রাশেদের এখন চারকোটি টাকা দরকার, তার নিজের জন্যে নয়, নিজের জন্যে এক টাকাও তার দরকার নয়, কিন্তু এখন তার চারকোটি টাকা দরকার; একটা আখাডামিকে দিতে হবে টাকাটা, রাশেদ একটা আস্ত হারামজাদা, সে ওই মহান আখাডামির মানসম্মানের মুখে মল মেখে দিয়েছে, টাকাটা আখাডামিকে দিলে তার মান ফিরে আসবে, টাকাটা দিয়ে তারা আখাডামির মুখের মল ঠিকঠাকমতো মুছে ফেলবে, তার মুখ আবার ঝলমল করবে। উদ্দিন মোহাম্মদের ভৃত্যরা বসে আছে ওখানে, তারা এবার রাশেদকে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। রাশেদ নাকি ওটাকে বলেছে গোশালা, শুধু বলে নি, লিখে দেখিয়েছে কীভাবে ওটা গোশালায় পরিণত হয়ে গেছে, আর তারা বুঝতে পেরেছে গোশালা অত্যন্ত নিন্দিত জিনিশ, তাতে আখাডামির মান একরত্তিও অবশিষ্ট নেই, ওই মান উদ্ধার করতে হবে, উদ্ধারের জন্যে চারকোটি টাকা দরকার, তাই তারা চারকোটি টাকার মামলা তৈরি করেছে রাশেদের নামে, রাশেদের তাই চারকোটি টাকা দরকার। টাকাটা তার থাকলে এখনি গিয়ে দিয়ে আসতো। তারা অকাট্য প্রমাণ দিয়েছে যে এখানে কোনো গোশালা নেই, পাঁচজন পণ্ডিত দিয়ে তারা গবেষণা করে যে-তথ্য পেয়েছে তাতে নিশ্চিতভাবে বলা চলে ওখানে পঞ্চাশ বছর পাঁচ মাস চার দিন ধরে কোনো গোশালা নেই, তাই ওটাকে গোশালা বলা চলে না; আর গোশালা যদিও বাঙালির একান্ত আপন জিনিশ, তার হৃদয়ের ধন, তবু ওটাকে গোশালা বলা চলে না, কেননা ওখানে শুধু গবেষণা হয়, গবেষণা শব্দটির মৌলিক অর্থ গরু খোঁজা হলেও এখন আর ওখানে গরু খোঁজা হয় না। গরু খুজবে কেনো, খোঁজার তো আর দরকার পড়ে না। রাশেদ খুব কৌতুক বোধ করলো, তার জাতির মগজের গন্ধে সে ভয় পেলো। তার চারকোটি টাকা দরকার। টাকায় কি সম্মান ফিরবে? রাশেদকে এবার ভিক্ষায় নামতে হবে, চারকোটি টাকা ভিক্ষা করে পেতে তার অন্তত এক হাজার বছর লাগবে, সে এক হাজার বছর ধরেই ভিক্ষে করবে, একটি একটি করে পয়সা জমিয়ে এক হাজার বছর পর গিয়ে তার দরোজায় দাঁড়িয়ে বলবে, আপনার সম্মান ফিরিয়ে দিলাম। কার কাছে সে হাত পাতবে? কোটি কোটি টাকা যারা চুরি করেছে, তাদের কাছে পাতবে না, ওরা খুব গরিব মানুষ, ওরা ঋণ করে ফতুর হয়ে গেছে, দেয়ার মতো একটা সিকিও ওদের নেই; রাশেদ ভাবছে ভিক্ষে করার জন্যে সে প্রথম হাত পাতবে ভিখিরিদের কাছেই;–গুলিস্থানের মোড়ে গিয়ে সে দাঁড়াবে, প্রথম যে-ভিখিরিটিকে দেখবে, তার সামনেই হাত বাড়িয়ে বলবে, একটা পয়সা দিন, আমি বড়োই গরিব, আপনার থেকেও গরিব, আমার চারকোটি টাকা লাগবে, আপনার তো কয়েক বছর ভিক্ষা করলেই চলবে, আমাকে ভিক্ষে করতে হবে এক হাজার বছর। ভিখিরিরা তাকে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবে না। না, রাশেদকে ভিক্ষে করতে হলো না, রাশেদের পক্ষে একটা উত্তর দেয়া হলো, আখাডামি এবার চুপ করে গেলো, আরো মান হারানোর ভয়ে খুব ভদ্র হয়ে উঠলো।
রাশেদ তুমি ভালো হয়ে যাও, কথা বলা বন্ধ করে দাও, বললে শুধু মধুর মধুর কথা বলো, যা অমৃত ঢেলে দেবে জাতির কানে; তুমি ভালো হয়ে যাও রাশেদ, কথা বলা বন্ধ করে দাও, কথার বদলে শ্লোগান বলল, তুমি অন্তত একজনের নামে শ্লোগান দাও; রাশেদ তুমি লেখাটেখা বন্ধ করে দাও, লিখলে শুধু মধুর মধুর লেখা লেখো, যা জাতির বুকে অমৃতের ঝরনা বইয়ে দেবে। তুমি রজ্জব আলির মতো কথা বলো, দেখো না তার কথায় কতো মধু, শুনলেই বুক জুড়িয়ে যায়; লিখলে তুমি জুলমত ব্যাপারির মতো। লেখো, দেখো না তার লেখায় কতো মজা, অধ্যাপিকা থেকে গৃহপরিচারিকা রাষ্ট্রপতি থেকে বেশ্যার উপপতি কেমন খলখল করে ওঠে। রাশেদ তুমি একটা মাজার বেছে নাও, মাজারের খাদেম হও, লাশের পুজারী হও, রাশেদ তুমি মান্য করতে শেখো, সেজদা করতে শেখো। তুমি কি বুঝতে পারছে না তোমার ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার? সত্য কথা বলার কী দরকার তোমার, তোমাকে কে বলেছে মানুষ সত্য পছন্দ করে? তুমি মিথ্যা বলো, মিথ্যার মতো মধুর আর কিছু হয় না। তুমি কি বুঝতে পারছে না তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে, তোমার কোনো দরকার নেই এ-জাতির, তোমার মতো কুলাঙ্গারকে সরিয়ে দিতে পারলে স্বস্তি পায় জাতি? রাশেদ বসে ছিলো তার . প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘরটিতে, দরোজায় হঠাৎ শব্দ হলো; সে বললো, ভেতরে আসুন; কিন্তু কেউ ভেতরে ঢুকলো না। রাশেদ আবার বললো, ভেতরে আসুন, কেউ এলো না। রাশেদ নিজে দরোজা খুলতে গিয়ে খুব অবাক হলো যে দরোজাটি খুলছে না। সে বুঝতে পারলো বাইরে থেকে কেউ তার দরোজাটি এইমাত্র আটকে দিয়ে গেলো। তবু ভালো, ঘরে ঢুকে লোকটি তার ওপর ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি, শুধু দরোজাটা আটকে দিয়ে গেছে, অন্য কোনো দিন হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়তে আসবে, তবু তো তা আজ নয়। লোকটি/ছেলেটি দেখতে কেমন হবে? রাশেদ তার মুখটি ভাবার চেষ্টা করলো, কোনো মুখ তার চোখে ভেসে উঠলো না, শুধু শূন্যতা ভেসে উঠলো চোখে। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতরে একটি লোক আছে, যে এইমাত্র তার দরোজা বাইর থেকে আটকে দিয়ে গেছে, তার মনে এখন অনেক মজা, কেউ তার আঙুল ছুঁয়েও বুঝতে পারবে না ওই আঙুল একটা বড়ো কাজ করে গেছে, হয়তো আরো বড়ো:কাজের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। দরোজাটি খুলতে তার কষ্ট হবে, জানালা দিয়ে কাউকে ডাকতে হবে, যাকে ডাকবে সেও রাশেদকে সন্দেহের চোখে দেখবে, রাশেদ নিশ্চয়ই খুব খারাপ, নইলে কেউ তার দরোজা বাইর থেকে আটকাবে কেনো? রাশেদ ভেতর থেকে দরোজাটি। আটকে দিলো, তার মনে হলো যে-ঘর বাইর থেকে আটকানো সেটা ভেতর থেকে আটকে রাখা আরো ভালো। রাশেদ তার চেয়ারে বসলো, মনে হলো সে এ-মুহূর্তে বন্দী, ইচ্ছে করলেই বেরোতে পারবে না। তখন সে কারো অলৌকিক কণ্ঠস্বর শুনতে–পেলো;-তার আলমারির পেছনে একটি শালিক বাসা বেঁধেছে, শালিকটির মুখ সে কখনো দেখে নি, সে-শালিকটি তার সাথে কথা বলতে চাইছে। শালিকটির কথার। কোনো শেষ নেই, কিটিরিটিকিরিকিটিকিটিটিকিরি করে সে কথা বলে চলছে, রাশেদ উঠে গিয়ে উঁকি দিয়ে শালিকটির মুখ দেখলো, শালিকটি তার দিকে একটি বালিকার মতো তাকিয়ে আছে, ভালোবাসি বলার আবেগ রাশেদের বুকে কাঁপতে লাগলো, তবে সে বলতে পারলো না, কিন্তু শালিক যেনো বলে চলছে ভালোবাসি ভালোবাসি। ভালোবাসি, তার স্বরে রাশেদের মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যেতে থাকে বাল্যকালের মেঘ, টেবিলের ওপর দুলতে থাকে একটা পেয়ারার ডাল, একটি বালিকা পেছন থেকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে শিউরে দেয় তাকে। রাশেদ ঘাসের ওপর শিশিরের ওপর খালি পায়ে। হাঁটতে থাকে, বন্দী করে কেউ তাকে বন্দী করে রাখতে পারে না। দরোজার পর দরোজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রাশেদের