নেতা হওয়ার মতো সুখ ও স্বাদ ও কাম আর নেই।
শুধু ক্ষমতা নয়, ক্ষমতার মধ্যে যা শ্রেষ্ঠ— টাকা, তা আমার হাতে অঢেল আসতে থাকে–টাকা যে পানির স্রোতের মতো নানা খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা আগে আমি জানতাম না, এখানে এসে দেখি নানা খাল দিয়ে ঢেউ তুলে টাকা আসছে আমার দিকে। ক্ষমতা ও টাকা মানুষকে মহাপুরুষে পরিণত করে, অমরতা দেয়। মার্ক্সবাদে আমার পকেটে একটা আধুলিও আসতো না, সর্বহারা ডাকাতির সময় আসতো দু-তিন হাজার টাকা, কিন্তু তখন সব সময় বিপদের ভয়ে থাকতে হতো, এখন কোনো ভয় নেই; এখানে নেতা হওয়ার পর আমার হাতে আসতে থাকে লাখ লাখ টাকা। টাকা যে কতো সুন্দর, রূপসী, শাশ্বতী, তা আমি বুঝতে পারি নেতা হওয়ার পর থেকে; অস্ত্ৰ কেনার পর, ইছলামের সিপাহিদের টাকা দেয়ার পর, আমার বাক্সে পড়ে থাকতে শুরু করে লাখ টাকা। আল্লা আর পাক স্তান ছাড়া এতো টাকা আমাকে কে দিতে পারতো?
টাকা পেয়ে আমি একবার নফল নামাজ পড়ি, প্রতিদিনই পড়তে হয়; পড়ে আমি সুখ পাই। দিলে শান্তি পাই। আর আসতে থাকে ব্ল্যাক লেভেল, সিভাস রিগাল, ব্যালেন্টাইন–এগুলোর নামও আগে আমি শুনি নি; সাম্যবাদের কালে মেথরূপট্টিতে যেতাম ব্যাটারি ভেজানো ধেনো খেতে, ওগুলো খাওয়ারও পয়সা ছিলো না; না থেকে ভালোই হয়েছে, বেশি খেলে এতোদিন থাকতাম না, লিভার সিরোসিসে চলে যেতাম। এখন ব্ল্যাক লেবেল, সিভাস রিগাল, ব্যালেন্টাইন ছাড়া অন্য সব আমার কাছে ভিখিরির লাল মূত্ৰ মনে হয়।
আমরা দুটি অসামান্য কর্মকাণ্ড গ্ৰহণ করেছি, যা দেশকে বদলে দেবে।
আজকে আমাদের আন্দোলন ‘ভৈরব’ উপজেলার নাম বদলের; আগামীকাল আন্দোলন ‘শ্যামসিদ্ধি’ গ্রামের নাম বদলের; আমরা দুনিয়াকে খোলনলচেসহ বদলে দেবো। ভৈরব আর শ্যামসিদ্ধি দুটি নামই আমার ছেলেবেলা থেকে প্রিয়, কিন্তু তাতে কি, ভৈরব আর শ্যামসিদ্ধি দুটিই পৌত্তলিক নাম, মালাউন নাম, এই নাম আমি আর মানতে পারি না, এটা শিরক; আর শ্যামসিদ্ধির ওই মঠটি, যেটিকে দূর থেকে একবার না দেখলে ছেলেবেলায় আমার ঘুম হতো না, ওটিকে আমার মনে হয় ইছলামের ওপর পাক স্তানের ওপর আমার দিলের ওপর একটা শরকির আঘাতের মতো, লাৎ মানৎ উজ্জা যেনো এখন কাবাঘর ছেড়ে এসে বাস করছে মঠটিতে–মঠটি ভেঙে একটি মসজিদ তৈরি করতে হবে; ওখানে আমি একটি আল আকসা বা বায়তুল মোকাররাম দেখতে চাই।
ওই মঠটির দিকে তাকালি আমার এক সময়ের প্রিয় পরম শ্রেদ্ধেয় মহান অদ্বিতীয় সানগ্লাস জেনারেল নেতাকে মনে পড়েন। তিনি আমার হৃদয়ে সব সময় আছেন, সব সময় থাকবেন। আমি তাঁর দলে যোগ দিই নি, দিতে পারি নি, দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার সাম্যবাদী নেতাদের পায়ের চাপে বারবার পিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম; তিনি পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আমরা কঁপিছিলাম, তিনি হঠাৎ বক্তৃতা বন্ধ করে ডান হাতের তর্জন আমাদের বায়তুল মোকাররামের দিকে স্থির করে রাখেন।
