রাশেদ বুঝতে পারছে না তার কেমন লাগছে, বালিকাটিকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হচ্ছে না, জিজ্ঞেস করাটাকে তার মনে হচ্ছে নিষ্ঠুরতা, সবচেয়ে ভালো সম্পূর্ণ ভুলে। যাওয়া যে তারা অরণ্য দেখতে এসেছিলো, দোজখ থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলো। তাদের কি কেউ নিমন্ত্রণ করছে, যতো দূরেই তারা যাক তার জালটি সে ছড়িয়ে দিচ্ছে, ধরে ফেলছে পুঁটিমাছের মতো কিছুতেই তারা দূরে যেতে পারবে না। তাদের সামনে একটা বাসযাত্রা পড়ে আছে, ওই বাসে যে দু-একটা বাঘ বা পুরো বাসটাই বাঘ হয়ে লাফিয়ে পড়বে না তাদের ওপর, তা কেউ জানে না। তাদের মুখে কোনো সবুজ লাগে। নি, চোখে কোনো সবুজ লাগে নি, বুকে কোনো সবুজ লাগে নি, আরো অনেকখানি ময়লা লেগেছে। বালিকা খুব অপরাধী বোধ করছে, বলছে সে রাশেদকে দোজখ থেকে দূরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো, নদী অরণ্য দেখাতে চেয়েছিলো, কিন্তু তা সে পারে নি, নিজেকে তার অপরাধী মনে হচ্ছে। একটা বাস এলে তারা উঠে বসে, চারদিকে তার তাকাতে সাহস হচ্ছে না, হয়তো বাঘ ভাল্লুক নেকড়ে দেখতে পাবে। বালিকাটিকে এখন ধর্ষিতাই মনে হচ্ছে, সে মুখ নিচু করে বসে আছে, তার কোনো কিছু দেখতে ইচ্ছে। করছে না, যেনো তার বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ থেকে রক্ত ঝরছে, তার মুখে পশুর নখের গভীর ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। রাশেদ দেখছে লোকদুটি বালিকাটিকে ছিনিয়ে নিয়েছে, সে আহত হয়ে পড়ে আছে, একটা ময়লা ট্রাউজার আর একটা কাস্তে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে চলছে বালিকাটিকে, বালিকাটি চিৎকার করতে পারছে না, বালিকা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। রাশেদ বালিকার দিকে তাকায়, তার মুখ থেকে রক্ত ঝরছে, মন থেকে রক্ত ঝরছে, স্বপ্ন থেকে রক্ত ঝরছে, রাশেদ ভেসে যাচ্ছে, বাস ভেসে যাচ্ছে, পথের দু-পাশ ভেসে যাচ্ছে, দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত মাটি ভেসে যাচ্ছে। রক্তের ওপর দিয়ে ছুটে চলছে অন্ধ বাসটি।
ভাল্লুক উল্লুক রজ্জব আলি আক্কাস আলি
একটা ভাল্লুক, আবর্জনার বাক্স খুলেই দেখতে পেলো রাশেদ, পদধুলি নিতে এসেছে উদ্দিন মোহাম্মদের; ভাল্লুকটি কিছু দেখতে পায় কিনা বোঝা যাচ্ছে না, তবে উদ্দিন মোহাম্মদের সুবর্ণপদতল যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছানিপড়া চোখে বোঝা যাচ্ছে, শক্তিশালী পদতল দেখতে সে ভুল করে না বলেই মনে হচ্ছে, ভাল্লুকটি পদতলই দেখতে চায়, যেমন ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইলের পল্লী জুড়ে অসংখ্য উলুক ভাল্লুক বেবুন বাঁদর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটপদ্মের দিকে। ভাল্লুকটি দোয়া করতে এসেছে উদ্দিনকে, তার দোয়া ছাড়া সম্ভবত উদ্দিনের চলছে না, ভাল্লুকটি বারবার জড়িয়ে ধরতে চাইছে উদ্দিন মোহাম্মদকে, একবার কেঁপে কেঁপে উঠে জড়িয়ে ধরেই। ফেললো, ধরতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো, উদ্দিন মোহাম্মদ জড়িয়ে ধরে একটা বিপজ্জনক দুর্ঘটনার হাত থেকে তাকে রক্ষা করে, উদ্দিন মোহাম্মদের বাহুর মধ্যে সে খুব শান্তি পাচ্ছে, পায়ে পড়লে আরো শান্তি পেতো, আল্লার কাছে কামনা