পাগলটিকে চাবুক মারার পর সারা এলাকায় চাপা ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে; ইউনিয়ন। বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও দোকানদারদের চাবুক মারায় লোকজনের মুখে যে-খুশির ঝিলিক দেখা গিয়েছিলো, তা মিলিয়ে যায়, এবং তারা পরস্পরের সাথে দেখা হলেই এ-বিষয়ে গোপনে আলাপ করতে থাকে। তাদের প্রিয় পাগলকে যারা চাবুক মেরে রাস্তায় ফেলে রাখতে পারে, নির্দ্বিধায় কেটে ফেলতে পারে তার জট, তাদের সম্বন্ধে বেশ ঘন একটা সন্দেহ দেখা দেয়। রাশেদদের বাড়িতে যে-বুড়ীটি দুপুরের আগে ভিক্ষা করতে আসে, সেও এসেই ভিক্ষা চাওয়া ও বাড়ির ছেলেমেয়েদের দোয়া করার আগে পাগলটির কথা বলে, এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে যে এমন ভালো পাগলটিকে যারা এমনভাবে মারতে পারে, তাদের কপালে অনেক দুঃখ লেখা আছে। রাশেদ পাকিস্থানের কপালটির কথা ভাবতে চেষ্টা করে, সেখানে ফেরেশতার নিজ হাতে টানা ভবিষ্যৎ দুঃখের দাগগুলোও দেখার। চেষ্টা করে। বাবা খাওয়ার সময় বলেন যারা পাগলকেও এমনভাবে চাবুক মারতে পারে, তাদের সম্বন্ধে সাবধান থাকা দরকার। যখন সবাই নিঃশব্দে ক্ষুব্ধ জীবন যাপন করছিলো, তখন শ্রীনগরে একটি দ্রোহিতার ঘটনা ঘটে। বাজারের পাগলিটি, যে পাগলটির জনপ্রিয়তাকে ঈর্ষার চোখেই দেখতো সব সময়, মনে করতো যে-জনপ্রিয়তা তার ভাগে পড়ার কথা ছিলো তা ওই পাগলা তার থেকে অবৈধভাবে কেড়ে নিয়েছে, সে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। কয়েক দিন ধরেই তাকে কখনো বিমর্ষ কখনো উল্লসিত দেখাচ্ছিলো। এক দুপুরে যখন পাকিস্থান রক্ষাকারীদের একটি দল তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন সে দলের নেতার মুখ লক্ষ্য করে একটি কালো পাতিল ছুঁড়ে মারে। পাতিলটি মেজরের মুখে গিয়ে গোলাবারুদের মতো বিস্ফোরিত হয়, মেজরের নাকের ভেতর একটি চাড়া ঢুকে যায়, কপাল ফেটে রক্ত বেরোতে থাকে; মিলিটারিরা পাগলিকে লক্ষ্য করে অনবরত মেশিনগান চালায়। তার শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়, এবং মেজরের মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত হলেও পাকিস্থান অক্ষতভাবে রক্ষা পায়। এ-ঘটনার পর বাজার। থেকে সবাই পালিয়ে যায়, বিশেষভাবে পালায় বাজারের গৌরব পাগলপাগলিরা, তারা আর শ্রীনগরে ফেরে না। কারো মুখে কালো পাতিল মারা চরম অপমানের ব্যাপার, ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি শয়তান রয়েছে, যাদের অনেকেই ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বর বা প্রেসিডেন্ট, যাদের মুখে একাধিকবার কোনো-না-কোনো নারী কালো পাতিল মেরেছে; কিন্তু পাকিস্থানের মুখে কালো পাতিল মারার ঘটনা এই প্রথম।
রাশেদ আর কাজের ছেলেটি বাড়ি পরিষ্কার করে চলেছে। রাশেদকে বিশেষ চিন্তিত করে গুবরেপোকাঁদের আবাসিক সমস্যাটি; তারা যতোই জঙ্গল পরিষ্কার করতে থাকে, রাশেদ দেখতে পায়, পোকাগুলো আবাস বদল করতে থাকে। পুব দিকের বেড়ার গা। থেকে সরে গিয়ে উত্তর দিকের বেড়ার গায়ে বাসা বাধে, কিন্তু আগের মতো নিশ্চিন্তে তারা ঘুমোতে পারে না, তাদের ওড়ার মধ্যে উদ্বেগের ছাপ বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। রাশেদকে বাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার করতেই হবে; সে পাকিস্থান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ মনে মনে গুনগুন করে উত্তরের ঘরের বেড়ার গায়ে লৌহমানবের ছবিটা দেখতে দেখতে জঙ্গল পরিষ্কার করে, এবং পাকিস্থানে গুবরেপোকার জীবনের পরিণতি সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেয়। গোয়ালঘরের ভেতরটাও পরিষ্কার করে তারা; শুকনো গোবর ও গুবরেপোকার একটি চমৎকার গন্ধ ঢোকে তার নাকে, এবং তাদের আক্রমণে গুবরেপোকাগুলো অস্থির হয়ে গোয়ালঘর থেকে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বাইরের দিকে বেরোয়, অধিকাংশই তাদের অভিযানে প্রাণ হারায়। তাদের যে-দিন জঙ্গল কাটা শেষ হয়, গোয়ালের চারদিক যে-দিন তারা পরিষ্কার করে, পাকিস্থান সে-দিন নির্বিঘ্ন হয়; এবং রাশেদ দেখে গুবরেপোকাগুলো পিছু সরতে সরতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