তিনি স্তব্ধ হয়ে থাকেন কয়েক মিনিট, আমরাও স্তব্ধ হয়ে যাই, তাঁর আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকি, নিশ্চয়ই ওই আঙুলি কোনো গভীর বাণী প্ৰকাশ করছে।
তিনি স্তব্ধ হয়ে থাকেন কয়েক মিনিট, আমাদের মনে হয় তিনি হাজার হাজার বছর ধরে স্তব্ধ হয়ে আছেন, তার বদলে কথা বলছে তার জ্যোতির্ময় তর্জানি। আমি তাঁর তর্জনির ভাষায় কাঁপতে থাকি। সব কিছুরই ভাষা আছে; কিন্তু তর্জন যে এতো অর্থ প্ৰকাশ করতে পারে, যে-অর্থ আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হচ্ছিলো না, ওই বিরাট নীরব নিঃশব্দ অর্থের মুখোমুখি আমরা নিজেদের অসহায় বোধ করছিলাম—মহাঅর্থের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
এক সময় তিনি বলে ওঠেন, ‘চ্ছি-ল-না।’
আমরা বিস্মিত শিহরিত উত্তেজিত হয়ে ভাবতে থাকি কী ছিলো না?
আমরা কী ক’রে জানবো?
তিনি বলেন, ‘চ্ছি-ল-না, আল্লাহু আকবর ছিল না; বায়তুল মোকাররামের উপরে আপনারা যে ‘আল্লাহ আকবর’ দেখতেছেন, তা ছি-ল-না; আল্লাহু আকবর ওয়াজ নট দেয়ার।‘
আমাদের বুক থেকে একটি পাহাড় নেমে যায়, আমরা নিশ্বাস নিই।
আমরা বোধ করি তিনি কতো মহান, কতো অসাধারণ, তিনি কতো বড়ো দ্রষ্টা; আমাদের সবচেয়ে বড়ো জিনিশই ছিলো না আমাদের সবচেয়ে বড়ো জিনিশের ওপর, আমরা বুঝতে পারি নি, বুঝেছিলেন আমাদের মহান নেতা, সানগ্লাসের ভেতর দিয়েও তিনি তা দেখেছিলেন। তাঁর সানগ্নাস ছিলো দূরদৃষ্টির সানগ্লাস, পৃথিবীতে ওই সানগ্লাস একটিই ছিলো।
সত্যিই তো, এতো দিন আমরা খেয়াল করি নি, বায়তুল মোকাররামের ওপর আল্লাহ আকবর ছিলো না; মহান নেতার তা চোখে পড়েছে, তিনি সেখানে আল্লাহ আকবর বসিয়েছেন, যা রাতে জ্বলজ্বল ক’রে জ্বলে রাহমানির রাহিমের গৌরব ঘোষণা করছে; মহান নেতা ইছলাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন; তার থেকে বেশি। প্রতিষ্ঠিত করেছেন আমাদের। মহান আল্লাতালা এখন নিশ্চয়ই তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে রেখেছেন। তিনি হয়তো সেখানেও সানগ্লাস পরে তাকিয়ে আছেন। তার প্রতিষ্ঠিত আল্লাহু আকবরের দিকে, আর আমাদের দিকে, আমরা যারা পাক স্তান প্রতিষ্ঠা করবো, পাক সার জমিন গাইবো।
ওই ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে আছে; আমি শ্যামসিদ্ধির মঠটি ভেঙে ফেলবো, বা সেটিকে মসজিদ বানিয়ে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখবো ‘আল্লাহ আকবর’, যা মহান রাহমানির রাহিমও দেখতে পাবেন। তিনি অবশ্য সবই দেখেন, একটি পোকাও তাঁর চোখের বাইরে নয়।