এ-বাক্স, আবর্জনার বাক্সটিই এখন বাঙলাদেশ, ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইল বিশ ইঞ্চিতে পরিণত এখন, এ-বাক্স এখন বহুগুণে সত্য বাঙলাদেশের থেকে, এ-বাক্স বাস্তবতার থেকে অনেক বেশি বাস্তব। কিছু আর সত্য নয়, যা এ-বাক্সে আবর্জনারূপে জমে না, আর তাই প্রতিভা যা এ-বাক্স থেকে বিচ্ছুরিত হয়। সত্য হচ্ছে, ভাঁড়টি যেমন। বলে গেলো, দু-দিন পর হরতাল হবে না, হরতালের হওয়ার কোনো সাধ্য নেই, বাক্সের বাইরের কোনো সত্যই সত্য নয়, রাশেদ জানে দু-দিন পর দেখা যাবে দেশজুড়ে হরতাল হ’লেও দেশজুড়ে হরতাল হয় নি। আর প্রতিভা হচ্ছেন ওই অধ্যাপক আক্কাস আলি, যিনি চক্রবরফক্কর পরে ‘আলতুফালতু’ নামের মাখাজিন উপস্থাপন করছেন, বারবার ওপরের ঠোঁটের থুতু চাটছেন নিচের ঠোঁট দিয়ে, আর নিচের ঠোঁটের থুতু চাটছেন ওপরের ঠোঁট দিয়ে, চাটার ভঙ্গিটি তার অপূর্ব ঠোঁট দুটি একটু দীর্ঘ বলেই, তিনি এখন নাচের ভেতর দিয়ে গান আর গানের অভ্যন্তর দিয়ে যে-নাচটি পরিবেশিত হবে, তার ভূমিকা পেশ করছেন, দর্শকদের তালি বাজাতে বলছেন, তবে গোঁফে এক টুকরো থুতু আটকে তাঁকে বিব্রত করে তুলছে, তিনি তাঁর বাক্যগুলোকে যথেষ্ট চিবোতে পারছেন না, তাই সুস্বাদু লাগছে না। অধ্যাপক আক্কাস বইটই পড়ছেন না আজকাল, লেখার চেষ্টা করেছিলেন শুভবিবাহের আগে, আর লিখতে পারেন নি-একটা তিনবছুরে বই ছাড়া; তিনি প্রতিভা, যেহেতু তিনি বাক্সে আলতুফালতু করেন। আগের একনায়কটি তার ঠোঁট চাটা পছন্দ করতো না, আশ্চর্য, একনায়কদেরও রুচিবোধ থাকে, তাই তিনি বহিষ্কৃত। হয়েছিলেন বাক্স থেকে, তাতে আক্কাস আলির একটা ছোটোখাটো স্ট্রোক হয়েছিলো, উদ্দিন মোহাম্মদ আসার পর তিনি আবার প্রতিভা বিকাশ করে চলছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়টির জন্যে মায়া হয় রাশেদের, তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি গৌরব বোধ করে আক্কাস আলিকে নিয়ে, বইটই সবাই লিখতে পারে, আলতুফালতু করতে পারেন শুধু অধ্যাপক আক্কাস আলি। আক্কাস আলি এখন একটি বালিকার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, ঢলঢল করছে বালিকাটি, আক্কাস আলি একটু বেশি করে ঠোঁট চাটছেন, তিনি বালিকার প্রতিভা বর্ণনা করছেন, শুনে মুগ্ধ হচ্ছে রাশেদ, চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ছে তার রক্তমাংসে, রাশেদ বালিকাটিকে চিনতে পারছে, দু-দিন আগে তিনঘণ্টা ধরে রাশেদ তো। এ-প্রতিভাময়ীরই সোনালি জীবনের রুপোলি পুরাণ আর নীল কথকতা পাঠ করেছে। রাশেদ সেদিন ঘরে ফিরে শুনতে পায় মমতাজ মৃদুকে কী যেনো পড়ে শোনাচ্ছে, সম্ভবত রূপকথা শোনাচ্ছে, মৃদু আজকাল দিনরাত গল্প শুনতে চায়, ওর জন্যে একটি শাহেরজাদি দরকার, রাশেদের রূপকথার সব মজুত ফুরিয়ে গেছে, নিশ্চয়ই মমতাজের সংগ্রহও নিঃশেষ, তাই পত্রিকা থেকেই পড়ে শোনাচ্ছে, মৃদু মনপ্রাণ দিয়ে শুনছে সে-রূপকথা। মমতাজ পড়ছে, আকবর তার তন্বী লাস্যময়ী নববধুকে নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছে, মাত্র তিন মাস হলো বিয়ে হয়েছে তাদের, পাজেরো চালাচ্ছে কোটিপতি আকবর নিজে, পাশে তার রূপসী যৌবনবতী বধু লায়লা। লায়লার চুল উড়ছে, তার