শ্রীনাথ বলে, আমি নিজে চাষ করাব। বর্গাদার দিয়ে হবে না।
সে আপনি করুন না! বর্গার আইন তো তাতে পালটে যাচ্ছে না। চাষ আপনি করালেও সেই তে-ভাগাই হবে। বর্গা পাকা খুঁটি।
শ্রীনাথ সবই জানে। গভীর শ্বাস ফেলে বলল, এ তো ধান চাষ নয়। আমি করব ভেষজের চাষ।
উকিলবাবুকে সব বলেছি। উনি বললেন, হওয়ার নয়।
বর্গাদার কে? দেখা করেছিলি তার সঙ্গে?
সে এক তেরিয়া ধরনের ছেলে। তবে বলছিল, প্রমথবাবুর কাছ থেকে হাজার পাঁচেক টাকা পেলে আদালতে গিয়ে বলবে যে, চাষ সে করত না। কিন্তু উকিলবাবু সেই ফঁদে পা দিতে নিষেধ করেছেন। ওরা যখন-তখন কথা পালটায়। টাকা খাওয়ার পর আদালতে দাঁড়িয়ে উলটো কথা বললে কিছু করার থাকবে না।
শ্রীনাথ খানিক ভেবে বলে, তুই বরং কোনও চাষির জমি দ্যাখ, যে নিজে চাষ করে। বর্গার গন্ধ যেন না থাকে।
বদ্রী মাথা নেড়ে বলে, সে দেখব। কিন্তু কাছে-পিঠে হবে না।
দুরেই যাব।
অনেক দূর হলেও যাবেন? সেখানে নিজে গিয়ে চাষ করানো মানেই স্থায়ীভাবে থাকা।
থাকতে তো হবেই।
চাষ করাবেন বলছেন, তার মানে তো আবার সেই বর্গার খপ্পরে পড়ে গেলেন।
চাষ করাব না। ভাবছি নিজেই করব।
হাল গোরু সব কিনবেন? তার ওপর বলদের দেখাশোনা, লাঙলের মেরামতি, আরও কত কী সব করতে হবে। চাকরি করে কি পারবেন অত সব?
পারব। চাকরি করার ইচ্ছে থাকলে আর জমি করতে যেতাম নাকি? ভেষজের চাষে লাভও যেমন, তেমনি লোকের উপকারও হবে।
বদ্রী চারদিক দেখে নিয়ে নিচু গলায় সাবধানে বলে, বউঠান সঙ্গে যাবেন বলে তো বিশ্বাস হয়। সেখানে একা থেকে অসুখে পড়লে?
শ্রীনাথ চায়ের খালি কাপটা প্লেটের ওপর উপুড় করে ঘোরাতে ঘোরাতে হেসে বলে, এখানে অসুখ করলেই বা দেখছেটা কে? এখানেও একা, সেখানেও একা। তুই দ্যাখ।
দুধের মধ্যে সর ভাসলে ভারী ঘেন্না পায় সজল। রোজ তার দুধ ছাঁকনিতে ভাল করে ছেঁকে দেওয়া হয়। আজও তাই দিয়েছিল মেজদি মঞ্জুলেখা। তবু এক কুচি সর কীভাবে রয়ে গিয়েছিল তাতে। ওয়াক তুলে খুব চেঁচামেচি করেছে সজল। তাইতেই মায়ের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছে মেজদি।
শোওয়ার ঘরের মস্ত বিছানাটা বলটান দিয়ে রাখা হয়েছে। পাহাড়-প্রমাণ উঁচু সেই বিছানা আর খাটের বাজুর মধ্যে যে খাজটুকু, সেইখানে উপুড় হয়ে পড়ে কাদছে মঞ্জুলেখা। মায়ের চিমটিতে তার ডান গাল ফুলে লাল হয়ে লঙ্কাবাটার মতো জ্বলছে। এই গাল নিয়ে সে লোকের সামনে বেরোয়। কী করে এখন? তাই এক পুকুর দুঃখের মধ্যে ড়ুবে কাদছে মঞ্জুলেখা। এ সময়ে খিচ করে চুলে একটা টান পড়ল। একবার। দু’বার। দূর থেকে সজল ছিপ ঘুরিয়ে বঁড়শি মারছে, চুলে। মুখটা তুলে মঞ্জুলেখা বলল, মরিস না কেন তুই?
সজল ছিপটা সামলে নিয়ে হি হি করে হেসে বলল, মাকে গিয়ে বলে দেব?
