একটা আস্ত উলুক দেখার সুখ পাওয়া গেলো। একটা আস্ত উল্লুককে, আমুণ্ডু উল্লুকের মতোই দেখাচ্ছে ওটাকে–আচ্ছা, উলুক কাকে বলে?–না একটা অবসরগ্রস্ত অবসাদগ্রস্ত উল্লুককে চাকর হিশেবে পেয়ে গেছে ভাঁড়টা, বাঙলায় কী যেনো একটা গান আছে, তোমার বিচার করবে যারা। পাবেই তো, কেনো পাবে না, চাইলে সে দশটা পেতে পারতো, কিন্তু দশটা চাইতে পারছে না এ-মুহূর্তে, তার একটাই লাগবে এখন,-উল্লুকের অভাব নেই উলুকমুলুকে, আপাতত তার একটা উল্লুকই দরকার, যে তার জুতো সাফ। করবে, তাকে জুতো পরিয়ে দেবে, আন্ডারওঅ্যার খুলে দেবে, পা টিপে দেবে, তাকে, এবং বাঙালিকে, তামাসা দেখাবে। বাঙালি বড়োই তামাসা পছন্দ করে। উলুকটা শপথ নিচ্ছে, কঁধজোড়া ঝুঁটিপরা আরেকটা তাকে পবিত্র কাজের মতো শপথ করাচ্ছে, আহা, ওরা পবিত্রতা-অপবিত্রতার পার্থক্য বোঝে না। ওরা না শপথ করেছিলো সংবিধান না কী যেনো রক্ষা করার, এখন ওরা কী করছে তা কি বুঝতে পারছে ওরা? ওদের হাতের কাগজে বাঙলায় যা লেখা, আর ওরা যা পড়ছে, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন; ওরা বলছে আমি শপথ করছি যে ভাঁড় আমাকে পা টিপতে বললে আমি পরম ভক্তিতে পা টিপবো, যদি আমাকে আন্ডারওঅ্যার ধুয়ে দিতে বলেন, আমি তা পবিত্র কাজ বলে সম্পন্ন করবো, যদি আমার প্যান্ট খুলতে বলেন, আমি তা পরম সন্তোষের সাথে সম্পাদন করবো। উল্লুক দুটি কি আন্ডারওঅ্যার পরেছে? দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে রাশেদের মনে হলো ওদের আন্ডারওঅ্যার খুব ঢিলে হয়ে গেছে, দুটিরই হোল আন্ডারওঅ্যারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে ঢলঢল করে ঝুলছে, বারবার রানে পেন্ডুলামের মতো ঘা দিচ্ছে; ঢুশটুশ আওয়াজ হচ্ছে। ভাঁড়টা শপথের দৃশ্য দেখে হাসছে তৃপ্তির সাথে, একটা উপযুক্ত চাকর পাওয়ার দৃশ্যটা তার খুবই উপভোগ্য লাগছে, হয়তো ভাবছে ভবিষ্যতে এমন আরো কতো চাকর শপথ নেবে তার আন্ডারওঅ্যার পরিষ্কার করার। চাকর বানানোর উৎসবে অনেকেই, দুটি বাতিল রাষ্ট্রপতিও, এসেছে, একটা গোলগাল কচ্ছপ আরেকটা লিকলিকে শুকনো, তেঁতুল, দেখে মনে হচ্ছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির গৌরবে তারা ঝলমল করছে। এ-দৃশ্য দেখে অন্যান্য উন্মুকদের কেমন লাগছে, ভাবতে চাইলো রাশেদ, নিশ্চয়ই তাদের কলজে। টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষে উলুকটা খুব একটা ভাব করে বেরোনোর। ভঙ্গি করার চেষ্টা করছে, তবে আণ্ডারওঅ্যার-পেরোনো ঢলঢলে হোল নিয়ে খুব অস্বস্তি বোধ করছে, সম্ভবত ঢুশদুশ শব্দটা তাকে কাতর করে ফেলেছে। রাষ্ট্রপতির হোল থাকা অত্যন্ত অস্বস্তিকর। এখন ওটা যাবে কোন নরকে? প্রথমে ভাঁড়টার পা টিপবে; তারপর কয়েকটি মাজারের উদ্দেশে বেরোবে, গিয়ে ইটসিমেন্টকংক্রিটকে বলবে দেখো, আমি কী চমৎকার চাকর হয়েছি, তোমাদের জন্যে ফুল নিয়ে এসেছি, যদিও ফুলটুলের অর্থ আমি বুঝি না, তোমরাও বুঝতে না।
