আরেকজন এগিয়ে আসছে, উর্দি দেখে মনে হচ্ছে অরণ্য দেখাশোনার ভার তারই ওপর, চমৎকার সালামও দিতে শিখেছে লোকটি, সালামেই বোঝা যাচ্ছে তার সেবা। পাওয়া যাবে প্রভূতপরিমাণে। আল্লা/ঈশ্বরবুদ্ধ/জেসাসলাত/মানত/উজ্জা/রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ, রাশেদকে সে উদ্ধার করে হুইস্কির গ্রাস থেকে, অরণ্যটা যে বদমাশে ভরে গেছে তার একটা চাঞ্চল্যকর বিবরণ সে দেয়; গতকাল যে-খুনোখুনিটা হয়ে গেছে, তার কাহিনীও শাহেরজাদির দক্ষতায় বর্ণনা করে। বন্ধুর বউকে নিয়ে এক সাব এসেছিলেন, চারটা গারমেন্টস আছে, হাজার টাকা বকশিশ দেন, উঠেছিলেন দূরের কুটিরটিতে, ওই কুটিরটিই তিনি পছন্দ করেন, এবং ঘন্টা দুই পর পিস্তল নিয়ে বন্ধু তার বউকে উদ্ধার করতে আসেন। দরোজা ভেঙে দুজনকে ন্যাংটো ধরে ফেলেন, গোলাগুলি শুরু হয়ে। যায়। সে নিজে বদমাশ নয়, সাধু, সরকার তাকে অরণ্য পাহারার ভার দিয়েছে, কুটিরগুলো সে দেখাশোনা করে, এবং সাবদের। রাশেদ বুঝতে পারে তার নিপুণ কাহিনীবর্ণনা ও দ্রতার পেছনে কী আছে, একটু পরেই সে জানতে চায় রাশেদদের কুটির লাগবে কিনা। ভালো একটা কুটিরের সে ব্যবস্থা করে দেবে, কোনো ভয় নেই, বদমাশরা ধারেকাছে ঘেষতে পারবে না, ইচ্ছে করলে দু-তিন ঘণ্টা দরোজা বন্ধ করে বিশ্রাম করতে পারবে। বিশ্রাম এবং করা। না, তারা বিশ্রাম এবং করতে আসে নি, শালগাছ দেখতে এসেছে, শালগাছের পাতায় তুচ্ছ সোনা দেখতে এসেছে। লোকটির গোপন একটি কথাও আছে রাশেদের সাথে, রাশেদকে সে ডেকে একটু দূরে নিয়ে যায়, বালিকার সামনে কথাটি বলতে চায় না, রাশেদের রাজা লাগবে কিনা খুব অন্তরঙ্গভাবে জিজ্ঞেস করে; কুটির নিলে রাজাও সে সরবরাহ করবে, কোনো অসুবিধা হবে না। রাশেদ কি তাকে বলবে ব্যাগ ভরে সে রাজা নিয়ে এসেছে, যতোটুকু সময় আছে তারা একের পর এক রাজা পরতে ও খুলতে থাকবে। লোকটিকে একটি চড় দিতে পারলে বেশ হতো, কিন্তু এটা চড় দেয়ার জায়গা নয়। রাশেদ লোকটিকে একটু বিব্রত করতে চায়, বলে একটা কুটির তার দরকার, তবে যে-কোনোটি নয়, বড়ো কুটিরটি, যেটা দেখে সত্যিই তার পছন্দ হয়েছে। লোকটি ব্ৰিত হয়, ওটা ভারি গুরুত্বপূর্ণদের জন্যে, বড়োসাবরা এলে ওখানে ওঠেন, আগেই খবর দিয়ে আসেন; তাছাড়া ওটা এখন ব্যস্ত, এক বড়োসাব এক নায়িকাকে নিয়ে উঠেছেন ওটিতে, ওটির ধারেকাছেও ঘেষা নিষেধ। রাশেদ বড়োসাব নয়, বালিকাটিও নায়িকা নয়, বড়োসাব না হওয়ার জন্যে যে কতো কিছু হারাতে হচ্ছে তাকে! লোকটিকে সম্পূর্ণ অসন্তুষ্ট করে কি শালগাছ দেখা যাবে, লোকটির ইশারায় শালগাছ থেকে কি বাঘ নেমে আসবে না? রাশেদ তাকে বিশ টাকার একটি নোট দেয়ে একটি কাজের ভার দেয়; একটু দেখেশুনে রাখতে হবে তাদের, তারা শালগাছ দেখবে, একটু হাঁটবে, তখন যেনো তাদের ওপর বাঘভাল্লুক লাফিয়ে পড়ে।
