রাশেদ ঠিক করেছে সে কোনো প্রতিযোগিতায় যাবে না, সে প্রতিযোগিতার ইঁদুর হবে না, সে হবে ব্যর্থ, ব্যর্থ মানুষ, চারপাশের সফল মানুষদের মধ্যে সে থাকবে ব্যর্থ মানুষ, তাকে দেখে কেউ ঈর্ষা বোধ করবে না। তার পক্ষে ব্যর্থ হওয়ার উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে একটি দুরূহ বই লেখা–দুরূহ বই, অত্যন্ত দুরূহ, যে-বই বাঙালি, বাঙালি। মুসলমান কখনো পড়বে না, যে-বই কারো কাজে লাগবে না; কিছুটা লিখেও ফেলেছে, কিন্তু এখন আর লেখার ইচ্ছে হয় না। কেনো হবে? সে কি বাঙালি নয়; সে কি বাঙালি মুসলমান নয়? বাঙালি এবং বাঙালি মুসলমানের ব্যাধি কি থাকবে না তার মধ্যে? বাঙালি এবং বাঙালি মুসলমান গোত্রে জন্ম নিয়ে মহৎ কিছু করার বীজ কী করে থাকবে। তার মধ্যে? তার মধ্যে থাকবে শুধু নষ্ট হওয়ার বীজ, চারপাশ তাকে দেবে পতিত হওয়ার মন্ত্রণা। দুরূহ বই লেখার বদলে রাশেদ কয়েকটি রচনা লিখে ফেললো, ওগুলোকে সে রচনাই বলে, এমন সব বিষয়ে যেসব বিষয়ে সে কখনো লিখবে বলে ভাবে নি; রচনাগুলো অখ্যাত একটি সাপ্তাহিকে বেরোনোর পর রাশেদ বুঝতে পারলো কতোটা অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে চারপাশে। প্রথম প্রথম অবশ্য তার ভালোই লাগছিলো; মাঝেমাঝেই একটি দুটি করে তরুণতরুণী আসছে তার কাছে, শুধু প্রশংসা করছে তার সাহসের, আর রাশেদ বিব্রত বোধ করছে এজন্যে যে সে আসলে কোনো কোনো সাহসই দেখায় নি, সাহস দেখানোর জন্যে সে লেখে নি ওই রচনাগুলো, সে লিখেছে কিছু সত্য প্রকাশ করার জন্যে। তাহলে কি ব্যর্থ হয়ে গেলো তার রচনাগুলো রচনাগুলোতে সত্য না দেখে তারা দেখছে সাহস। রাশেদ তাদের চোখেমুখে দেখতে পায় প্রচণ্ড ভীতি, ভয়ে কুঁকড়ে আছে তারা; সে যে তাদের মধ্যে এতোটা ভয় জাগিয়ে দিয়েছে, তাতে রাশেদেরই ভয় লাগে। এ-তরুণতরুণীরা অত্যন্ত সাহসী, বাস্তব সাহসের কোনো অভাব নেই তাদের, নিয়মিতই মিছিল করে তারা, গোলাগুলির মধ্যে পড়ে, মরতেও ভয় করে না, কিন্তু রাশেদ দেখতে পায় তাদের কল্পনোক ভরে আছে ভীতিতে। তারা সবাই প্রথমেই একটি প্রশ্ন করে রাশেদকে, যেনো এটাই চরম প্রশ্ন, এটা জানা হয়ে গেলে সব জানা হয়ে যায়, আর কিছু জানার বাকি থাকে না;-তারা জানতে চায়, আপনি কি নাস্তিক? রাশেদ যদি বলে গতকাল সে দুটি লোককে খুন করেছে, তিনটি তরুণীকে ধর্ষণ করার পর গলা কেটে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে, তাহলেও তারা ততোটা ভয় পাবে না, যতোটা ভয় পাবে যদি সে বলে সে নাস্তিক। একটা অলৌকিক ভয়ে তারা কাঁপছে, ওই ভয় আদিম কাল থেকে মাটির ভেতর দিয়ে রসের মতো চলে এসেছে, শেকড় বেয়ে বেয়ে তাদের ভেতরে ঢুকেছে, সারাক্ষণ ওই ভয়ে কাঁপছে তারা। ওদের জন্যে মায়া হয় রাশেদের, সে সরাসরি উত্তর দেয় না, দিলে হয়তো ওরা সহ্য করতে পারবে না, চিৎকার করে দাপাতে দাপাতে তার সামনেই মারা যাবে। রাশেদের ছেলেবেলায় তো এতো ধর্ম ছিলো না, আল্লা তোতা তখন তাদের এতো ভয় দেখাতো না; এখন চারদিকে আল্লাই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে সজীব ব্যক্তিত্ব, এবং তার ভয়ে সবাই। কাঁপছে, যদিও সে নিজে কাউকে ভয় দেখাচ্ছে না। এর আগে এতো ভয়ংকরভাবে। কখনো আল্লা আত্মপ্রকাশ করে নি। পত্রিকা খুললে মনে হয় আল্লাই এখন রাজনীতি করছে, আল্লাই এখন রাষ্ট্র চালাচ্ছে, আল্লাই এখন বিমান উড়োচ্ছে, আল্লাই এখন সিনেমা হল উদ্বোধন করছে, এবং আল্লা সারাক্ষণ ভয় দেখাচ্ছে।