বল গে যা। কচু করবে।
যাচ্ছি তা হলে। বলব, মেজদি আমাকে বলেছে তুই মর।
সজল ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বিছানার খাঁজ থেকে উঠে পড়ল মঞ্জুলেখা। তাড়াতাড়ি এলো চুলে খোঁপা বেঁধে নিল। চুপিসারে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তারপর মস্ত বাগানের গাছপালার মধ্যে পালিয়ে গেল।
সজল মায়ের কাছে নালিশ করবে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল উঠোনে। উঠোন পেরিয়ে বান্নাঘরে যেতে যেতে আকাশের ঘন নীলের দিকে চাইল। দেখল শীতের অফুরান রোদে ঘর ছেড়ে বেরোনোর ডাক। আস্তে আস্তে শ্লথ হয়ে গেল তার পা।
বাগানের চারধারে শক্ত বেড়া আছে। উঠোনের চারধারে আছে নিচু ঘের-পাঁচিল। ফটক ঠেলে খ্যাপা-নিতাই ঢুকে এল। বাগান থেকে সদ্য তুলে আনা একটা মস্ত রাঙা মুলো তার হাতে। সঙ্গে ইত। চেঁচাতে চেঁচাতে বলছে, গরম রুটি ডাল আর কাঁচা মুলো… ডাল রুটি কাঁচা মুলো, এর
ওপর কথা হয় না।
নিতাইয়ের ওপর এ বাড়ির কেউ খুশি নয়। একটা বাড়তি লোক খামোখা ঘাড়ের ওপর বসে খায়, থাকে। মন করলে কিছু কাজে আসে, পাগলামি চাড়ান দিলে কেবল বসে বক বক করে। রোজ রাতে পুতুলরাণীর একটা ছবি আঁকে কাগজে। তারপর মন্ত্র পড়ে বাণ মারে।
নিতাইকে ভারী ভাল লাগে সজলের। এই একটা লোক যার কোনও সময়েই কোনও কাজ থাকে, যাকে যখন খুশি ডাকলেই পাওয়া যায়, যার কাছে মনের কথা যা খুশি বলা যায়। সংসারে আর সবাই ভারী ব্যস্ত, সকলেরই ভারী তাড়া, নিজের গম্ভীর বাবার কাছে কখনওই প্রায় ঘেঁষতে পারে না সে। সবচেয়ে ভালবাসে যে মা, সেও চৌপর দিন সংসারের হাজারও কাজে ব্যস্ত থাকে বলে তেমন পাত্তা দিতে চায় না। সে শুনেছে যখন তারা খুব গরিব ছিল তখন বড়দি চিত্রলেখাকে পুষ্যি নিয়েছিল মেজমাসি। বড়দি সেই মাসির কাছে এলাহাবাদে থাকে। তাকে ভাল করে দেখেইনি সজল। আর দুই দিদির সঙ্গে ভাল বনিবনা নেই সজলের। মেজদি আর ছোড়দি দুজনেই হিংসুটির হদ্দ। মা সজলকে কিছু বেশি ভালবাসে বলে ওরা তাকে সহ্য করতে পারে না। তবে ভয় পায়।
খ্যাপা নিতাইয়ের খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরের দিকে হন্যে হয়ে যেতে যেতে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সজলকে দেখে বলল, আজ মদন ঠিকাদারকে খুব বকে দিয়ে এসেছি। পালপাড়ার জমি গায়েব করে রাস্তা বানাচ্ছিল।
সজল সঙ্গ ধরে বলল, আজ কোথাও নিয়ে যাবে নিতাইদা?
নিতাই আড়চোখে চেয়ে বলে, যাবে কোথায়? চারদিকে ট্যাম-গোপাল বসে আছে। ধরবে।
হি হি করে হাসে সজল। ট্যাম-গোপালের গলায় মত্ত ঘ্যাঘ। তাই দেখে সজল ভয় পেত বরাবর। ওই ঘ্যাঘের জনাই গোপালের নাম হয়েছিল ট্যাম-গোপাল। তার নাম করে সজলকে এতকাল ভয় দেখিয়ে যা করার নয় তাই করিয়ে নিয়েছে বাড়ির লোক। কিন্তু সজল যে আর অত ছোট নেই তা সবাই এখনও তেমন বুঝতে পারে না। সে বলল, টাম-গোপালের সঙ্গে আমার কবে ভাব হয়ে গেছে। চালাকি কোরো না নিতাইদা, আজ নদীর ধারে কাঁকড়া খুঁজতে যাব।