আক্কাস আলির ‘আলতুফালতু’তে এখন কথা বলছেন’ ঐশী উচ্চারণ করে চলছেন, দোনাগাজি, দেশের মুখ্য মহামহোপাধ্যায়; কবিও, সমালোচকও, এবং সব কিছু। পাকিস্থানের জন্যে বদ্ধপাগল ছিলেন তিনি একদা, বলেছিলেন পাকিস্থানের জন্যে বাঙালি মুসলমান বাঙলা ভাষা বাদ দিতে রাজি, বাঙলা মুসলমানের ভাষা নয়; আর একাত্তরে চাপে পড়ে পালিয়েছিলেন দেশ থেকে, ফিরেছিলেন বড়ো একটা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে, দেশে থাকলে হতেন আলবদরদের প্রধান, সেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে একটির পর একটি পুরস্কার নিয়েছিলেন, আর পঁচাত্তরের পর ইঁদুর পুনরায় ইঁদুর হয়েছেন। আগের একনায়ক বালকটির পা ধরে একটা বড়ো পদ পেয়েছিলেন, পরে বালকটি তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিলো, সে-শোকে মুহ্যমান ছিলেন কয়েক বছর, এখন দেখা দিয়েছেন আবার, উদ্দিন মোহাম্মদের পদচুম্বন করে পদকের পর পদক পাচ্ছেন, সেই দোনাগাজি সন্ধ্যাভাষায় উচ্চারণ করে চলছেন তার মন্ত্র;-তিনি কথা বলেন না, উচ্চারণ করেন, অনবরত উচ্চারণ করেন, শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তার উচ্চারণ শোনে, রাশেদও শুনছে, তার মগজের ভেতর দিয়ে একটা পিচ্ছিল সাপ এঁকেবেঁকে চলছে। তিনি তাঁর গাভীতত্ত্ব ব্যাখ্যা করছেন, যদিও আক্কাস আলি তাকে তার গরুতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি গাভীতত্ত্ব ব্যাখ্যা করছেন, যেহেতু গরুর থেকে গাভী অনেক বেশি। নন্দনতত্ত্বসম্মত; দোনাগাজি বলছেন, গাভী হচ্ছে অন্ধকারে অনবরত উচ্চারণ, গাভী হচ্ছে একটি নির্মাণ, ওই নির্মাণকে আমরা সতত আবিষ্কার করি উচ্চারণের মধ্যে, যেমন। আমরা অন্ধকারে তমালকে আবিষ্কার করি দ্বিদল ফুলকে আবিষ্কার করি, তাকে নির্মাণ করি আত্মার মধ্যে যেমন করেছেন দান্তে এবং বাল্মীকি, তেমনি গাভী হচ্ছে অন্ধকারে আত্মার অনবরত উচ্চারণ অনবরত আবিষ্কার। রাশেদের ইচ্ছে করছে ওর মুখমণ্ডলে, ঘন বিকশিত শত্রুতে, গাভীর পেছন দিক থেকে সারবস্তু আবিষ্কার করে এনে মেখে দিতে। পল্লীটি ভরে গেছে এসব প্রাণীতে, ভাল্লুক উল্লুক রজ্জব আলি আক্কাস আলি ভাড়োত্তম দোনাগাজিতে, রাশেদ তুমি কোন দিকে যাবে? রাশেদ কি মজনুর পথে নেমে যাবে, মজনুর মতো খুঁজে চলবে সত্যকে, খাঁটিকে, পথে যা-ই পাবে, তা-ই ঘষেই দেখবে। জিনিশটি খাঁটি কিনা? মাঝেমাঝে রাশেদের কি মনে হচ্ছে না সে মজনু হয়ে উঠছে, এর চেয়ে মজনু হয়ে যাওয়াই ভালো?
