বাসায় টেলিফোন আনা ঠিক হয় নি, রাশেদ টেলিফোন তুলতেই ভয় পাচ্ছে। আজকাল; টেলিফোনের ভেতর দিয়ে দুপুর সন্ধ্যা মাঝরাতে তার ঘরের ভেতর ঢুকে। পড়ছে ঘাতকেরা, ছুরি হাতে লাফিয়ে দাঁড়াচ্ছে তার সামনে। টেলিফোন বাজার শব্দটা তার ভালো লাগে, বাজলেই গিয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, অপরপ্রান্তের যে-কাউকে তার প্রিয় মনে হয়, ধরেও ফেলে রাশেদ। গতকালও মাঝরাতে টেলিফোন বেজে উঠেছিলো, ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো রাশেদের, সে বুঝতে পারছিলো অন্যপ্রান্তে কোনো ঘাতক ছুরি হাতে। বসে আছে, এখন তাকে মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তার ঘাতকের। ঘাতক বলে, আচ্ছালামুআলাইকুম; রাশেদ বলে, রাশেদ বলছি। ঘাতক চিৎকার করে ওঠে, হারামজাদা, তুই ত আবার সালামের জবাব দ্যাছ না, অআলাইকুমসালাম ক, তর বাপে কি তরে একটুও আল্লারসুলের নাম শিখায় নাই? রাশেদ বলে, আপনি কে বলছেন; ঘাতক বলে, তর আজরাইল বলছি। ওই সব ল্যাখা ছাইরা দে, আল্লারে লইয়া তুই। মাথা ঘামাইছ না, লিস্টিতে তর নাম আছে। রাশেদ টেলিফোন রেখে দেয়, টেলিফোন আবার বাজতে শুরু করে, বাজতে থাকে, বাজতে থাকে। মমতাজ আর মৃদু জেগে উঠেছে, দুজনই খুব ভয় পেয়ে গেছে; টেলিফোন বাজতে থাকে, বাজতে থাকে; এবার মমতাজ টেলিফোন ধরে জিজ্ঞেস করে, কে বলছেন; ঘাতক বলে, তর স্বামীর আজরাইল বলছি, তার বেশি দিন নাই, তর আরেকটা বিয়ার দিন কাছাইয়া আইছে। মমতাজ চিৎকার করে বদমাশ বদমাশ বলতে বলতে টেলিফোন রেখে দিয়ে কাঁপতে থাকে। মৃদু উঠে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। আবার বেজে ওঠে টেলিফোন, অনেকক্ষণ কেউ ধরে না তারা; এক সময় রাশেদ আবার তার ঘাতকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, রাশেদ বলছি। ঘাতক বলে, তুই তৈরি হইয়া থাকিছ, বেশি দিন বাকি নাই। রাশেদ। বলে, আমি তৈরি, ইচ্ছে হলে আজ রাতেই আসতে পারেন। ঘাতক বলে, যেই রাতে। দরকার পড়ব সেই রাতেই আসব, চোখ বাইন্দা শুয়রের মত লইয়া আসব, যা কিছু দ্যাখতে চাই দ্যাইখ্যা ল। রাশেদ বলে, আপনাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে। ঘাতক বলে, চোখ উপড়াইয়া ফেলনের পর আমাকে দেখতে পাবি। ঘাতক টেলিফোন রেখে। দেয়, রাশেদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে টেলিফোনের পাশে, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় মমতাজ আর মৃদুর কাছে। সে মৃদুর গালে অনেকক্ষণ হাত রেখে বসে থাকে, আজ আর ঘুম হবে না, পাশের ঘরে গিয়ে সে একটি বই খুলে বসে।
