মিলিটারি দেখতে সবার আগে যারা থানায় গিয়েছিলো, যারা পাকিস্থান রক্ষার প্রক্রিয়া চোখে দেখে ধন্য হতে চেয়েছিলো, তাদের অন্যতম ছিলো কবুতরখোলার সবচেয়ে নামজাদা পাগলটি, সামরিক আইন জারির আগে যে ওই এলাকায় আইউব খানের থেকেও বিখ্যাত ছিলো, যার মাথায় ছিলো ঝোঁপের মতো চুল, যার জন্যে সে। বিশেষ মর্যাদা পেতো, এবং অন্যান্য পাগলেরা সমীহ করতো। সে শ্রীনগর গিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিলিটারিদের সামনে দাঁড়ায়, এবং তার স্বভাবসুলভ বিখ্যাত সালামটি দেয়। সে। যখন খাঁটি মুসলমান সেপাইদের কাছ থেকে অলাইকুমের আশায় দাঁড়িয়ে ছিলো, তখন দুটি মিলিটারি দু-দিক থেকে তাকে রাইফেলের গুতো মেরে মাটিতে ফেলে দেয়, এবং ন্যাংটো করে এক এক করে দশটি চাবুক মারে। সে তিন দিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে। থাকে, শ্রীনগরে লোক যাওয়াআসা বন্ধ হয়ে যায়, এবং সারা এলাকার লোকজন তাদের প্রিয় পাগলের অবস্থার কথা শুনে অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মিলিটারিরা দোকানদারদের কাঁধে বোঝা চাপানোয় যারা খুশি হয়েছিলো, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টকে চাবুক মারাতেও যারা ক্ষুব্ধ হয় নি, বরং খুশিই হয়েছিলো, পারলে অনেক আগে তারা। নিজেরাই চাবুক মেরে তার পিঠ ছুলে ফেলতো, কিন্তু তাদের প্রসিদ্ধতম পাগলকে চাবুক মারায় তারা মনে মনে ক্ষুব্ধ বোধ করতে থাকে। তবে তাদের করার কিছু ছিলো না, তারা যা করতে পারতো তাই করে, তারা শ্রীনগরে যাওয়া যথাসম্ভব কমিয়ে দেয়; এবং পাকিস্থান কীভাবে রক্ষা পাচ্ছে তাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। পাকিস্থানের থেকে গায়ের চামড়াকে তারা অনেক বেশি ভালোবাসতে শুরু করে।
রাশেদ, ও তাদের কাজের ছেলেটি, তখন ব্যস্ত এক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক নির্দেশ বাস্তবায়নে, যা অবিলম্বে বাস্তবায়িত না হলে পাকিস্থান বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। ইস্কুল থেকে পাকিস্থানের মহান ত্রাতার যে-ছবিটি সে পেয়েছিলো, সেটি সে লাগায় উত্তরের ঘরের বেড়ার গায়ে; ছবিটি দেখলেই মনে হতো পাকিস্থানের উদ্ধার হয়ে গেছে, বাকি। শুধু তাদের বাড়ির উত্তর দিকে যে-জঙ্গল গজিয়েছে, গোয়াল থেকে গোবর উছলে পড়ে পাকিস্থানকে যেটুকু নোংরা করেছে, তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলা। ওইটুকু পরিচ্ছন্ন করতে পারলে পাকিস্থানের কোনো চিন্তা নেই, হাজার বছর তো টিকবেই, তারও বেশি টিকতে পারে, কিন্তু কথা হচ্ছে টিকবে তো? তাদের বাড়ির উত্তরপশ্চিম দিকে ছিলো। গোয়ালঘর, তার পুবে একটি বরইগাছ, তার পুবে কচু-ছিটকি-তেলাকুচের জঙ্গল, খুব বেশি নয়, পাকিস্থানকে বিপন্ন