খাপ খাওয়াতে হবে রাশেদকে, সব কিছু মেনে নিতে হবে, ‘না’ বলার অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে, যে তাকে যে-পথ দেখায় সে-পথকেই পুণ্যপথ বলে মেনে নিয়ে সোজা চলতে হবে, সব কিছু বিশ্বাস করতে হবে, বুকে কোনো অবিশ্বাস রাখতে পারবে না, যেমন চারপাশে কেউ কোনো কিছু অবিশ্বাস করে না; উদ্দিন মোহাম্মদ যা বলে, তা মানতে হবে; যারা গণতন্ত্র আনবে, তাদের মানতে হবে; তাদের গণতন্ত্র বিভিন্ন রকম, উদ্দিন মোহাম্মদ যা করলে স্বৈরতন্ত্র হয় তারা তা করলে গণতন্ত্র হবে, রাশেদকে সেই গণতন্ত্র মানতে হবে; তারা যে-সব মহৎ ধ্রুবসত্যে পৌঁচেছে, সে-সব সত্য মুখস্থ করতে হবে, তাদের সাথে গলা মিলিয়ে আবৃত্তি করতে হবে। এজন্যেই আজকাল দিকে দিকে। আবৃত্তি শেখানো হচ্ছে। উদ্দিন মোহাম্মদকে সে মানতে পারে না, কোনো উদ্দিন মোহাম্মদকেই সে কোনোদিন মানতে পারে না; কিন্তু অন্যদের, যারা গণতন্ত্র আনবে, যারা সোনায় রুপোয় দেশ ভরে দেবে? রাশেদ নির্বোধ, নইলে নিশ্চয়ই বুঝতো অন্যের আবিষ্কৃত সত্যে বিশ্বাস আনাই সবচেয়ে নিরাপদ, এবং সুখকর, সংঘে যোগ দিলে তার। আর কিছু ভাবতে হবে না, সংঘই ভাববে তার জন্যে, তার দেখাশোনা করবে, সময় এলে, যদি তার সংঘের মিথ্যায় সাড়া দেয় জনগণ, তাহলে সে পুরস্কার পাবে, মূল্যবান ঝলোমলো সে-সব পুরস্কার। নির্বোধ রাশেদ, এসব বুঝতে পারছে না, সরল সঠিক পুণ্যপথে চলতে পারছে না; সে শুধু বিপজ্জনক পথে পা ফেলছে। সে অবিশ্বাস করছে। সব কিছু; সে জাতির পিতা মানছে না, ঘোষণাকারী মানছে না, বাঙালি মানছে না, মুসলমান মানছে না, ঐতিহ্য মানছে না, প্রথা মানছে না, সমাজতন্ত্র মানছে না, সংঘ মানছে না, কোনো ধ্রুবসত্যই মানছে না। সমাজের শত্রু হয়ে উঠছে সে দিন দিন; তাকে কী করে সহ্য করবে সমাজ? সে-দিন রাশেদ এক সংঘের সভায় একটি প্রবন্ধ পড়লো, বিপজ্জনক কোনো বিষয়ে নয়, নিরীহ একটি বিষয়ে, যদিও আজকাল আর কিছুই নিরীহ নয়, কবিতা সম্পর্কে। প্রথাগত অনেকগুলো ধারণা সে বাতিল করে দিলো, সে আশা। করেছিলো যারা আলোচনা করবে, তারা বিচার করবে তার মতগুলো; কিন্তু তারা উচ্চকণ্ঠে এমন সব চিৎকার দিতে লাগলো, যার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই রাশেদের রচনার। এক আলোচক বলতে লাগলো, সে রাশেদের প্রবন্ধ পড়ে নি, এমনকি শোনেও নি, কেননা রাশেদ জাতির পিতা মানে না। যে জাতির পিতাকে মানে না, তার বাঙলাদেশে থাকার অধিকার নেই। রাশেদ বাঙলাদেশে থাকার অযোগ্য, তাকে দেশ। থেকে বিতাড়িত করতে হবে। আলোচক আরো উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলো সে শুনেছে যে রাশেদ মনে করে জাতির পিতাকে হত্যা করা দরকার ছিলো। রাশেদ আলোচনা শুনে, আলোচকদের মগজের অবস্থার কথা ভেবে, কৌতুক বোধ করছিলো, ভাবছিলো। ভালোচনার শেষে সে উত্তর দেবে। কে একজন মঞ্চে এসে রাশেদকে এক টুকরো। কাগজ দিলো, তাতে সে রাশেদকে অনুরোধ করেছে মঞ্চ ছেড়ে চলে যেতে, লিখেছে, দয়া করে আপনি এখনি ওখান থেকে চলে আসুন, নইলে মঞ্চে আপনাকে খুন করা হতে পারে। সত্যিই কি এমন ঘটতে পারে, কবিতা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখে কি। রাশেদ এভোটা অপরাধ করে ফেলেছে, তার দেশ কি এতোটা বর্বর হয়ে