চোখে। সাগরের স্বপ্ন, প্রেমের স্বপ্ন, এমন সময় আকবর তার পাজেরো থামায় নির্জন রাস্তার পাশে। তখন আকাশে চাঁদ উঠেছে, চাঁদের আলোতে লায়লা হয়ে উঠেছে আরো রূপসী, চাঁদের আলোর মতোই তার শরীরে যৌবনের জোয়ার। আকবর একটা কোকের বোতল তুলে হঠাৎ প্রচণ্ড আঘাত করলো লায়লার মাথায়, লায়লা লুটিয়ে পড়লো, একটি ছুরি ঢুকিয়ে দিলো আকবর লায়লার পেটে। রাশেদ থমকে দাঁড়িয়ে শুনছিলো রূপকথা, মৃদু কি আজকাল এ-রূপকথাই শুনছে? নতুন রূপকথা জন্ম নিচ্ছে দেশজুড়ে, যা অনেক বেশি শিহরণজাগানো লালকমল নীলকমল তুষারকন্যার থেকে। মমতাজ একটু থামতেই মৃদু বলছে, আরো পড়ো আম্মা, আরো পড়ো, তার রক্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, নীলকমল লালকমল তাকে এতোটা উত্তেজিত করে নি; মমতাজ পড়ছে, আজরাত ভোর হওয়ার। আগে পাষণ্ড আকবরের ফাঁসি হবে, সকাল থেকেই তাকে তৈরি করা হচ্ছে ফাঁসির জন্যে। দেশ ভরে খোঁজার পর একজন জল্লাদ পাওয়া গেছে, জল্লাদ পাকা কলা দিয়ে বারবার ফাঁসির রশি মেজে রশিটিকে পিচ্ছিল করেছে, আজো সে রশির গায়ে পাকা। কলা মাখবে, আকবরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে সে কী খেতে চায়, আকবর বলেছে সে সিগারেট খেতে চায়, কাকে দেখতে চায়, আকবর বলেছে সে তার উপপত্নী নুরজাহানকে দেখতে চায়। রাশেদ মমতাজকে ডাকে; পড়া রেখে মমতাজ মাথা তুললে মৃদু উত্তেজিত হয়ে বলে, আরো পড়ো আম্মা, আরো পড়ো আম্মা, আরো শুনতে ইচ্ছে। করছে। ভয় পেয়ে রাশেদ তাকায় মৃদুর দিকে; মৃদু কাঁপছে, নতুন কালের রূপকথা তাকে উত্তেজিত করে তুলেছে, তার স্বপ্নকে তোলপাড় করে চলছে এই সময়ের নায়ক।
দুপুরের খাওয়ার পর রাশেদ চিৎ হয়ে শুয়ে ওই পত্রিকাটি খুলে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে মৃদুর থেকেও; এতো দিন পর পড়ার মতো একটা জিনিশ সে পেয়ে গেছে, এর পর সে এসবই পড়বে, বালিকা আর বালিকা, লাস্য হাস্য যৌবন নিতম্ব ওষ্ঠ স্তন জংঘা জঘনবতী কিশোরীরা পাতার পর পাতা, রঙিন শাদা কালো বালিকা লাল নীল সবুজ হলুদ বালিকা কালো নীল সবুজ বালিকা রঙিন শাদা কালো লাল নীল সবুজ হলুদ। বালিকাদের সময় চলছে এখন, যুবতী কেউ চাইছে না, বালিকা চাইছে সবাই, আরো বালিকা। এই বালিকার বাহু তুলনাহীন। ওই বালিকার নিতম্ব অতুলনীয়। ওই বালিকার বক্ষ অনির্বচনীয়। আক্কাস আলির বালিকাটিও আছে এর মধ্যে, বড়ো বেশিই আছে, তার সব কিছু উপচে পড়ছে, মাধ্যমিক পেরোয় নি, হয়তো আর পেরোরে না, কিন্তু উপচে পড়ছে সম্মুখ পেছন ওপর নিচ, সে–ইংরেজি বাঙলা মিলিয়ে মিশিয়ে বলছে জীবন অ্যাকটা স্বপ্ন, রঙিন ড্রিম, সে নায়িকা হতে চায়, নায়িকা না হলে সে বাঁচবে না, তাই সে মডেলিং করছে, পাঁচটা ছবিতে সই করেছে এরই মাঝে। অভিনয় হচ্ছে আর্ট, আর্ট হচ্ছে। তার জীবন। বালিকা চমৎকার চমৎকার কথা বলেছে, সে খুব ধার্মিক, সময় পেলেই। নামাজ পড়ে, ‘দাউদাউ দিল’, যার ইংরেজি নাম ‘ফায়ারিং হার্ট’, ছবিটার শুভমহরতের পরই সে আজমিরশরিফ যাবে, হজ করারও তার খুব ইচ্ছে আছে। সে খুব ভালো মেয়ে, প্রেম করে না, বিয়ের আগে প্রেম করাকে সে খারাপ মনে করে, বিয়ের পর স্বামীর সাথে প্রেম করবে, স্বামীর পায়ের নিচেই তার