প্রতিটি ঝোঁপই সুন্দর, দূর থেকে, মনে হচ্ছে সামনের ওই ঝোঁপটির ভেতরে গেলেই গাছের পাতা থেকে গায়ে লাগবে সবুজ রঙ, পত্রপত্রালির অমল সবুজ, নিশ্বাস নিতে সুখ লাগবে, কাছে গেলে আর তেমন লাগছে না, সবুজকে ময়লাধরা মনে হচ্ছে; বালিকা। এক ঝোঁপ পেরিয়ে আরেক ঝোপে যাচ্ছে, কথা বলছে, গাছের মতো সবুজ হয়ে উঠছে, কিন্তু রাশেদের অস্বস্তি কাটছে না, প্রতিটি গাছ পাহারা দিচ্ছে তাকে, ভয় পাচ্ছে -কোনো সময় গাছগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের ওপর। দূরের ঝাউগাছটিকে দেখাচ্ছে অনেকটা মমতাজের মতো, চুপচাপ রাশেদ ও বালিকাটিকে দেখছে, কাছে গেলেই অনেকগুলো বিরক্তিকর প্রশ্ন করবে, রাশেদ উত্তর দিতে পারবে না, অনেকগুলো দিনরাত মুমূর্ষ হয়ে উঠবে। এ-ঝোঁপটি বেশ নিবিড়, কাছেই হদে গাছের ছাড়া সবুজ ঘন গম্ভীর হয়ে আছে, মনে হচ্ছে জলের ভেতরে একটা অরণ্য আছে, বালিকা বসতে চাইছে, রাশেদেরও ইচ্ছে করছে বসতে; অনেক বছর এমন ছায়ায় সে বসে নি, যতো দিন বাঁচবে হয়তো বসতে পারবে না। বালিকা ও রাশেদ ঘাসের ওপরে বসে পরস্পরের দিকে। তাকায়, যেনো অনেক বছর পর এইমাত্র দেখা হলো, কুশলবিনিময় করা হয় নি এখনো; এখন জিজ্ঞেস করতে হবে, কেমন আছো? তখন চিৎকার করে দু-দিক থেকে দুটি। লোক তাদের ঘিরে ফেলে, হঠাৎ চিৎকার শুনে রাশেদ ও বালিকা লাফিয়ে ওঠে। লোক দুটি তাদের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে, লুঙ্গিপরা লোকটির হাতে একটি কাস্তে, চোখ জ্বলজ্বল করছে তাদের, এখনি আক্রমণ করবে মনে হচ্ছে; তারা চিৎকার করে বলছে, হারামির বাচ্চারা জঙ্গলে আইয়া কুকাম করতাছ, তোমাগ দ্যাখাইয়া দিমু। কী কুকাম করছে তারা? করলে এদের কী? কুকাম করতে চাইলে তারা একটা কুটির ভাড়া নিয়েই তো। করতে পারতো। নরক তাহলে রাশেদকে ছাড়ে নি, সে শহর ছেড়ে নদীতে যেতে পারে, কিন্তু নরক ছেড়ে যেতে পারে না; সে শহর ছেড়ে অরণ্যে যেতে পারে, কিন্তু নরক ছেড়ে যেতে পারে না। রাশেদ কি চিষ্কার করবে? কোনো লাভ হবে তাতে? তর্ক করবে এদের সঙ্গে কোনো উপকার হবে তাতে? মারামারি করবে? সেটা খুবই খারাপ হবে। তারা যেহেতু এখনো আক্রমণ করে নি, সম্ভবত আর আক্রমণ করবে না, তারা শান্তিপূর্ণভাবেই কিছু চায় বলে মনে হচ্ছে। একটা পরিস্থিতি তৈরি করে কিছু খসাতে চায়, তোক দুটি কুকামের কথাটাই বলছে বারবার, এটাই হয়তো সবচেয়ে মারাত্মক যুক্তি, জঙ্গলে এসে একটি পুরুষ আর একটি বালিকা কুকাম ছাড়া কী আর করতে। পারে?