মজনু এক সুন্দর বিকেলবেলা হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের মোড়ে পৌঁছে, এবং দক্ষিণ দিকে মুখ ফিরিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ায়; দু-হাত উডডীন, ও চিৎকার করে সে। সবাইকে গাড়ি থামাতে বলে, মুহূর্তে সেখানে টয়োটা ডাটসান সুজিকি পাজেরো ওয়াগন স্টারলেট হারলট বারলটের ভিড় পুঞ্জিত হয়ে ওঠে, নতুন কোনো সামরিক বিধি ঘোষিত হয়েছে ভেবে ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীরা চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। সরণীটি ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীদের নিজস্ব, গরুত্বহীন প্রাণীরা এ-সরণীতে চলতে পারে না, এ-সরণীতে চলতে পারা গৌরবের ব্যাপার, নিউইঅর্ক থেকে ফিরে গ্রাম্য বাঙালিরা। যেমন কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন রাস্তার গল্প করে, এ-সরণীতে চলতে পেরেও অধিকাংশ শূদ্র বাঙালি তার গল্প করে, স্ত্রী, সন্তান, সহকর্মী, শ্বশুরের কাছে, এমনকি গৃহপরিচারিকার কাছেও। যে-ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীরা নিয়মিত চলেন এ-সরণীতে, তাঁরা দ্রুতগতিশীল, গন্তব্যে তাদের পৌঁছোতে হয় স্বল্পতম সময়ে, লইলে বিপর্যয় ঘটতে। পারে; এমন ঘটনার সাথে তাদের এর আগে পরিচয় ঘটে নি, তারা কখনো স্বপ্নেও ভাবেন নি তাদের নিজস্ব সরণীতে কেউ দু-হাত তুলে তাঁদের গাড়ি থামাতে পারে। মজনু একটি ঝকঝকে গাড়ির সামনে গিয়ে সালাম দেয়, সালাম পেলে ভারিগুরুত্বপূর্ণরা খুব বোধ করেন, গাড়ি থেকে একজন ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণী বেরিয়ে আসেন, মজনু আবার। তাকে সালাম দেয়, তাতে গুরুত্বপূর্ণপ্রাণীটি আরো গুরুত্ব বোধ করেন। মজনু হঠাৎ তার মুখমণ্ডল চেপে ধরে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে একবার ঘষা দেয়, ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীটি খুব বিস্মিত হন, মুখমণ্ডল তার আগুনের মতো জ্বলে উঠলেও তিনি গুরুত্বসহকারে মজনুকে জিজ্ঞেস করেন, এ আপনি কী করছেন? মজনু বলে, মিথ্যা, পচা পাটের গন্ধই সত্য। ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীটি আরো বিস্মিত হয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েন; মজনু আরেকটি গাড়ির সামনে গিয়ে সালাম দেয়, আরেকটি ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণী বেরিয়ে আসেন। মজনু তার মুখমণ্ডলেও ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষা দেয়, ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীটি বিস্মিত হয়ে বলেন, এ কী অসভ্যতা। মজনু বলে, মিথ্যা, আউশধানই সত্য। মজনু আরেকটি গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়, আরেকজন ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণী বেরিয়ে আসেন; মজনু তাকে জলমলে টাই ধরে ঘষা দেয়, তার এক ঘষায় টাইয়ের মাঝখানে আগুন ধরে যায়। মজনু বলে, মিথ্যা, গামছাই সত্য। মাঝেমাঝেই মজনু এভাবে সভ্য সুন্দর মানুষদের বিব্রত করে তোলে, মজনু চারদিকে কোথাও কোনো সত্য খুঁজে পায় না। মজনু অনেক সময় বিশাল বিশাল বস্তুদেরও মুঠোতে ফেলে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে, কী ঘষছে কেউ দেখতে পায় না, শুধু মজনুই দেখতে পায়, এবং দেখে যে ওই সবই মিথ্যা। সংসদ, বিচারালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, সেনানিবাস সব কিছুকেই ঘষে ঘষে শূন্যে উড়িয়ে দিয়ে মজনু বলে, মিথ্যা। রাশেদ কি নেমে যাবে মজনুর পথে, দেখতে চেষ্টা করবে সব কিছুর অন্তর্নিহিত সত্য?