সামনে, পথের পর পথ মুছে যাচ্ছে তার সম্মুখ থেকে, ইচ্ছে করলেই সে ঢুকতে পারতো ওই সব দরোজা দিয়ে, চলতে পারতো ওই সব পথে, রাশেদ প্রত্যাখ্যান করেছে ওই সব দরোজা আর পথ; তার আর ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল নেই, যতোটুকু মাটিতে সে দাঁড়িয়ে থাকে বা বসে থাকে যতোটুকু আসবাবের ওপর যেনো শুধু সেটুকুই তার দেশ, ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল হচ্ছে উদ্দিন মোহাম্মদের, আর অন্যদের। তার জন্যে আর বাস্তব নেই, আছে শুধু স্বপ্ন; স্বপ্নে সে দেশটাকে দেখে, দেখতে পায় দেশটা মরে যাচ্ছে ওই নদীটির মতো, পদ্মার মতো, তাদের পুকুরপাড়ের হিজল গাছটির মতো। রাশেদ শুধু মৃত্যুর স্বপ্ন দেখতে। পায়;–সে সাঁতার কাটছে পুকুরে, ডুব দিতে গিয়ে দেখে পুকুরে পানি নেই, পুকুরটি মরে গেছে, সে পড়ে আছে কাদার ভেতরে; বিলে, কুমড়ো ভিটের পাশে, একটা। শাপলাকে সে দুলতে দেখে, কাছে গিয়েই দেখে তার পাপড়িগুলো বালুপের মধ্যে উড়ছে, বিল মরুভূমি হয়ে গেছে; সে জ্যোৎস্নায় চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখে চাঁদটি মরে গেছে, তার শরীর থেকে অন্ধকার ঝরে পড়ছে। সম্পূর্ণ অন্ধকার নেমে আসার আগে। রাশেদের ইচ্ছে হচ্ছে সেই দুরূহ বইটি ধরতে, যেটি কেউ পড়বে না, যেটির কোনো। দরকার নেই কারো, তবু সে লিখছে সেটি। একটু সুখও পাচ্ছে বুকে, তার প্রথম বই বেরিয়েছে এবার, তা চোখের আড়ালে পড়ে থাকে নি; প্রশংসা যা পাচ্ছে বইটি তার চেয়ে বেশি পাচ্ছে নিন্দা,–বাসায় তার টেলিফোনের সংখ্যা বেড়ে গেছে, তিরস্কার ভোগ করছে সে নিয়মিত, তবু নিন্দাই এখানে ক-জনের ভাগ্যে জোটে। রাশেদ সেদিন এক। উৎসবে গৈছে, তার মনে হচ্ছে যাদের সে দেখতে চায় না তাদের দেখতে গেছে সেখানে, তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অনেকে, উদ্দিন মোহাম্মদের তিনটি বুড়ো অনুরাগী তাকে দেখে পড়েই যাচ্ছিলো, তবে জড়িয়ে ধরছে কেউ কেউ তাকে; তাদের আলিঙ্গন থেকে রসের মতো সুখ ঢুকছে তার ভেতরে। দুটি তরুণী দুটি তরুণ তাকে ঘিরে আছে সব সময়, তাহলে রাশেদ একলা নয়, তার সাথে কেউ কেউ আছে। তারা গিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় বসলো। তরুণী দুটির মুখ থেকে জ্যোৎস্না ঝরছে টেবিলের ওপর, তাদের মুখে আজ পূর্ণিমা, তাতে ঝলমল করছে তার বইটি। তখন সেখানে ঢুকলো কয়েকটি যুবক, এসেই ঘিরে ফেললো টেবিলটি; তারা চিৎকার করে বলতে লাগলো, তোমার বই পড়ার জন্য নয় পোড়ানোর জন্য, এই সব আমরা চাই না, তোমাকেও একদিন। পুড়িয়ে ফেলা হবে। তারা টেবিল থেকে রাশেদের বইটি তুলে নিলো, আগুন লাগিয়ে দিলো বইটিতে, তার বই দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। যুবকেরা জ্বলন্ত বইটি তার। সামনে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো;–রাশেদ দেখতে পেলো তার বইয়ের পাতা পুড়ছে, ছাই হচ্ছে, তার সাথে পুড়ছে ছাই হচ্ছে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল–পুড়ছে গাছের পাতা, নদী, মেঘ, বাতাস, ধানখেত, লাঙ্গল, সড়ক, গ্রাম, শহর, পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে যাচ্ছে একটি জাতি, পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে যাচ্ছে তার বর্তমান, পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে যাচ্ছে তার ভবিষ্যৎ।