মজনু বিশ্বাস করতো, স্বপ্ন দেখতে দেশটা স্বপ্নের দেশ হয়ে উঠবে; স্বপ্নটা তার ব্যক্তিগত ছিলো, এবং যাদের সে বিশ্বাস করতো তাদের থেকেও পেয়েছিলো অনেকখানি; বিশ্বাস ছিলো তার গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র স্বাধীনতা প্রগতি নেতায় কবিতায়, এবং আরো অনেক কিছুতে; গত বছর হঠাৎ তার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে যায়, সে চারদিকে মলের মতো ছড়ানো মিথ্যা দেখতে পায়। সবই তার মনে হতে থাকে মিথ্যা, তার প্রাথমিক বিদ্যালয় উদ্দিন মোহাম্মদ নেতা নেত্রী গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র স্বাধীনতা প্রগতি সবই তার কাছে মিথ্যা বলে প্রতিভাত হতে থাকে, সত্য আর খাঁটিকে পাওয়ার জন্যে সে পথে নেমে যায়। চারপাশে যা কিছু চলছে, তা মুকুটখচিত শয়তান ছাড়া কারো পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব, মজনু শয়তান হয়ে উঠতে পারে নি, সে পথে নেমে গেছে; তার কাছে ওই উদ্দীন মোহাম্মদ যেমন প্রচণ্ড মিথ্যা, তারাখচিত সেনাপতিরা যেমন মিথ্যা, তেমনি মিথ্যা ওই নেতানেত্রী, মিছিল, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মঞ্চ; সে সব কিছুর ভেতরে ঢুকে। দেখেছে বাইরের ঝলমলে মুখোশ পেরিয়ে গেলে মিথ্যাই শুধু প্রকট হয়ে দেখা দেয়। তারপর থেকেই সে সত্য খুঁজতে থাকে। তার আর গৃহ দরকার পড়ে না, দরকার পড়ে শয্যা, পরিচ্ছন্ন অটুট বস্ত্রের দরকার হয় না, গাল কামাতে হয় না, বালিকাদের দেখে সে ব্ৰিত বোধ করে না, মিছিলেও যায় না। চারপাশের মিথ্যার বাস্তবতা পেরিয়ে ঢুকেছে সে সত্যের বাস্তবতায়; সে নিজের মনে একলা হাঁটে, সত্যকে পেতে চাই, খাঁটি তুমি কোথায়–ধরনের উক্তি করতে করতে শহরের পথে পথে হাঁটে, ইচ্ছে হলে সত্যের খোঁজে বড়ো বড়ো ভবনেও ঢুকে পড়ে। প্রথম দিকে তার অবস্থা দেখে পরিচিতরা ব্যর্থ হয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করতো সামনে গিয়ে, একটি ঘটনার পর এখন আর পরিচিত। কেউ সে-সাহস পোষণ করে না। তাকে দেখলে উজ্জ্বল মিথ্যারা দূর থেকে দূরে ছুটতে থাকে। মজনু সেদিন তার সত্যের খোঁজে মিরপুর সড়ক থেকে একটি গলির ভেতর। দিয়ে ঢুকে আরেকটি গলির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে হাতির সড়ক ধরে হাঁটছিলো, তার সমাজগণতন্ত্রপরায়ণ নেতা পাজেরো চালিয়ে যাচ্ছিলেন কোথাও বা আসছিলেন উত্তরপাড়া থেকে, তিনি মজনুকে দেখে করুণা বোধ করেন, কয়েক দিন পরেই মন্ত্রী হওয়ার একটা তীব্র সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাঁর, পাজেরো থামিয়ে দলবল নিয়ে তিনি। নেমে আসেন। তিনি মজনুকে নিয়ে যেতে চান, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেবেন; কিন্তু মজনু হঠাৎ তাকে চেপে ধরে মাটিতে ফেলে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে তার মুখমণ্ডল ভরে ঘষতে থাকে। ঘষার ফলে নেতার মুখমণ্ডলের মসৃণ চামড়া উঠে যায়, সঙ্গীরা নেতাকে উদ্ধার করার আপ্রাণ চেষ্টা করে; কিন্তু মজনু তাকে ছাড়ে না, সে বুড়ো আঙুল দিয়ে নেতার মুখমণ্ডল ঘষতে থাকে, নেতার বাইরের চামড়া পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে সে সত্যটাকে দেখতে চায়। নেতা মাসখানেক ধরে একটা সুন্দর মুখ প্রস্তুত। করছিলেন, উপপত্নীদের কাছ থেকে বারবার জেনে নিচ্ছিলেন মুখটি কেমন দেখাচ্ছে, ঢাকার রঙিন বাক্সে কেমন দেখাবে, মজনুর ঘষায় তাঁর মুখমণ্ডলের সত্য বেরিয়ে পড়ায়। তার শপথগ্রহণের দিন পিছিয়ে যায়, তিনি সকালে এক উপপত্নীর বক্ষে বিকেলে আরেক উপপত্নীর বুকে শুয়ে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করতে থাকেন। মজনু বাইরের কোনো কিছুর সত্যেই বিশ্বাসী নয়, ভেতরের সত্যই তার কাছে সত্য, আর তার বুড়ো আঙুলও ভয়ানক প্রখর, তাই পরিচিতরা তাকে এড়িয়ে চলে আজকাল, তারা সত্যের পরীক্ষা দিতে চায় না। মজনুর পায়ের নিচে যে-ইটের টুকরোটি পড়ে, যদি তার ইচ্ছে হয় সেটির সত্য উদঘাটনের, মজনু সেটি হাতে তুলে নেয়, ডান আঙুলে ঘষতে থাকে, টুকরোটি এক সময় শূন্যে মিলিয়ে যায়; মজনু বলে, মিথ্যা। সংবাদপত্র পেলেই সে ঘষতে থাকে, ইটের টুকরোর থেকে অনেক বেশি মিথ্যা সংবাদপত্রগুলো, স্তম্ভে স্তম্ভে চিৎকার করছে মিথ্যা, তাই অল্প সময়ের মধ্যেই তা অদৃশ্য হয়ে যায়; মজনু বলে, মিথ্যা।