বাঙলাদেশ, তুমি কেমন আছো, সুখে আছো না কষ্টে, নাকি তুমি এসবের বাইরে চলে গেছো, তোমার ভূমিকা শুধু চিৎ হয়ে থাকা, কে চড়লো তাতে তোমার কিছু যায় আসে না, সরাসরি বাঙলাদেশের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে রাশেদের। বাঙলাদেশ কোনো উত্তর দিচ্ছে না, সে কি বলাৎকারে বলাকারে অচেতন হয়ে আছে, তার রান। বেয়ে রক্ত ঝরছে; রাশেদ শুধু তার তলপেটে মরা জলপ্রপাত নিয়ে স্তব্ধতার স্বর শুনছে। খুব কি আহত হয়েছে বাঙলাদেশ, তার বুক কি কুমড়োর মতো ফালি ফালি হয়ে গেছে, গণতন্ত্র হারিয়ে চঁচামেচি করছে কি তার কলজে; না খুশিতে বারবার মুড়ি ভাজছে, আদার কুঁচি আর কাঁচা মরিচ ছিটোচ্ছে, আর কড়া চা খাচ্ছে? একটা সন্দেহ জেগে উঠলো রাশেদের মনে, নিজেরই সম্পর্কে, পিতার সম্পর্কে, যে-গোত্রের সে-অংশ, সে-বাঙালি মুসলমান নামের হনুমানদের সম্পর্কে। ক-গেলাস গণতন্ত্র আর স্বাধীনতা সহ্য করতে পারো, বাঙালি মুসলমান, জিজ্ঞেস করলো রাশেদ, তোমার শেকড়টা কোথায়, কতোদূর শেকড় তুমি ছড়িয়েছে মাটির ভেতরে, মানুষের ভেতরে, সভ্যতার ভেতরে? বাঙালি মুসলমান, তুমি কি সভ্য, যদি তাই হও তাহলে তুমি এতোদিন। পাকিস্থানে রইলে কেমন করে? দোজগে থাকাও অস্বাভাবিক মনে হয় না রাশেদের কাছে, শুধু অস্বাভাবিক পাকিস্থানে থাকা। রাশেদ অনেকবার বমি করেছে দুটি গান গাওয়ার পর; ইস্কুলে ‘পূরব বাঙলার শ্যামলিমায় পঞ্চনদীর তীরে অরুণিমায়’ গাওয়ার পর তার বমি পেয়েছিলো, তারপর ‘পাক সরজমিন সাদবাদ’ গেয়ে বমিই করে। ফেলেছিলো। আসলেই কি বমি করেছিলো সে, নাকি ওই গান গাওয়ার সময় তার যে বমি পায় নি, এতে এখন তার বমি পাচ্ছে? রাশেদ জিজ্ঞেস করতে থাকে, যারা। পাকিস্থানের সাথে থাকতে পারে, ওই গান গাইতে পারে, তারা যুদ্ধ করলেও স্বাধীন হয়ে গেলেও দেশ সৃষ্টি করলেও তাদের সম্বন্ধে সন্দেহ থেকেই যায়। বাঙালি মুসলমান আমি তোমার সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করি, চিরকাল পোষণ করবো। রাশেদ জিজ্ঞেস করতে থাকে, মার্চের শেষরাত্রে ভাঁড়গুলো কি হঠাৎ এসেছে, বাঙালি মুসলমান, তুমি কি এদের জন্ম দাও নি, আসার পথ বানাও নি? রাশেদ জিজ্ঞেস করতে থাকে, তুমি বাঙালি মুসলমান নও, বাঙালি? হা, হা করে হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো রাশেদের; হিন্দুগুলোও যেখানে মুসলমান হয়ে উঠেছে, কী চমকার সালামালাইকুম দেয়, পাঁচকলমাও মুখস্থ বলতে পারে, আর সেখানে মুসলমান, যে লুঙ্গির নিচে হাত দিয়ে খোঁজে আত্মপরিচয়, সে হয়েছে বাঙালি! যেগুলোকে খোয়াড়ে ভরে ভাড়েরা এলো, সেগুলো কি গণতন্ত্র দিয়ে দেশ বাঁধাই করে দিয়েছিলো, স্বাধীনতায় গোলা ভরে দিয়েছিলো? ওদের প্রত্যেকের কি ফাঁসির দড়ি প্রাপ্য নয়? রাশেদের তলপেটে খুব চাপ পড়ছে, সে বারবার বাথরুমে যাচ্ছে তার যেটা মাননিঃসরণ তাও ঘটাচ্ছে, কিন্তু চাপটা অটল থাকছে।