করার মতো নয়, তবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, কেননা শুরু থেকেই পাকিস্থান বিপন্ন। পাকিস্থানে সব কিছুই সন্দেহজনক, সব কিছুই ষড়যন্ত্র করে চলছে পাকিস্থানের বিরুদ্ধে; তাই ওই জঙ্গল আর তার ভেতরের পোকামাকড়ও ছিলো অত্যন্ত সন্দেহজনক, কে জানে প্রতিটি পোকা আর প্রতিটি মাকড় কী ষড়যন্ত্র করে চলছে। রাশেদ আর তাদের কাজের ছেলেটি জঙ্গল পরিষ্কার করতে শুরু করে। রাশেদের প্রথম মনে হয় হয়তো সত্যিই ছিটকি-কচু-তেলাকুচের জঙ্গলে মারাত্মক কিছু লুকিয়ে আছে, যা পাকিস্থানকে ঘায়েল করে ফেলতে পারে, কিন্তু সে ওই জঙ্গলে কিছুই দেখতে পায় না। কাজের ছেলেটি শুধু দুঃখ করতে থাকে, দাদা, ছিটকি। সব কাইট্টা ফেললে মেছেক করুম কি দিয়া? সে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে পছন্দ করে না, প্রতিদিন ভোরে একটি করে ছিটাকর ডাল ভেঙে ব্রাশ তৈরি করে, দাঁত মাজে আর ফেলে দেয়। সামরিক আইনে তার ব্রাশের বন বিপন্ন দেখে চাকরটি আর্তনাদ করে। ওঠে। রাশেদ তাকে বলে যে তার আর্তনাদ যদি শুনতে পায় মিলিটারিরা, যারা এখন পাকিস্থানকে রক্ষা করার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে, তাহলে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। শুনে ছেলেটি সত্যিই ভয় পেয়ে যায়, তবু সে বলে, দাদা, অহন থিকা কান্দনও কি দোষ? কানলেও কি পাকিস্থান মরবো? ছিটকি কাটতে গিয়ে রাশেদ একটি শালিককে ভয় পেয়ে উড়ে যেতে দেখে শালিকটির কাছে লজ্জিত বোধ করে এ ভেবে যে শালিকটি হয়তো তাকে মিলিটারি ভাবছে, কিন্তু সে যে। মিলিটারি নয় এবং কোনোদিন হবে না, একথা শালিকটিকে জানাতে না পেরে খুব কষ্ট বোধ করে। শালিকটি একটি বাসা বেঁধেছিলো, সেটি খ’সে নিচে পড়ে গেলো; রাশেদ সেটির দিকে তাকিয়ে অনুভব করলো যে শালিকের বাসার থেকে পাকিস্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্থানকে টিকিয়ে রাখার জন্যে দরকার হলে শালিকের সব বাসা ভেঙে দেয়া হবে, দরকার হলে এক ডিভিশন মিলিটারি লাগিয়ে দেয়া হবে একটি বাসা ভাঙতে। একটু দূরেই তাদের গোয়ালঘর; রাশেদ দেখতে পেলো তারা যখন কচুগাছ কাটছে, তখন তাদের গোয়ালঘরের বেড়ায় কয়েকটি গুবরেপোকা খুব উত্তেজিত হয়ে ওড়াউড়ি করছে। ওড়ার ভঙ্গিটা খুবই আপত্তিকর, অনেকাংশেই রাজনীতিক, যা সামরিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। গোয়ালঘরের বেড়ায় গুবরেপোকাগুলো বাসা তৈরি করে বাস করছিলো হয়তো বংশানুক্রমিকভাবে, কিন্তু পাকিস্থান রক্ষার জন্যে তাদের উৎখাত না। করে উপায় নেই। গুবরেপোকারাও পাকিস্থানের অধিবাসী, তাদেরও মেনে চলতে হবে সামরিক আইন। কিন্তু শ্রীনগরে তখন একটি মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহিতার ঘটনা ঘটে যায়।