ওগুলোর আমার আর দরকার নেই; আমাকে যারা খুঁজবে, ওগুলো তাদের দরকার হবে।
কণকলতাকে বলি, ‘তোমার বোরখাটা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দাও।’
বোরখাটা অন্ধকারের থেকে কালো, ওটি অন্ধকারে মিশে যায়।
অন্ধকার, কিন্তু অন্ধকারে আমি আলো দেখতে পাই, গাড়ি চলতে থাকে।
কণকলতাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কণকলতা বলে, ‘ওই আমাদের বাড়ি।’
আমি বলি, ‘কণকলতা, তুমি তোমাদের বাড়িতে ফোন করো।’
কণকলতা ফোন ক’রেই বলে, ‘মা, আমি কণকলতা।’
ওর মা বলে, ‘কণকলতা, তুই কোন হানে?’
কণকলতা বলে, ;’মা, আমি আমাগো বাড়ির পাশ দিয়া তোমাগো জামাইয়ের লগে যাইতে আছি।‘
ওর মা বলে, ‘জামাইরা লাগে? জামাই কে?’
কণকলতা বলে, ‘মা, তুমি কতা কও জামাইর লগে।’
আমি ফোন নিয়ে বলি, ‘আদাব।’
ওর মা বলে, ‘অ, আপনে হুজুরে আমার কণকরে বিয়া করছেন?’
আমি বলি, ‘আমি আর হুজুর নই। কণকলতা আমার বউ। ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি, চিন্তা করবেন না।’
ওর মা বলে, ‘কই লইয়া যাইতে আছেন?’
আমি বলি, ‘তা ঠিক জানি না।’
ওর মা বলে, ‘জামাই, কণকরে আমি ভগবানের নামে আল্লার নামে আপনের হাতে দিলাম, অরে আপনে দেইক্যা রাইক্যেন, ও আমার পুন্যিমার চান।‘
আমি বলি, ‘কণকলতাকে আমাকে কণকলতার নামেই দিন, আর কারো নাম লাগবে না, কণকলতা আমার কাছে পূর্ণিমার চাঁদের থেকেও বেশি।
কণকলতা আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, ‘মা, আমার লিগা চিন্তা কইরো না, আমি ভাল থাকুম, তোমার জামাই বাচলে আমি বাচুম।’
ওর মা বলে, ‘তোমরা বাইচ্যা থাকে।’
অন্ধকারের ভেতর দিয়ে গাড়ি ছুটে চলছে, আমি জানি না কোথায় যাচ্ছি, কিন্তু আমি যাচ্ছি, নরক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি, এতেই আমি সুখ পাচ্ছি; আমার পাশে, আমার সঙ্গে, কণকলতা–আমার চারপাশে সবুজ বাঙলাদেশ। অন্ধকারে দু-পাশের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি। আমার ডানে সবুজ, আমার বাঁয়ে সবুজ, আর কণকলতা; একটি নদীর ওপর দিয়ে চলছি, তার নাম জানি না, নামটি আমার জানতে ইচ্ছে করে, হয়তো তার নাম স্বপ্নমতি, বা স্বপ্নেশ্বরী, ব্রিজটাকে আমার খুব আপন মনে হয়, এটি আমাকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে, নদীটিকে মনে হয় আমার হৃদয়ের মতো, কণকলতার কোমল দেহখানির মতো; কণকলতাকে বলি, ‘তুমি ডান হাতটি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে রাখো’, কণকলতা আমাকে জড়িয়ে রাখে কোমল স্বৰ্ণলতা দিয়ে; আমাকে অনেক দূরে যেতে হবে, জানি না কোথায়, ওরা আমাকে খুঁজবে, আমাকে হয়তো বাঁচতে দেবে না, তবু আমি আর ওদের হিংস্রতার নই, পিস্তলের