-কিন্তু রাশেদ কিছুই খসতে দেবে না, তবে সাবধান হতে হবে। একটা লোক একটু বেশিই চাঁচাচ্ছে, সুনীতির জন্যে তার দরদ একটু বেশিই, লোকটিকে একটা। লাথি মারতে পারলে শান্তি পাওয়া যেতো; রাশেদ বালিকার দিকে তাকায়, বালিকা ভয় পায় নি দেখে স্বস্তি পায়। সে বালিকার হাত ধরে ঝোঁপ থেকে বেরোনোর জন্যে পা। বাড়ায়, সুনীতি-মিয়া তা অনুমোদন করে না, পথ আটকে দাঁড়ায়, তাদের বেরোতে দেবে না ঝোঁপ থেকে। কাস্তে-মিয়ার হাতে বেশি সময় নেই, ঘাস কাটা রেখে হয়তো। সুনীতি-মিয়ার ডাকে উঠে এসেছে; সে কয়েক শো টাকা দাবি করে, ওই টাকাটা দিলে কোনো ঝামেলা হবে না। টাকা যখন ব্যাপার তখন নিশ্চয়ই বেশি জটিলতা নেই, এখন আর আক্রমণ করবে না, বালিকাটিকে ধর্ষণ করতে চাইবে না। কিন্তু রাশেদ কেনো তাদের টাকা দেবে? টাকা দেয়ার অর্থ কি এ নয় যে তারা কুকাম করছিলো, কুকাম করার সময় মৌলভিসাবদের হাতে ধরা পড়ে গেছে, তার দণ্ড হিশেবে টাকাটা দিচ্ছে? এদের সাথে সততা করবে রাশেদ, না, প্রতারণা করার একটা উদ্যোগ নেবে? রাশেদ। একবার তাকিয়ে দেখলো ঝোঁপ পেরিয়ে কাউকে দেখা যায় কিনা, দূরে কয়েকটি লোকের মাথা দেখা যাচ্ছে, ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে হ্রদের পাড়ের পথটিতে নামতে পারলেই তাদের ডাকা যায়। রাশেদ পাছপকেটি হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করার চেষ্টা করতে থাকে, তোক দুটিকে বেশ প্রস্তুত মনে হচ্ছে, ব্যাগটা বেরোলেই লাফিয়ে পড়বে, তবে ব্যাগটা বেরোচ্ছে না, রাশেদ ব্যাগটা এতো শিগগির বের করবে না; রাশেদ। সুনীতি-মিয়াকে বললো যে ঝোঁপের বাইরে গিয়েই সে টাকাটা দেবে। বালিকাকে বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে মানিব্যাগ বের করার চেষ্টা করতে করতে রাশেদ রাস্তায় এলো, সুনীতি-মিয়া তার সাথে সাথে আসছে, কাস্তে-মিয়া দাঁড়িয়ে আছে ঝোঁপের ভেতরে, আজ তাকে আর ছাগলের জন্যে ঘাস কাটতে হবে না। দূরে কয়েকটি লোক দেখা যাচ্ছে, রাশেদ হঠাৎ সুনীতি-মিয়ার মুখে একটা ঘুষি মারলো, জীবনে এটাই তার প্রথম ঘুষি, সে নিজেও ভাবে নি ঘুষিটা এতো শক্ত হবে, সুনীতি-মিয়া উল্টে পড়ে গেলো। রাশেদ চিৎকার করলো না, লোক জড়ো করার দরকার নেই, চিৎকার শুনে যারা ছুটে আসবে তারাও অন্য ধরনের মিয়া হবে। সুনীতি-মিয়া মাটিতে পড়ে গেছে, উঠতে সময় লাগবে, উঠে আর তাদের দিকে আসবে বলে মনে হচ্ছে না, কাস্তে-মিয়া নিশ্চয়ই ঘাস। কাটতে চলে গেছে; রাশেদ আর বালিকা একটু তাড়াতাড়ি, দৌড়ে নয় হেঁটে, গল্প করার চেষ্টা করতে করতে, বড়ো কুটিরটির দিকে এগোতে লাগলো। একটু আসতেই দেখা। হলো সে-লোকটির সাথে, যে রাশেদকে একটা কুটির দেয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা। করেছিলো; সে জানতে চাইলো কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা; রাশেদ বললো, না।