জাতির গৌরব কর্তৃক শয়তানের পদতল চাটার দৃশ্য দেখা এটাই প্রথম আর শেষ নয় রাশেদের, বাঙলার গৌরবগুলো বদমাশ হতে পারে শয়তানের থেকেও; এমন আরো অনেক দেখেছে রাশেদ, তাতে তার বুক ভরে আছে, বেঁচে থাকলে আরো দেখবে, তার বুক উপচে পড়বে। রাশেদের এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে সে-চমৎকার উলুকটিকে, জাতির। বিবেক হয়ে উঠেছিলো যে, মুখ খুললেই যে গলগল করে বলতো ছাগল মানে শিং নিচু করা, সেই উলুকটির সাথে এই ভাল্লুকটিকে মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে রাশেদের; ছাগল মানে শিং নিচু না করা-তার কথাটি মনে দাগ কেটেছিলো ছাগলসম্প্রদায়ের, তারা মুখ ফাঁক করলেই জিভের তলা থেকে বেরিয়ে পড়তে ছাগল মানে শিং নিচু না করা, এবং তারা কখনো শিং নিচু করতে চাইতো না, যদিও কখনো খুঁজে দেখতো না। তাদের মস্তকে আদৌ কোনো শিং আছে কিনা। উলুকটি তখন বিবেক হয়ে ওঠে নি, একবার তাকে দেখতে গিয়েছিলো রাশেদ, গিয়ে দেখতে পেয়েছিলো একটা অন্ধকার ঘরে পরিত্যক্ত পশুর মতো পড়ে আছে, বেশি দিন বাঁচবে না, রাশেদকে দেখে সে খুব খুশি হয়েছিলো, অনেক দিন কেউ তার খোঁজ করে নি, কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে। কাঁদছিলো সে। কিছু দিন পরেই সে বিবেক হিশেবে দেখা দিতে থাকে। বাঙালি একটি বিবেক পেয়ে ধন্য বোধ করে, অনেক বছর দেশ থেকে যাত্রা উঠে গেছে বলে বিবেক সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিলো না ছাগলসম্প্রদায়ের, কিন্তু এ যখন চিৎকার করে। ওঠে ছাগল মানে শিং নিচু না করা, তখন তারা আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। পরাধীন। বাঙালি একদিন স্বাধীন হয়, কী বিস্ময়!-আর ওই বিবেকটির চাঞ্চল্যকর বিকাশ ঘটতে থাকে, বিবেকের কথা বলতে বলতে সে ছাগলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বড়ো বড়ো পদের ওপর বসতে থাকে, এবং অভ্যাসবশত পথেঘাটে ডেকে যেতে থাকে তার শেষ। কথা-ছাগল মানে শিং নিচু না করা। রাশেদ তার বিকাশ দেখে শিং নিচু না করে মাথা নত করেছে মনে মনে, তবে একটা সন্দেহ তার কাটে নি। রাশেদ ছেলেবেলায় বিবেকের লেখা একটা বাজে বই পড়েছিলো, জিন্নাকে নিয়ে লেখা বই, সে অবশ্য জিন্না বলে নি, বলেছে কায়েদে আজম, যাতে জিন্নার প্রতি ভক্তিতে সে ছিলো গদগদ, জিন্না তার কাছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ, আর পাকিস্থান এক মহান দেশ, যার জন্যে সে জান কোরবান। করতে ছিলো প্রস্তুত। কয়েক বছরের মধ্যেই জাতির বিবেকটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে বিবেকের ভারে, শিং