বর্তমানহীন ভবিষ্যহীন
এক আদিম সমাজের মানুষ আমি, রাশেদ মনে মনে-না, তার সম্ভবত আর মন নেই, অন্য কিছু একটা আছে হয়তো, হয়তো তাও নেই, সেখানেই সে বলছে, আমি আদিম সমাজের মানুষ, হয়তো মানুষও নই, সভ্যতার সংবাদ আমি রাখি না, আমার গোত্র। রাখে না, আমার গোত্র আমাকে নির্দেশ দিচ্ছে তুমি সভ্যতার ভেতরে ঢুকবে না, বাইরে থাকবে সভ্যতার, থাকবে আদিম, আদিমতর, আদিমতম। পথের ওই ভিখিরিটি আদিম, সে আর কিছু জানে না তার ক্ষুধা ছাড়া, ক্ষুধার আগুন ছাড়া, কাম ছাড়া; উদ্দিন মোহাম্মদও তার মতোই আদিম, ক্ষুধা আর কাম ছাড়া সেও কিছু জানে না, তার ক্ষুধা। ভিখিরির ক্ষুধার থেকে অনেক বেশি, শুধু খাদ্যে তার ক্ষুধা মেটে না, তার কাম ভিখিরির কামের থেকেও ভয়ংকর, শুধু নারীতে তার কাম তৃপ্ত হয় না; তার মতোই ক্ষুধার্ত কামার্ত আমার গোত্রের সবাই; আদিম ওই রাজনীতিকেরা, যারা মানুষকে খুব। ভালোবাসে, জনগণের জন্যে যারা প্রাণ বিলিয়ে দিচ্ছে, বিলিয়ে দিতে চাইলেও দিতে পারছে না, কেনো তারা ক্ষমতা পায় নি; আদিম ওই সেনাপতি, আদিম ওই চিকিৎসক, আদিম ওই অধ্যাপক, আদিম ওই আমলা, আদিম ওই চোরাচালানি, আদিম ওই মৌলভিমোল্লা; এ-অরণ্যে আদিমতা ছাড়া আর কিছু নেই; উদ্দিন মোহাম্মদ এখানে দেখা দেবেই। উদ্দিন মোহাম্মদকে কে সৃষ্টি করেছে? আমরাই সৃষ্টি করেছি উদ্দিন। মোহাম্মদকে; উদ্দিন মোহাম্মদ দেখা দিয়েছে আমাদেরই দূষিত রক্তের ভেতর থেকে, উদ্দিন মোহাম্মদ প্রাদুর্ভূত হয়েছে আমাদেরই নষ্ট হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থেকে, আমরা তা বুঝতে পারছি না; উদ্দিন মোহাম্মদ জেগে উঠেছে আমাদেরই অসুস্থ স্বপ্ন থেকে, উদ্দিন মোহাম্মদ বিকশিত হয়েছে আমাদেরই রুগ্ন নিশ্বাস থেকে, আমরা তা বুঝতে পারছি না; আমাদের পচন-লাগা মনের গভীরে আমরা তাকে ভালোবাসি, দূষিত রক্তের স্তরে স্তরে আমরা তাকে ভালোবাসি, আমরা তা বুঝতে পারছি না; সে চামড়ার ওপর হঠাৎ–গজিয়ে-ওঠা ফোড়া নয়, সে আমাদের দূষিত আত্মা। সে আমাদের সন্তান, সে! আমাদের পিতা, সে আমাদের পিতামহ; সে আমাদের পূর্বপুরুষ, সে আমাদের। উত্তরপুরুষ, সে আমরাই। উদ্দিন মোহাম্মদ একদিন মিশে যাবে, কিন্তু যাবে না, আবার দেখা দেবে, সে আছে আমাদের ময়লা রক্তের গভীরে, রুগ্ন স্বপ্নের গর্তে, নষ্ট কামনার খোড়লে খোড়লে। আমরা দূষিত মানুষ, আমরা দূষিত জাতি, আমরা দূষিত গোত্র। আমার গোত্রের অতীত নেই, বর্তমান নেই, ভবিষ্যৎ নেই। আমি যখন অতীতের দিকে তাকাই কোনো গৌরব আমার আমাকে প্রদীপ্ত করে না, আমার পূর্বপুরুষ আমাকে। বিদেশির দাসে পরিণত করেছে; আমি যখন বর্তমানের দিকে তাকাই কোনো আলো আমাকে উজ্জ্বল করে না, আমার সমাজ আমাকে নষ্ট মানুষদের অধীন করেছে; আমি যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই কোনো সম্ভাবনা আমাকে পথ দেখায় না, সব সম্ভাবনাকে আমরা লুপ্ত করেছি। অশেষ অন্ধকারে শুধু দুটি জোনাকির জ্বলে ওঠা দেখি, আর কোনো শিখা দেখি না, শুধু অন্ধকার দেখি। আমার শ্রুতি ভরে আছে মিথ্যায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমার শ্রুতিতে জমেছে মিথ্যা; আমার রাজা আমাকে মিথ্যা শুনিয়েছে, আমার কবি আমাকে মিথ্যা শুনিয়েছে, আমার পুরোহিত আমার সামনে মিথ্যার পুথি মেলে ধরেছে, আমার পুস্তক আমাকে মিথ্যার পাঠ দিয়েছে। আমি মিথ্যা দ্বারা পরিবৃত হয়ে আছি। আমি মিথ্যার সন্তান, আমি জন্ম দিই মিথ্যা।