দোয়েল ও অনন্ত প্রস্রাবধারা
ভাঁড়রা এলে প্রথম যে-খসখসে বিরক্তিটা সহ্য করতে হয়, ইচ্ছে হয় সুস্থ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে, তা আবদ্ধতার বিরক্তি; অন্ধকারের দেবতারা দিনের জন্যে জারি করে দেয় সান্ধ্য আইন। অন্ধকার তাদের খুব প্রিয় ও প্রয়োজনীয়, আইনটাকে সান্ধ্য বলা হলেও এটা নৈশ বা বর্বর আইন। সান্ধ্য আইন অন্যদের কেমন লাগে, তা জানে না রাশেদ, তার হয় দশ তলায় লিফটে আটকে থাকার অনুভূতি, আর তলপেটে একটি গর্জনশীল বদ্ধ প্রপাত নিয়ে লিফটে আবদ্ধ থাকা সুখকর নয়। একটা টেলিফোন থাকলেও কিছুটা মুক্তির স্বাদ সে পেতে পারতো, আহা মুক্তি; বা তখন। হয়তো আবদ্ধতাটা হতো আরো কর্কশ, টেলিফোন হয়তো সামরিক নির্দেশে কয়েক দিনের জন্যে লাশ হয়ে পড়ে থাকতো, আর জীবিত থাকলেও কেমন আছো, ভালো আছি’র অতিরিক্ত কোনো কথা কেউ তার সাথে বলতে রাজি হতো না; তার বন্ধুদের কেউ কেউ, যদি তাদের টেলিফোন থাকতো, হয়তো টেলিফোনই তুলতো না। একটা মিথ্যা পরিবেশে তাকেও মিথ্যার অভিনয় করতে হতো; মিথ্যা খুবই প্রজননশীল, একটি আরেকটি, না আরো অনেকগুলোকে জন্ম দেয়। তার টেলিভিশনটা রঙিন হলেও বেশ। হতো; ভাঁড়গুলোর পোশাকগুলো আরো উজ্জ্বল আকর্ষণীয় দেখাতো, তারাগুলো আরো জ্বলজ্বল করতো, চোখ ভালো থাকতো, ঘোষণাগুলো আরো রঙিন শোনাতো, আর যে-ঘোষিকাটির ঠোঁট দুটি ওষ্ঠ না বৃহদোষ্ঠ বোঝা যাচ্ছে না, তাকে আরো প্রবলভাবে। উপভোগ করা যেতো। এক বস্তাপচা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ, কোনো মৌলিকতা খুঁজে পাচ্ছে না রাশেদ,-প্রতিক্রিয়াশীলতায়ও কিছুটা মৌলিকতা থাকা বাঞ্ছনীয়; সব। বিধিবিধান আগের বিধিবিধানের রঙচটা প্রতিলিপি, ঘোষকঘোষিকাগুলো মনের আনন্দে বমি করার মতো সেগুলো মুখস্থ ঢেলে দিচ্ছে। মুখস্থ রাশেদেরও; সেও মুখস্থ ব’লে দিতে পারে : ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী বেআইনি অস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য প্রভৃতি রাখার। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে; ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী অবৈধ উপায়ে সম্পত্তি। সংগ্রহের জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে; ১৪ নম্বর ধারায় যে-কোনো লোকের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কোনো রাজনীতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণের জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে; ১৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী সামরিক আইনকে সমালোচনা করার জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে। এর মাঝে ওরা হয়তো ৫টা মন্ত্রী, ৩টা আমলা, আর গোটা ২ চোরাচালানিকেও ধরেছে। ভাঁড়টা প্রথম ধরেছে বা ধরবে কাকে? নিশ্চয়ই সেই অবাঙালি চোরাচালানিটিকে, যার চোরাচালান ও ধর্মে সমান মতি, তবে চোরাচালানের জন্যে নয়, মালের জন্যে; যেখানেই হাত দাও সেখানেই আধমণ মাংস, এমন একটা। ওপরতলার পতিতাকে নিয়ে কয়েক দিন আগে চোরাচালানিটার সাথে খুব একচোট হয়ে গেছে ভাঁড়টার, চোরাচালানিটা ট্রাউজারের জিপ খুলে দেখিয়েছে, বলেছে তার মতো কয়েকটা জেনারেল সে পাছপকেটে রাখতে পারে। সেটাকে নিশ্চয়ই ধরা হয়ে গেছে, যদি সেটা আগেই বিদেশে পালিয়ে না গিয়ে থাকে। এসব ধরাধরি ওদের আবির্ভাবের অবিচ্ছেদ্য অভিনয়-অংশ, দানবদের দেবতা করে তোলার চেষ্টা; এখন মাঠের রাখাল আর রাস্তার পতিতাও ধরাধরির পরিণাম জানে, কয়েক দিন পর ওরা দিনরাত ঘুষ খাবে, বন্দরে বন্দরে চোরাচালানে লিপ্ত হবে, অন্যের সুন্দরী বউকে পত্নী বা উপপত্নী করে। তুলবে, যেগুলোকে সবার আগে ধরবে কয়েক মাস পর সেগুলোই হবে ওদের প্রধান। ইয়ার।