উঁচু রাখতে ভুলে যায়, তার শিং খসে পড়ে; দেশে একটি একনায়ক বালক দেখা দিলে বালকটির পায়ে বিবেকটি মাথা রেখে জীবনকে সফল করে তোলে। বিবেক বাঁদর হয়ে ওঠে একনায়কের, বাঁদরামো করতে থাকে সমস্ত চৌরাস্তায়, শরীর ফুলে উঠতে থাকে, ছাগল মানে শিং নিচু না করার কথা তার আর মনে থাকে না। একনায়ক বালকটি একদিন লাথি মেরে ফেলে দেয় তাকে, সেই শোকে বিবেক মারা যায়, নিশ্চয়ই সে যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে ফিরে গেছে। এখন দেখা দিয়েছে ভাল্লুকটি, ভাল্লুক যেখানে গৌরব সেখানে উদ্দিন মোহাম্মদ দেখা দেবেই। রাশেদ খোঁচা দিয়ে বাক্সটি বন্ধ করে দেয়।
ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের গ্রাম উপচে পড়ছে সর্বজনপ্রিয় ও সর্বজনশ্রদ্ধেয়তে, রাশেদ তুমি কখনো তা হতে পারবে না, রাশেদ পরিহাস করছে নিজেকে, তুমি যা। করছে তাতে জীবনটা তোমার শেয়ালের খাদ্য হবে, মরার পর শেয়ালও খাবে না, এবং ভাবছে সর্বজনপ্রিয়শ্রদ্ধেয় রজ্জব আলির কথা, রজ্জব আলিকে খুব শ্রদ্ধা করে রাশেদ, কে তাকে শ্রদ্ধা করে না? রজ্জব আলিও প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতির গৌরব হয়ে ওঠার, বঙ্গোপসাগরে গ্রামটা ডুবে না গেলে একদিনই হয়ে উঠবেই, ৩৫ বছর ৫ মাসেই সে সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছে, যেমন পাণ্ডিত্য তেমনি তার চরিত্র তেমনি তার পাঞ্জাবি, শহিদ মিনারে তাকে পাওয়া যাচ্ছে সকালবিকেল, শুধু সন্ধ্যার পর পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ বলতে পারে না সন্ধ্যা হলে কোথায় যায়। রজ্জব আলির কোনো দুর্নাম হয় না, ভূমণ্ডলের একক রাজহংস রজ্জব আলি, কাদায় সন্ধ্যাভর ডুবসাঁতার কাটার পরও তার পালকগুলো শুভ্র থাকে। কিছু দিন আগে উদ্দিন মোহাম্মদের প্রতিনিধি হয়ে পশ্চিমে ঘুরে এসেছে, এসেই শহিদ মিনারে গেছে, সবাই তাকে পেয়ে ধন্য হয়েছে। সে যে খুব বিদ্রোহী রাশেদ তাতে কোনো সন্দেহ পোষে না, কিছু দিন আগেই তার বিদ্রোহের একটা জ্বলন্ত উদাহরণ দেখতে পেয়েছে জাতি। উদ্দিন মোহাম্মদ আরো দশটা সর্বজনশ্রদ্ধেয়র সাথে তাকে একটা পদক দিয়েছে, পদকের ঘোষণা শুনেই সর্বজনশ্রদ্ধেয়দের পেছনের অস্থি বেঁকে গেছে, বাঁকে নি শুধু রজ্জব আলির। উদ্দিন মোহাম্মদ পদক বিলোনোর জন্যে আয়োজন করেছে জাতীয় অনুষ্ঠানের, তারারা আড়ম্বর অত্যন্ত ভালোবাসে, দিকে দিকে সাড়া পড়ে গেছে, অন্যান্য উজবুকগুলো তাদের শ্রেষ্ঠ পাঞ্জাবি স্যুট আচকান পরে গিয়ে উঠেছে সেখানে, রজ্জব আলি যায় নি, উদ্দিন মোহাম্মদের হাত থেকে সে পদক নিতে পারে না, সে বিদ্রোহ করেছে, সে পদক নেয়ার জন্যে পাঠিয়েছে তার সহধর্মিণীকে। রজ্জব আলি পদকমন্ত্রীকে জানিয়েছে সে অসুস্থ বলে উপস্থিত থাকতে পারছে না, এটা রজ্জব আলির এক মারাত্মক বিদ্রোহ, সে বিদ্রোহ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, সে উদ্দিন মোহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না, তার মেরুদণ্ড বেঁকে গেলেও ভাঙবে না। সহধর্মিণীটিকে সে পাঠিয়েছে, সহধর্মিণীর আবার সম্মান কী, সম্মান বিসর্জন দেয়ার পরই তো মেয়েলোক সহধর্মিণীর মর্যাদা পায়, তাকে যেখানে ইচ্ছে পাঠানো যায়, উদ্দিন মোহাম্মদের কাছেও পাঠানো যায়, সহধর্মিণীর ধর্মই হচ্ছে নিজেকে অপমানিত করে পরমগুরুর গৌরব বাড়ানো। রাশেদ আবার টেলিভিশনটা খোলে, আরো দু-একটি। উলুকভাল্লুক দেখতে ইচ্ছে করছে আজ সন্ধ্যায়, সে একটা ভড়কে দেখতে পায়, এটা এখন বাজারের শ্রেষ্ঠ ভাঁড়, অন্যান্য ভাঁড়রা হার মেনে আত্মহত্যার কথা ভাবছে, সে গান গেয়ে চলছে উদ্দিন মোহাম্মদের। দু-দিন পর একটা হরতাল ডাকা হয়েছে, ঘন ঘন হরতাল হচ্ছে আজকাল, সে ভার নিয়েছে হরতাল থামানোর, একপাল মেয়েকে নিয়ে সে নাচছে, নেচে নেচে দেখাচ্ছে হরতাল হ’লে রিকশাঅলার কতো কষ্ট, ভিখিরির কতত। কষ্ট, গরিবের কতো কষ্ট, কষ্টে তার বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে, আর দশটা কম্পিউটার চিৎকাৎ করে দেখাচ্ছে হরতালে দেশের একদিনের ক্ষতি ৮৬৯৮৭৬৮৯৭৬৫৪৩২৫৬৭৮ কোটি টাকা। ভাঁড়টা চার বছর আগে বন্দনা গাইতে আরেকটি একনায়কের, তখনো ছিলো সে ভাড়োত্তম, একনায়কটি নিয়তির দিকে এগিয়ে গেলে, একনায়কটির একটা। ছেঁড়া ময়লা আন্ডারওঅ্যার নিয়ে সে হাজির হয় টেলিভিশনে, আন্ডারওঅ্যার জড়িয়ে ধরে বুকে নিয়ে মুখে বুলিয়ে চুমো খেয়ে একঘণ্টা ধরে কাঁদে, আরো ঘণ্টাতিনেক সময় তার। কান্নার জন্যে বরাদ্দ ছিলো, কিন্তু এক ঘণ্টায়ই সে শহরের সব গ্লিসারিনের বোতল। নিঃশেষ করে ফেলে, তাই এক ঘণ্টায়ই অনুষ্ঠান শেষ করতে বাধ্য হয়। তার কান্না দেখে দেশজুড়ে দর্শকরা হেসে লুটিয়ে পড়েছিলো, দেশবাসীর হাসার শব্দ উঠছিলো দিগদিগন্ত থেকে, চট্টগ্রামের হাস্যরোল দিনাজপুরের যশোরের অট্টরোল সিলেটে বিক্রমপুরের হাস্যলহরী চুয়াডাঙ্গায় শোনা গিয়েছিলো। এর আগে সে এতো এবং এমন লোক হাসাতে পারে নি, সে-দিনই সে জাতিকে উপহার দিয়েছিলো তার সর্বোত্তম ভাঁড়ামো, জনগণ তাকে ভাড়োত্তম উপাধি দিয়েছিলো, এবং জনগণের অনুরোধে তার সে-কৌতুকানুষ্ঠান দেখানো হয়েছিলো ছ-মাস ধরে। রাশেদ ভাঁড়টিকে দেখে মজা। পাচ্ছে, একই সন্ধ্যায় একটি ভাল্লুক ও একটি ভাড়োত্তম দেখে বুকে তার খুব উল্লাস হচ্ছে।