দু-দিন পর ফিরে এসে রাশেদ প্রথম টেলিফোন ধরেই শুনলো, কী রে, আইজকাল বাসায় থাকছ না? রাশেদ জিজ্ঞেস করলো, কে বলছেন; ঘাতক বললো, নাম দিয়া কী হবে, আমি তর মত নামকরা মানুষ না, এইটা জানানের জন্য ফোন করলাম যে তর ভবিষ্যৎ খারাপ, আমার নেতার নামে তুই এইসব কী লিখছস? রাশেদ জিজ্ঞেস করলো, আপনার নেতা কে? ঘাতক বললো, আমার নেতা হারামজাদা তরও নেতা, সব বাঙলাদেশির নেতা, তুই ত আবার নেতা মানছ না, আমার নেতাই ত দেশটারে স্বাধীন করছে, আমার নেতাই ত বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা করছে, তুই শোন নাই, আমার নেতাই ত একনম্বর মুক্তিযোদ্ধা। রাশেদ বললো, নেতার প্রতি আপনার ভক্তি দেখে মুগ্ধ হলাম; ঘাতক বললো, হারামজাদা, তুই তার নামে এইসব কী লিখছস? রাশেদ বললো, আমি তো অনেক কিছুই লিখেছি। ঘাতক বললো, হারামজাদা, অই যে লিখছস একনম্বর মুক্তিযোদ্ধাই একনম্বর রাজাকার হয়ে উঠছিল, দেশটারে রাজাকারদের হাতে তুলে। দিয়েছিলো, রাজাকাররা তার নাম বড় বড় অক্ষরে লিখে রাখবে, তার সাথে উদ্দিন। মোহাম্মদের পার্থক্য নাই, এইসব হারামজাদা তুই কী লিখছস? রাশেদ বললো, আমি কি মিথ্যা লিখেছি? ঘাতক বললো, কথা কইছ না হারামজাদা, তর দুই হাত কাইট্টা ফালামু, অই হাত দিয়া কিছু লিখতে দিমু না। রাশেদ বললো, হাত কেটে ফেললে পা থাকবে, পা থাকলেই চলবে আমার। ঘাতক বললো, পা দিয়া তুই কী করবি? রাশেদ বললো, হাত দিয়ে লেখার থেকে পা দিয়ে লাথি মারাই বেশি দরকার এখন, পা দুটি। থাকলেই আমার চলবে, লাথি মারতে পারবো। ঘাতক বললো, তর পা দুইটাও থাকব না দেখিছ। রাশেদ টেলিফোন রেখে দেয়, আর ঘাতকের মুখোমুখি দাঁড়াতে তার ভালো লাগছে না, ইচ্ছে হচ্ছে কাল সে ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে, আর ফিরে আসবে না; কিন্তু, সে কেনো এসেছিলো এ-শহরে? না এলে কি চলতো না তার? সে একটি বালককে। দেখতে পায়, সে বাড়ির উত্তর ধারে কদমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটি দুইকুলি দেখছে, দইকুলির বুকের ধবধবে জ্যোৎস্নায় তার বুক ভরে গেছে, তার চোখের মণিতে। হলদেবেগুনির স্নিগ্ধ আলো হয়ে জ্বলছে পুকুরভরা কচুরি ফুল, সে দেখতে পাচ্ছে বালকটি পুকুরে লাফিয়ে নেমে সাঁতার কাটছে, ডুব দিচ্ছে, ফিরে এসে চুলে সরষের তেল মেখে। চুল আঁচড়াচ্ছে, নিজের মুখটি বারবার দেখছে একটি পুরোনো আয়নায়, মনে মনে আদর করছে মুখটিকে, বালক কাঁধে বই রেখে বাঁ হাত বাঁকিয়ে বইগুলো ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে ইস্কুলের দিকে। ওই বালকই কি সে, রাশেদ, যে আজ আক্রান্ত, তার কী দরকার ছিলো এই নষ্ট নগরে আসার? সে কি সুখী হতো না ওই পুকুর আর বিল আর দইকুলি আর। মেঘ আর কদমগাছের প্রতিবেশিতায়? তার তো আসার কথা ছিলো না, তার সাথের। কেউ তো আসে নি; আর এলোই যদি তাহলে কেনো সে মাথাটা নিচু করে এলো না, যেমন এসেছে অনেকে, যারা খুব ভালো আছে, সে কেনো ভালো থাকার কৌশল শিখলো না? সে কেনো দীক্ষা নিতে জানে না, সে কেনো থেকে যাচ্ছে অদীক্ষিত?