নই, কাটা রাইফেলের নই, ক্ষুরের নই; আমি আর জামাঈর নই; গাড়ি এঁকেবেঁকে চলছে, অন্ধকারের ভেতর দিয়ে, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি সবুজ খেত, রুপোলি নদী, আকাশে অষ্টাদশীর চাঁদ, আমি দেখতে পাচ্ছি বাঁশবন, হিজলগাছ, শিমুলগাছ, জলের দিঘি, হয়তো তাতে ফুটে আছে লালপদ্ম, শ্বেতপদ্ম, হয়তো শাপলা-পদ্ম, তোমরা ফুটে থাকো, শাপলা, তুমি ফুটে থাকো; কণকলতা বলে, ‘পতিমণি, এতো সুখ। কখনো পাবো, জীবনেও ভাবি নি, সুখে আমার ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে’; আমি বলি, ‘সুখে আমার বেঁচে উঠতে ইচ্ছে করছে, কণকলতা; আমি কণকলতার তাঁতের শাড়ির সুগন্ধ পাচ্ছি, অবর্ণনীয় একটি সুগন্ধ, মা যখন নতুন তাঁতের শাড়ি পরতো, তখন যে-গন্ধ পেতাম, সে-সুগন্ধ আমি পেতে থাকি, বহুদিন পর সে-সুগন্ধ দিচ্ছে আমাকে কণকলতা; আমি বলি, ‘বউমণি, তোমার শাড়িটির আঁচল আমার নাকের কাছে ধরো, এটির সুগন্ধ আমাকে বাঁচিয়ে তুলছে, কণকলতা আচলটি তার সুগন্ধি হাতে আমার নাকের কাছে ধরে, আমি সুগন্ধে ভ’রে উঠি; কণকলতা বলে, ‘পতিমণি, তুমি আমার হাতের আমার হাতের তালু আর আঙুল আজ দেখো নি, অন্ধকারে এখন দেখতে পাবে না, একবার আমার হাতের তালুর সুগন্ধ নিয়ে বলো দেখি কিসের গন্ধ; কণকলতা তার দু-হাতের তালু আমার নাকের ওপর রক্তপদ্মের মতো রাখে, অন্ধকারেও আমি তার হাতের রঙ দেখতে পাই, সুগন্ধে আমার বুক ভরে ওঠে; কণকলতা বলে, ‘পতিমণি, আমি জানতাম আজ আমি তোমার বউমণি হবো, তোমার বউমণি হওয়ার জন্যেই আমি জন্মেছি, তাই হাতে মেহেদি মেখেছি, কাল দেখবে হলুদের রঙে আমার শরীর কেমন সোনা হয়ে আছে, পতিমণিকে বরণ ক’রে নেয়ার জন্যে আমি সব করেছি, নিজেকে আমি কণকলতা ক’রে তুলেছি’; আমি বলি আমি বলি, ‘এক কোটো সিঁদুরও নিয়ে এলে ভালো হতো, বউমণি’; কণকলতা হেসে বলে, ‘তাও নিয়ে এসেছি, পতিমণি, তুমি বিছমিল্লা বলে আমাকে সিঁদুর পরিয়ে দেবে, কপাল থেকে সিঁথির ওপাশ পর্যন্ত’; আমি গাড়ি চালিয়ে চলেছি, নদী, মাঠ, খেত পেরিয়ে যাচ্ছি, দু-দিকে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি আমার সোনার বাঙলাকে, আমার বা পাশে আমার কণকলতা, আমাদের চারদিকে আমার সোনার বাঙলা; কণকলতা বলে, ‘চারপাশ কী সবুজ; আমি বলি, ‘অন্ধকারেও তুমি সবুজ দেখতে পাচ্ছো’; কণকলতা বলে, ‘পাতিমণি, তুমিও সবুজ দেখতে পাচ্ছো’; তখন ভোর হয়ে এসেছে, এক অরণ্যের পাশে সমুদ্রতীরে আমি গাড়ি থামাই, কণকলতাকে বুকে ক’রে নামাই, সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নিজেদের জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে খেতে দেখি সমুদ্রের ভেতর থেকে সবুজের মাঝখানে একটি লাল টকটকে সূর্য উঠছে।
(সমাপ্ত)