উঠেছে। রাশেদ মঞ্চ ছেড়ে উঠলো না। আলোচনার শেষে সে উত্তর দিতে চাইলো, তখনি মঞ্চে শুরু হলো কোলাহল, একের পর এক তাণ্ডবকারী উঠতে লাগলো মঞ্চে, তারা। মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিলো, চিৎকার করে বলতে লাগলো রাশেদকে কিছুতেই উত্তর দিতে দেয়া হবে না। এপাশ ওপাশ থেকে তখন শ্লোগান উঠছে, রাশেদের বিপক্ষে, এবং বিস্ময়কর-রাশেদের পক্ষেও। রাশেদকে ঘিরে আছে তার অচেনা অনুরাগীরা, একটি। তরুণী আর একটি তরুণ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আর রাশেদ তাকিয়ে আছে মত্ত তাণ্ডবকারীদের দিকে, দেখতে চেষ্টা করছে বাঙলার ভবিষ্যৎ।
সংঘ নয়, আর সংঘ নয়; রাশেদের পক্ষে কোনো সংঘে থাকা সম্ভব নয়, সংঘ তার জন্যে নয়; রাশেদ এখন পরিচ্ছন্নভাবে জানে কী উপাদানে তৈরি এই সব সংঘ, দল, সংস্থা। রাশেদকে থাকতে হবে একলা, নিঃসংঘ; হানাহানি চক্রান্ত করতে থাকবে। সংঘের অধিপতিরা, পদের জন্যে পাগল হয়ে থাকবে তারা, দরকার হলে পা ধরবে। দরকার হলে পিঠে ছুরি মারবে, হবে অন্তঃসারশূন্য, মাথা রাখবে শক্তিমানদের পায়ে, তখন রাশেদ একা লাথি মারবে–সমাজ, রাষ্ট্র, নেতা, প্রভু, প্রথা, অপবিশ্বাসের মুখে, এবং সৃষ্টি করে চলবে। তার আদিম গোত্র তাকে পুঁতে ফেলতে চাইবে, পারলে সুখী হবে; সে লাথি মারবে আর সৃষ্টি করতে থাকবে। শুধু লাথি নয়, সৃষ্টি, সৃষ্টির জন্যেই লাথি। কিন্তু আজ রাতে রাশেদ বাসায় থাকতে পারবে না, আরো কয়েক রাতই হয়তো থাকতে পারবে না, বিশেষ শাখা তার খোঁজ করছে, মমতাজ একাধিক টেলিফোন। পেয়েছে, যারা নাম বলে নি, শুধু বলেছে কয়েক রাত রাশেদের বাসায় থাকা ঠিক হবে না। রাশেদ কি বিশ্বাস করবে এ-টেলিফোনগুলো? তবে পরিস্থিতি বেশ খারাপ, ধরাধরি চলছে, তার চেনা আরো দু-তিনজনও বাসায় থাকবে না, তারাও সংবাদ পেয়েছে বিশেষ শাখা খোঁজ করছে তাদের, রাশেদের খোঁজও করতে পারে। আচ্ছা, তারা যদি মাঝরাতে এসে রাশেদকে ধরে, নিয়ে যায়, তাকে নিয়ে গিয়ে তারা কী করবে? সিলিংয়ে ঝুলিয়ে চাবুক মারবে, বিদ্যুতের খোঁচা দেবে, জিভে সুচ ঢুকিয়ে দেবে? রাশেদ যতোটা জানে এখনো দেশটা আর্জেন্টিনা হয়ে ওঠে নি, তাকে ধরে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে নিশ্চয়ই বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে আসবে না। তবু তার বাসায় থাকা চলবে না, মমতাজই বেশি চাপ দিচ্ছে, রাশেদের কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু যেতে হবে। একটি তরুণ অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে রাশেদকে তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে, রাশেদ খুব বিব্রত বোধ করছে, বাসা থেকে বেরোতে তার খারাপ লাগছে, এমনভাবে আগে সে। কখনো বেরোয় নি। বাঁচার জন্যে সে পালাচ্ছে? পালাতে তার ইচ্ছে করছে না। মৃদুর : মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে রাশেদের, মৃদুর কাছে বড়ো একটা। অপরাধ করে ফেলেছে এমন মনে হচ্ছে তার। মৃদুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেও বিব্রত বোধ করছে রাশেদ। বিব্রতভাবে রাশেদ বেরোলো তরুণটির সাথে, তার গাড়িতে উঠলো, মনে হলো গাড়িটি তাকে নিয়ে অন্ধকারের দিকে চলতে শুরু করলো।