করছে সে উদ্দিনের দীর্ঘ জীবন, বলছে উদ্দিন মোহাম্মদের মতো মহান রাষ্ট্রপতি পেয়ে ধন্য হয়েছে দেশ, সে শত শত বছর বেঁচে আছে শুধু উদ্দিন মোহাম্মদের মতো মহান নরপতিকে দেখার জন্যে। উদ্দিন মোহাম্মদ যে ভাল্লুকটির থেকে উৎকৃষ্ট, তাতে সন্দেহ নেই। ভাল্লুকটি অর্জন করেছে এক বড়ো কৃতিত্ব, সে ৫০৫ বছর ধরে বেঁচে আছে, হয়তো আরো ৫০৫ বছর বাঁচবে, তারপরও হয়তো ৫০৫ বছর বাঁচবে; যেখানে শিশুরা জন্মেই মরে যায়, মরাই যেখানে স্বাভাবিকতা, যুবকেরা যেখানে যৌবন পেরোতে পারছে না, সেখানে ৫০৫ বছর বাঁচা বিভীষিকাপূর্ণ কৃতিত্ব, সকলের বয়স খেয়ে সে বেঁচে আছে; এ-কৃতিত্বের জন্যে। দেশ পাগল হয়ে আছে ভাল্লুকটিকে নিয়ে। আগে ভাল্লুকটি দাবি করতো তার বয়স ৫১০ বছর, বাবর আর আকবরকে ন্যাংটো দেখেছে, বখতিয়ার খিলজিকে অল্পের জন্যে দেখে নি, সেজন্যে তার বুকে অনেক কষ্ট, দেখতে পেলে খিলজির ঘোড়ার জন্যে ঘাস নিয়ে হাজির হতো, চণ্ডীদাস তাকে পদাবলি গেয়ে শোনাতো; কয়েক বছর আগে এক মেধাবী সেবক তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে ৫১০ বছর বাঁচা কোনো কৃতিত্ব নয়, কৃতিত্ব হচ্ছে ৫০০ বছর বাঁচা, ৫০০ বছর বাচলে আয়োজন করা যায় হীরকোত্তম জয়ন্তী; তখন সে। ঘোষণা করে তার পিতার স্বহস্তলিখিত আদিঠিকুজিটি তার হাতে এসেছে, তার সূর্য চন্দ্র গ্রহগুলো নির্ভুলভাবে যোগ করে দেখা যাচ্ছে তার বয়স ৫০০ বছর। তখন সমগ্র জাতির মধ্যে সাড়া পড়ে যায়, তার হীরকোত্তম জয়ন্তী পালনের জন্যে পাগল হয়ে ওঠে বাঙালি অর্থাৎ মুসলমান বাঙালি, সে-পাগলামো আজো কমে নি। সে জাতির মহত্তম। ভাল্লুক, তাকে নিয়ে জাতির গৌরবের অন্ত নেই। জাতিটি শুধু সংবাদ নিয়ে দেখছে না ৫০০ বছর ধরে সে কী করেছে, কী করেছে তার প্রিয় রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সময়, জিন্না যখন বলেছিলো উর্দু আর উর্দুই হবে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা, তখন ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছিলো, আর ভাল্লুকটি তিরস্কার করেছিলো ছাত্রদের, বলেছিলো কায়েদে আজমের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হবে, ছাত্ররা বেয়াদব। ভাগ্য ভালো, তার জাতির মাথার সে-অংশটি অসুস্থ, যার কাজ তথ্য ধারণ করে রাখা। সে-ভাল্লুকটি পদধুলি নিতে এসেছে উদ্দিন মোহাম্মদের, ৫০০ বছর ধরে যে-আবর্জনা সে জড়ো করেছে, তার। একটি স্কুপ উপহার হিশেবে নিয়ে এসেছে উদ্দিন মোহাম্মদের জন্যে; উদ্দিন মোহাম্মদও ধন্য হ’তে জানে, সে উপহার পেয়ে ধন্য হচ্ছে এমন একটি অভিনয় করছে, ওই উপহারের বিনিময়ে উদ্দিন মোহাম্মদ ভাল্লুকটি কয়েক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। পদতলে চুমো খেয়ে মুদ্রা অর্জনের জন্যেই ভাল্লুকটি এসেছে বুঝতে পারছে রাশেদ। রাশেদের ঘেন্না লাগছে, না তার ঘেন্না লাগছে না, তার খুব ভালো লাগছে, এসব দেখতে দেখতে তার অনুভূতিপুঞ্জ সাভারের মোষের ঘাড়ের মতো হয়ে গেছে; ঘেন্না লাগছে না, তার বমি পাচ্ছে। সে কি আবর্জনার বাক্সটিকে উপহার দেবে তার হলদে বমিটুকু? তার। জাতির গৌরব পদতল চাটছে উদ্দিন মোহাম্মদের, পদতল চাটার দৃশ্য ঘুরে ফিরে দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে, রাশেদের মনে হচ্ছে সে নিজেই পদতল চাটছে উদ্দিন মোহাম্মদের।