রাশেদ তখন প্রায়ই উঁকি দিতো ইস্কুলে স্যারদের বসার ঘরে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে শুনতো স্যারদের কথা, মনে হতো স্যাররা খুব খুশি হয়েছেন খানরা আসায়। প্রায় সব স্যারই বলতেন, পাকিস্থান বাচলো; শুধু সহকারী হেডমাষ্টার স্যার, যিনি পড়াতেন সবচেয়ে ভালো এবং হিন্দু ছিলেন, তিনিই শুধু বলতেন, পাকিস্থান এবার মরলো। রাশেদ বুঝে উঠতে না দেশটিকে কী রোগে ধরেছিলো, কিন্তু বাঁচামরার কথা। শুনে শুনে সে বুঝেছিলো পাকিস্থানকে এমন রোগে ধরেছে, যার পরিণতি বাঁচা বা মরা; তবে মরার সম্ভাবনাই বেশি। খুব ভয় লাগতো তার, কেননা তার ছেলেবেলায় মৃত্যুই ছিলো স্বাভাবিক ঘটনা; কলেরা ও বসন্তে সে ঘনঘন মৃত্যুর কথা শুনেছে, একটা। দেশকেও কলেরা বা বসন্ত বা যক্ষ্মা রোগে ধরতে পারে বলে মনে হতো তার। অনেক দিন, পঞ্চম শ্রেণীতে ওঠার পর থেকেই সে একটি ভয়ের মধ্যে রয়েছে, যা সে কারো কাছে প্রকাশ করে নি, কিন্তু সে একটি মানচিত্রে দেখেছিলো পাকিস্থানের এ-দিকটা এই দিকে ওই দিকটা ওই দিকে, পাকিস্থানের দুটি টুকরো আছে, কোনো শরীর নেই। তাহলে পাকিস্থান কি একটা ভূত, এমন প্রশ্ন জেগেছিলো তার মনে, সে শুনেছে ভূতদেরই শরীর থাকে না। কিন্তু সব স্যারই তো, শুধু এক স্যার ছাড়া, বলছেন পাকিস্থান বাচলো; তাতে সে একটু স্বস্তি পেয়েছিলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বস্তি থাকে নি, কেননা তার বিশ্বাস ছিলো সহকারী হেডস্যার যেহেতু সবচেয়ে ভালো পড়ান, অঙ্ক করতে কখনো ভুল করেন না, তাই তাঁর কথাই শেষে ঠিক হবে। স্যারদের ঘরে একটি কালিমাখা পত্রিকা আসতো, যার অনেক কিছু পড়াই যেতো না, রাশেদ দেখেছিলো বড়ো বড়ো অক্ষরে প্রতিদিন ছাপা হতো আইউব খানের নাম, আর ছবি। এভোবড়ো ছবি আর কারো ছাপা হতো না পত্রিকাটিতে; এবং তার ছবির নিচে লেখা হতো জাতির রক্ষাকর্তা, মহান ত্রাণকর্তা, আরো অনেক কিছু।
বাঙালি এমন জাতি, যে নিজেকে ঘৃণা করে; আর বাঙালি মুসলমান এমন জাতি, যে পশ্চিম থেকে কোনো বড়ো দেহের জন্তু এলেও তাকে খুব শ্রদ্ধা করে, নিজেকে তো ঘৃণা করেই। রাশেদের মনে আছে তার শিক্ষকেরা, গ্রাম ও বাজারের বুড়োরা বড়ো বড়ো খানদের দেহ আর নামের প্রশংসায় পাগল হয়ে উঠেছিলো। এক স্যার আইউব খানের ছবি দেখিয়ে তাদের বলেছিলেন, চেহারাটা দ্যাখছস, পাঠানের বাচ্চা। এরা না অইলে। পাকিস্থান রাখবো কি বাঙ্গালিরা? নিজেকে খুব অসহায় বলে মনে হয়েছিলো রাশেদের; এবং কয়েকদিন পর তাদের থানার বাজারে দলে দলে খাকিপরা মিলিটারি আছে। মিলিটারি এসেই বাজারের বড়ো বড়ো দোকানদারদের ধরে, তাদের কী অপরাধ তারা জিজ্ঞেস করারও সময় পায় না; মিলিটারিরা তাদের একেকজনের কাঁধে দু-তিনমণি বোঝা তুলে দেয়। বোঝা কাঁধে নিয়ে তাদের দৌড়োতে বলে, কিন্তু ওই বোঝা নিয়ে দাঁড়ানোই ছিলো অসম্ভব; দোকানদাররা বোঝার নিচে চাপা পড়ে, আর পাকিস্থান। রক্ষাকারীরা তাদের ওপর চাবুক চালায়। দূর থেকে পাকিস্থান রক্ষার এ-দৃশ্য দেখে অনেকে পাকিস্থান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে ওঠে। তারপর তারা ধরে আনে সে-সব শয়তানদের, যারা রাজনীতি করে, যারা পাকিস্থানকে ডুবিয়ে দিচ্ছে; ধরে এনে। চৌরাস্তায় ন্যাংটো করে চাবুক মারে। পাকিস্থান বাঁচানোর প্রক্রিয়া দেখে চারপাশের সবাই এতো মুগ্ধ হয় যে বাজারের মৌলানা সাহেবের ইমামতিতে এক বড়ো। মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।