রাশেদ তাদের বলে য়ে সম্পূর্ণ আস্তিক বলে কিছু নেই, যারা আস্তিক, তারাও অন্য ধর্মের চোখে নাস্তিক; একজন ধার্মিক মুসলমানের চোখে একজন ধার্মিক হিন্দু নাস্তিক, একজন ধার্মিক হিন্দুর চোখে একজন ধার্মিক মুসলমান নাস্তিক, যদিও তারা নিজেদের আল্লা আর ভগবানে বিশ্বাস করে; আর ধর্মপ্রবর্তকেরাও এক অর্থে নাস্তিক, কেননা তারা সবাই পিতার ধর্ম ছেড়ে প্রস্তাব করেছে নতুন ধর্ম, নিজের ধর্ম। রাশেদের কথায় তার। সামনের তরুণ দুটি আর তরুণীটি কেঁপে ওঠে, যদিও তারা খুব প্রগতিশীল, তারা বিশ্বাস করে শ্রেণীসংগ্রামে, এবং সাহসী, মরতে তারা ভয় পায় না। রাশেদ বলে অনেক ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে, আছে নানা রকম স্রষ্টা; এতোগুলো ধর্ম আর এতোগুলো স্রষ্টা থাকার অর্থ সবই মানুষের কল্পনা, বেশ আদিম কল্পনা, এগুলো একে অন্যকে বাতিল করে দেয়। রাশেদ বলে, প্রত্যেক ধর্মের দুটি দিক রয়েছে, একটি বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব, আরেকটি সমাজ কীভাবে চলবে তার বিধান। প্রতিটি ধর্মেরই বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব ভুল, আর সমাজও ধর্মের পুরোনো বিধান অনুসারে আর চলতে পারে না, পৃথিবী অনেক বদলে গেছে, আরো অনেক বদলে যাবে। একটি তরুণ প্রায় কেঁদে ফেলে, তাহলে কি আল্লা। নেই? রাশেদ বলে, আল্লা এমন ব্যাপার যা প্রমাণ করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না, অর্থাৎ স্রষ্টা অবৈজ্ঞানিক ব্যাপার, বিজ্ঞান তার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ পায় নি, পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। একটি তরুণ বলে, তাহলে কি আমরা বিশ্বাস করবো না, বিশ্বাস বলে। কি কিছু থাকবে না? রাশেদ বলে, মানুষের সব বিশ্বাসই অপবিশ্বাস। আমরা যা কিছু। বিশ্বাস করে আসছি, তার অধিকাংশের মূলে সত্য নেই, আর কোনো বিশ্বাসই চিরন্তন নয়, বিশ্বাসের বদল ঘটে যুগে যুগে। তরুণীটি বলে, তাহলে কি নামাজরোজা করতে। হবে না? রাশেদ বলে, না, দরকার নেই। এ-তরুণতরুণীরা নামাজরোজা করে না, তবু তারা আঁৎকে ওঠে, চোখমুখ তাদের খসখসে হয়ে ওঠে। রাশেদ বলে, মনে করা যাক। একজন স্রষ্টা রয়েছে, সে মহাজগতের সব কিছু সৃষ্টি করেছে, তাহলেও তার উদ্দেশে। প্রার্থনার আনুষ্ঠানিকতা অপ্রয়োজনীয়। কারণ যে অনন্ত মহাজগত সৃষ্টি করতে পারে, সে নিশ্চয়ই হবে অত্যন্ত মহান, মানুষের মতো তুচ্ছ প্রাণীর তুচ্ছ প্রশংসা তার দরকার পড়তে পারে না। রাশেদ বলে, ব্ল্যাকবোর্ডে ছোটো একটি বিন্দু যতোটা ছোটো, মহাজগতে মানুষ ওই বিন্দুর থেকেও ছোটো, তুচ্ছ; এতো ছোটো তুচ্ছ মানুষের কথা স্রষ্টা সব সময় ভাববে, তার জন্যে স্বর্গনরক বানিয়ে রাখবে, এটা হাস্যকর চিন্তা। রাশেদ বলে, এ-দালানে কোথাও পিঁপড়ে নিশ্চয়ই রয়েছে, ওই পিঁপড়েগুলোর কথা আমরা কেউ ভাবছি না, পিঁপড়েগুলোর কোনো আচরণই আমাদের ভাবনার বিষয় নয়। পিঁপড়েগুলো। যদি মনে করে আমরা তাদের কথা সব সময় ভাবছি, তারা আমাদের স্তব করছে কিনা তার হিশেব রাখছি, তা যেমন হাস্যকর হবে, তারচেয়েও হাস্যকর মানুষের প্রার্থনা। কারণ স্রষ্টা থাকলে সে এতো মহান হবে যে তুচ্ছ মানুষের নিরর্থক স্তুতি সে কখনো। চাইবে না। অনন্ত মহাজগতে সূর্য একটি অত্যন্ত গরিব তুচ্ছ হলদে তারা, পৃথিবী ওই নক্ষত্রের একটি অত্যন্ত গরিব তুচ্ছ গ্রহ, আর মানুষ একটি বিন্দুর থেকেও তুচ্ছ। স্রষ্টা এতো তুচ্ছ বিন্দুর স্তুতির জন্যে কাতর হতে পারে না। প্রতিটি ধর্মের প্রার্থনার শ্লোকগুলো খুবই মলিন, স্রষ্টা সেগুলো শুনলে খুব খুশি হবে বলে মনে হয় না। একটি ছেলে বলে, আমার ভয় লাগছে, আমি ভয় পাচ্ছি, সে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বাস্তব ভয়ের থেকে অনেক ভয়ংকর অলীক ভয়।