বেহেস্ত সে বিশ্বাস করে; সে সেক্স পছন্দ করে না, তবে আর্টের দরকারে যদি সেক্স করতে হয়, কাপড় খুলতে হয়, সে সেক্স করবে, কাপড় খুলবে, কেননা সবার ওপরে আর্ট, আর্টের দাবি সে পূরণ করবে, আর্টের দাবি পূরণ না করা পাপ। বালিকা অনেক কিছু জানে, এও নিশ্চয়ই জানে একটি আর্টের নাম প্রযোজক, আরেকটি আর্টের নাম পরিচালক, সে কি ওই আর্টগণের দাবিও মেটাবে? বোধ হয় এরই মাঝে মিটিয়েছে, নইলে মাধ্যমিকেই এতো উপচোচ্ছে কীভাবে? সাক্ষা কারগ্রহণকারী তার কাছে জানতে চেয়েছে তার প্রিয় উক্তি কী, সে বলছে, তার প্রিয়। উক্তি শেক্সপিয়রের ‘নো দাইসেল্ফ’ (যেমন মুদ্রিত), তার প্রিয় উপন্যাস শেক্সপিয়রের ‘ওআর অ্যান্ড পিস’ (যেমন মুদ্রিত), বালিকা ইংরেজি সাহিত্য ছাড়া সম্ভবত আর কোনো সাহিত্য পড়ে নি। সে বলছে সত্যজিৎ তার কাছে গডের মতো, গডের থেকেও বড়ো, ইচ্ছে হয় তার কাছে গিয়ে বলে, আমার সব কিছু আপনি নিন, কিন্তু বালিকা পথের পাঁচালীর লেখকের নাম মনে করতে পারছে না, তার মনে হচ্ছে ওই স্টোরিটা রবীন্দ্রনাথ ল্যাখছে, রবীন্দ্রনাথ খুব ভালো স্টোরি লিখতে পারতেন। আক্কাস আলি শক্ত দাঁত দিয়ে। মটরের মতো চিবোচ্ছেন বাঙলা শব্দগুলো, বালিকাটিকেও চিবোচ্ছেন মনে হচ্ছে, বলছেন বাঙলার বালিকাদের হতে হবে এ-রূপসী লাস্যময়ী বালিকার মতো, তার মতো রূপে ঝলসে দিতে হবে আকাশমাটি, তার পথেই এগিয়ে যেতে হবে বালিকাদের, জয়। করতে হবে সব রকমের পর্দা, এখন একটি রাজ্যই জয় করার উপযুক্ত, সেটি হচ্ছে পর্দা, সেটি জয় করতে হবে, জয় করতে হবে সকলের স্বপ্ন। বাঙলাদেশ তাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে;–আক্কাস আলি সম্ভবত বালিকাদের অন্য কোনো অঙ্গের কথা বলতে চাইছিলেন, এ-বালিকার একটি অঙ্গের ওপর বেড়ালের মতো আক্কাস আলির চোখ। পড়ে আছে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্মের দেশে বলতে পারছেন না, প্রকাশ্যে এখানে মুখের দিকেই তাকাতে হয়, গোপনে অন্যান্য অঙ্গের দিকে। বালিকারা অবশ্য এগিয়ে যাচ্ছে,। মডেল/হিরোইন/বাইজি জন্ম নিচ্ছে ঘরে ঘরে; জনকজননীরা কন্যা জন্ম দিয়ে আর স্থির থাকতে পারছে না, মাটিতে পুঁতে ফেলছে না, ঘরে একটা মডেল/হিরোইন/বাইজি সৃষ্টি ও নির্মাণের জন্যে দিকে দিকে ছুটছে। কয়েক দিন ধরে শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে শিল্পকলার ধুম লেগেছে, আমিরাত থেকে এক মহান আমির বাঙালি/বাঙলাদেশি শিল্পকলা খেতে এসেছেন, বোম্বাই শিল্পকলা খেতে খেতে তার অরুচি ধরে গেছে, শিল্পকলা অ্যাকাডেমি তাকে শিল্পশবরিকলা খাওয়াচ্ছে। সন্ধ্যার পর তাঁর নাচঘরে নর্তকীদের পায়ে তিনি বেঁধে দিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা, একরাতে কয়েক লাখ, টাকার থলে পায়ে বেঁধে নেচে চলছে বাঙলাদেশি শিল্পকলারা, তিনি খাচ্ছেন, আর পাগল হয়ে যাচ্ছে অ্যাকাডেমির পরিচালক, শুতে যাওয়ার পরও তিনি শিল্পকলাগণের জননীদের টেলিফোন পাচ্ছেন, কাতরভাবে জননীরা আবেদন করছে, এক রাতের জন্যে আমার মেয়েকে একটা চান্স দিন। বয়স থাকলে কন্যাদের হটিয়ে দিয়ে জননীরাই এক রাতের জন্যে একটা চান্স নিতো, তা হচ্ছে না, আমির পাকাপচা কলা খেতে পছন্দ করেন না।