রাশেদ ও তার বন্ধুরা ভয় পেতে লাগলো হয়তো মিলিটারি একদিন তাদের ক্লাশে এসে তাদের কাঁধেও বোঝা তুলে দেবে, হয়তো বড়ো বড়ো-বেঞ্চ তুলে দেবে, তারা না পারলে চাবুক মারবে; তবে তারা আসে নি, আসে তাদের আইন। হেডমাষ্টার একদিন জানান সামরিক নির্দেশ এসেছে তাদের সকলকে একেবারে বাটিছাটা করে চুল ঘেঁটে আসতে হবে। তারা সবাই চুল হেঁটে মাথা প্রায় চুলশূন্য করে তোলে, তাদের ক্লাশগুলো অদ্ভুত দেখাতে থাকে; এ-অবস্থা দেখে সহকারী হেডমাষ্টার স্যার বলেন, মাথাকে যে তোরা একেবারে পাকিস্থান বানিয়ে ফেলেছিস! তাদের চুলের ওপর দিয়ে সামরিক আইন চলে গেছে ভেবে যখন রাশেদ ও তার বন্ধুরা কিছুটা নিশ্চিন্ত হচ্ছিলো, তখন, চুল ছাঁটার একদিন পরেই, হেডমাষ্টার জানান সামরিক নির্দেশ এসেছে যে প্রত্যেককে বাড়ির চারপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে ঘরবাড়ি ঝকঝকে করে ফেলতে হবে। পাকিস্থানে কোনো জঙ্গল থাকবে না; পাকিস্থানকে উর্দির মতো ইস্ত্রি করতে হবে, গোঁফের মতো ছাঁটতে হবে, বুটের মতো পালিশ করে ফেলতে হবে। গ্রামে ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেয়া হলো দেশে সামরিক আইন জারি হয়েছে, জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খান পাকিস্থান রক্ষা করেছেন, সামরিক আইনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা চলবে না, যে-আদেশ দেয়া হয় তা মেনে চলতে হবে, এবং বাড়ির ময়লা আর জঙ্গল পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। ঘোষণায় বারবার চাবুক মারার কথা বলা হলো, প্রতিটি অপরাধের জন্যে চাবুকের। সংখ্যাও জানিয়ে দেয়া হলো। রাশেদ বুঝলো পাকিস্থানে আছে দুটি জিনিশ, একটি অপরাধ আরেকটি চাবুক; পাকিস্থানি মাত্রই অপরাধী, ও তার প্রাপ্য চাবুক। পাকিস্থানকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি পাকিস্থানিকে আচ্ছা করে চাবুক মারতে হবে, গায়ের ছাল তুলে। ফেলত হবে, গলা দিয়ে রক্ত বমি করাতে হবে, পেছন দিয়ে মল বের করতে হবে, তবেই পবিত্র পাকিস্থান বাঁচবে। তাদের গ্রামের দাগু জোলা থানার হাটে কাপড় বেচতে গিয়ে রাস্তায় থুতু ফেলেছিলো, তার পিতামহ থেকে সে ও সবাই চিরকাল নিশ্চিন্তে থুতু ফেলে এসেছে, মনে করেছে থুতু ফেলা তাদের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত, সে জানতো না যে থুতু ফেলা সামরিক আইনের ধারাভুক্ত হয়ে গেছে। দাগু রাস্তায় থুতু ফেলার অপরাধে পঁচিশ ঘা চাবুক খেয়ে সাত দিন ধরে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে, অন্যরা পাকিস্থানকে সুস্থ রাখার জন্যে থুতু গিলে ফেলার অভ্যাস করতে থাকে।