শুভ্র পদ্ম, শাদা শাপলা, লাল গোলাপ, ঘুমজড়ানো দোয়েল, তোমাকে কেউ। ভালোবাসে না, যদিও রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইক্রোফোন লাগিয়ে চিৎকার করে ওরা তোমাকে প্রেমের কথা শোনায়, কিন্তু কেউ তোমাকে ভালোবাসে না, ভালোবাসা কাকে বলে তুমি জানো না, একনায়ক জননায়ক, গণনায়ক দেশনায়ক জননেতা দেশনেতা, সবাই তোমাকে সম্ভোগ করতে চায়, সবাই চুষে চুষে তোমার ঠোঁট ছিঁড়ে নিতে চায়, ওরা ছিঁড়ে ফেলেছে তোমার ওষ্ঠ, তোমার ওষ্ঠের দিকে তাকানো যায় না, সবাই চুষে চুষে তোমার স্তনবৃন্ত ছিঁড়ে নিতে চায়, কামড়ে স্তনের মাংস ছিঁড়ে নিতে চায়, তোমার স্তনের দিকে আজ আর তাকানো যায় না, কেউ তোমাকে ভালোবাসে না, তোমাকে কেউ ভালোবাসে না, তোমাকে ভালোবাসে না কেউ, উদ্দিন মোহাম্মদ তোমাকে নষ্ট করছে,জননেতারা তোমাকে ভ্রষ্ট করছে, তুমি ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হয়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যাচ্ছো, শুভ্র পদ্ম, শাদা শাপলা, লাল গোলাপ, ঘুমজড়ানো দোয়েল, আমার মা, প্রিয়তমা, হৃদয়ের বোন, উদ্দিন মোহাম্মদ তোমাকে ন্যাংটো করে চাবকাচ্ছে, তার চাবুকের শব্দে তুমি নাচছো ময়ুরের মতো, সে তোমার শরীরের আরো ঝিলিক দেখার জন্যে আরো চাবকাচ্ছে, তুমি নাচছো রক্তাক্ত ময়ুর, মোল্লারা তোমাকে বেশ্যা মনে করে তোমার সমস্ত ছিদ্রে গুঁজে দিতে চাইছে আলখাল্লা, তোমার কানে আউড়ে চলছে কলমা, তোমাকে বিবি করার জন্যে তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফুটো পয়সার দেনমোহর নিয়ে, তোমার জরায়ু ভরে তুলতে চাইছে মুসলেমিনে, আর। এ-রাস্তায় ওই রাস্তায় সেই রাস্তায় দলের পর দল তোমাকে শোনাচ্ছে প্রেমের বচন, এক দল তোমাকে ঢাকাই শাড়ি কিনে দিতে চাইলে আরেক দল চাইছে শাড়ি কিনে দিতে, একদল তোমাকে কাতানের লোভ দেখালে আরেকদল তোমাকে জামদানির লোভ। দেখাচ্ছে, কিন্তু তুমি ছেঁড়া শাড়ি পরে আছে; একদল তোমাকে কানপাশা কিনে দিতে চাইলে আরেকদল তোমাকে মাকড়ি কিনে দিতে চাইছে, কিন্তু তোমার কান খালি; একদল তোমার জন্যে রুপোর নাকছাবি গড়ে আনবে বললে আরেকদল গড়ে আনতে চাইছে সোনার নোক, কিন্তু তোমার নাক খালি; একদল তোমার জন্যে নকল সাতনরী কিনে আনলে আরেকদল তোমার জন্যে বানিয়ে আনছে নকল চন্দ্রহার, কিন্তু তোমার গলা খালি; একদল তোমার বাহুতে বাজুবন্ধ পরাতে চাইলে আরেকদল পরাতে চাইছে। কেয়ুর, কিন্তু তোমার হাত খালি; ওরা ভালোবাসে না তোমাকে, ওরা ভালোবাসার কথা জানে না, শুধু সম্ভোগ করতে জানে, ওরা কেউ কখনো তোমার মাটির সুগন্ধে মেঘের সুগন্ধে বুক ভরে নি, ওরা কখনো তোমার জ্যোৎস্নায় কবি হয় নি, ওদের বুক থেকে কবিতা ওঠে নি গান ওঠে নি, ওরা জ্যোৎস্নায় শুধু কামার্ত হয়েছে, ওরা শুধু খলনীতি জানে ওরা কৃষিকাজ জানে না। আমিও কি ভালবাসতে পেরেছি তোমাকে, আমিও কি কতোদিন তোমাকে মিথ্যা ভালোবাসা দিয়ে মথিত করি নি শুভ্র পদ্ম, শাদা শাপলা, লাল গোলাপ, ঘুমজড়ানো দোয়েল? তবে আমার ভালোবাসা মিথ্যে হলেও তা তোমার কোনো ক্ষতি করবে না, কিন্তু ওদের কামের পাশ থেকে তোমার মুক্তি নেই, ওদের কাম তোমাকে জীর্ণ করবে, তোমাকে নষ্ট করবে, তোমাকে ধ্বংস করবে, তোমার মুক্তি নেই।