ত্রী কলকাতার ট্রেন ধরতে স্টেশনে যাচ্ছে তখন বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে দু’ শো গজ যেতে না যেতেই নির্জন রাস্তায় দুটো লোক এসে ধরল তাদের। একজন শমিতাকে রাস্তার ধারে ঝোপঝাড়ের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে গয়নাগাটি কেড়ে বদ মতলবে মাটিতে পেড়ে ফেলেছিল। অন্যজন লোহার রড দিয়ে চ্যাঙা-ব্যাঙা করে পিটিয়েছিল সোমনাথকে। হাতব্যাগ, ঘড়ি, মানিব্যাগ হাপিস করেছিল। শমিতা অবশ্য চরম লজ্জাকর ঘটনাটা ঘটতে দেয়নি। তার প্রবল প্রতিরোধ আর আঁচড় কামড়ে ধর্ষণকারী লুঠেরাটি নিবৃত্ত হয়। কিন্তু সোমনাথকে দিনতিনেক হেলথ সেন্টারে পড়ে থাকতে হয়েছিল। পুলিশ সেই ঘটনায় কাউকে আজও ধরতে পারেনি। সোমনাথকে যে লোকটা পিটিয়েছিল সে লোকটা নাকি ছিল বেশ লম্বা আর দশাসই চেহারার। আর শমিতাকে যে ধরেছিল সে নাকি ছিল নরম-সরম শরীরের ছোটখাটো মানুষ। দু’জনেরই মুখে ভুষো কালি মাখা ছিল বলে ওদের ভাল বর্ণনা দিতে পারেনি শমিতা আর সোমনাথ। তবে শমিতা বলেছে, তাকে যে ধরেছিল তার মুখে পচা মাছের মতো প্রবল এক দুর্গন্ধ পেয়েছে সে। কিন্তু এই অস্পষ্ট বিবরণ থেকে কাউকে চেনা মুশকিল। শ্রীনাথ অনেক ভেবেছে, কিন্তু এ অঞ্চলের কোনও মানুষকেই ওই দুই বদমাশ বলে মনে হয়নি। তবে সোমনাথ স্পষ্টই তাকে বলেছে, এ কাজ করিয়েছে তৃষা।
শ্রীনাথের কোনও পক্ষপাত নেই। তৃষা এ কাজ করালেও করাতে পারে। তৃষার হাতে লোকের অভাব নেই। ঘরামি, মাটিকাটা মজুর, রাজমিস্ত্রি, দালাল, পলিটিকসওয়ালা, পুলিশ দারোগা সকলের সঙ্গেই তৃষা সদ্ভাব রেখে চলে। শুধু ছিনতাই করার জন্যই যদি সোমনাথ আর শমিতাকে ধরেছিল ওরা তবে খামোখা সোমনাথকে অত মারল কেন? সোম্নাথ মার খাওয়ার পর অবশ্য শ্রীনাথ তৃষাকে ভাল করে লক্ষ করে দেখেছে। কোনও ভাবান্তর চোখে পড়েনি। কিন্তু শ্রীনাথ এও জানে, মুখের ভাবে ধরা পড়ার মতো কাঁচা মেয়ে তৃষা নয়। এই পুরো জমিজমা, সম্পত্তি একা হাতে সামলাচ্ছে তৃষা। সোমনাথ মার খেয়ে ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই দাদার সম্পত্তির ভাগ দাবি করে মামলা ঠুকেছে। সেই মামলাও একা চালাচ্ছে তৃষা। আদালতে গিয়ে উইলের প্রোবেট বের করেছে। উকিলের বাড়ি যাতায়াত করছে। দরকারমতো উকিলকে পরামর্শ দিচ্ছে। এরকম বউ থাকলে মেনিমুখো মানুষের গৌরব হওয়ার কথা।