সন্ধ্যার আগে রাশেদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কোনো রিকশা দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে, রিকশার জন্যে বড়ো রাস্তায় যেতে হবে, কী আশ্চর্য, পাশের গলি থেকে পাঁচ-ছজন ধার্মিক লোক বেরিয়ে এলেন;–তারা দ্রুত হাঁটছেন, তারাও হয়তো বড়ো। রাস্তায় যাবেন, বা খবর পেয়েছেন শহরের কোনো রাস্তায় ধর্ম বিপন্ন, বড়ো বড়ো জোব্বা পরেছেন তারা, তাদের মাথায় অদ্ভুত টুপি, গলায় নানা রকম চাদরগামছা, রাশেদের আগে আগে হাঁটছেন তারা, রাশেদকে হয়তো তারা দেখেনও নি। তাদের পোশাক আর হাঁটার গতিতেই রাশেদ ভয় পেয়ে যেতো, যদি তার বয়স হতো তেরো-চোদ্দো। তাঁদের দেখে তার বাল্যকাল আর এখনকার ধার্মিকদের মধ্যে একটা বড়ো পার্থক্য সে ওই মুহূর্তেই বোধ করে। আগে পথে কয়েকজন ধার্মিক লোক দেখলে বুকে সুখ লাগতো, মনে হতো তারা মসজিদে যাচ্ছেন বা ফিরছেন, এখন পথে কয়েকজন ধার্মিক লোককে একসাথে দেখলে বুক কেঁপে ওঠে, মনে হয় তারা কোথাও খুন করতে যাচ্ছে বা খুন করে ফিরলো। এঁরা কোথায় যাচ্ছেন, এতো তাড়াতাড়ি কেনো হাঁটছেন এঁরা; রাশেদ মুহর্তের জন্যে তেরো বছরের বালক হয়ে ওঠে, একটা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে যায়, একটা রিকশা ডেকে উঠে বসে। একটু দূরে যেতেই সন্ধ্যা নামার মতো হয়, চারদিকে অজস্র মাইকে আজান বেজে উঠতে থাকে। পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণে অজস্র মাইকে,-রাশেদের কাছে আজান মানেই হচ্ছে হেডমৌলভি সাহেবের কণ্ঠের স্বরমালা, যা গাছের পাতার ভেতর দিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে অলৌকিক গানের মতো এসে। পৌঁছোতে তার কানে, সে কান পেতে থাকতো যার জন্যে;–আজ সন্ধ্যায় মাইকের শব্দে ভীত হয়ে ওঠে রাশেদ, উত্তর দিকের মাইকগুলো তাকে ভয় দেখায়, দক্ষিণ দিকের মাইকগুলো তাকে ভয় দেখায়, পশ্চিম দিকের মাইকগুলো তাকে ভয় দেখায়, পুব দিকের মাইকগুলো তাকে ভয় দেখায়। ঢাকা শহরের সব মাইক গম্বুজ ভেঙেচুরে ক্রুদ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়তে থাকে, তীব্র গতিতে উড়ে আসতে থাকে তার দিকে, প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে আশমানজমিন, এসেই পেঁচিয়ে ধরে তার গলা; একটি, দুটি, তিনটি, চারটি,…হাজার হাজার, লাখ লাখ মাইক তার দিকে উড়ে আসছে, তাকে পেঁচিয়ে ধরছে, রাশেদ দম ফেলতে পারছে না। রাশেদ আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু অন্ধকার দেখতে পায়, কোনো চাঁদ দেখতে পায় না, তারা দেখতে পায় না; সে প্রাণপণে। হেডমৌলভি সাহেবের কণ্ঠস্বর শোনার চেষ্টা করে, দেখার চেষ্টা করে হেডমৌলভি সাহেবের কণ্ঠ থেকে ওই স্বর বেরিয়ে গাছের পাতার সবুজের ভেতর দিয়ে জ্যোৎত্সার মতো গলে গলে আসছে তার দিকে, ওই স্বর কুয়াশায় ভিজে ভিজে জোনাকির মতো আসছে তার দিকে; কিন্তু রাশেদ তা দেখতে পায় না। রাশেদ দেখতে পায় সেই অদ্ভুত লোকগুলো তার দিকে ছুটে আসছে, জোব্বার ভেতর থেকে বের করে আনছে। তলোয়ার, রাশেদ ছুটতে গিয়ে ছুটতে পারছে না, প্রত্যেকটি পথ আর গলির মুখে তারা দাঁড়িয়ে আছে।