দূরে যেতে হলে একটা ইস্কুটার নিতে হবে, রাশেদ হাত নেড়ে একটা ইস্কুটার ডাকে, ইস্কুটারঅলা এসেই জানতে চায় তারা কোথায় যাবে। রাশেদ জানে না কোথায়। যাবে, শুধু জানে দূরে যাবে; ইস্কুটারঅলাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গার নাম বলতে হবে, কিন্তু রাশেদ কোনো নির্দিষ্ট নাম জানে না। রাশেদ বালিকার দিকে তাকায়; বালিকা বলে, আমরা নদী দেখতে যাবো। ইস্কুটারঅলা মিষ্টি করে হাসে, নদীর ঠিকানায় যাওয়ার জন্যে তার ইস্কুটারে এখন পর্যন্ত কেউ ওঠে নি বলেই মনে হয়, তার হাসিটা খুব নোংরা লাগছে না, তবে হাসিটা এক সময় শুয়োরের হাসি হয়ে উঠবে না তো? সে বলে টঙ্গি গেলে একটি নদী পাওয়া যাবে, নদীটা পুলের নিচ দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে, তার নাম তুরাগ, নদী দেখতে ইচ্ছে হলে তারা সেখানে যেতে পারে। রাশেদ আর বালিকা নদীর স্বপ্ন দেখেছে, তবে তার বাস্তবকে কোথায় পাওয়া যাবে তা জানে না, ইস্কুটারঅলা জানে; কিন্তু সত্যিই কি এ-নামে কোনো নদী আছে? তারা ইস্কুটারে উঠে বসে। তুরাগের পারে এসে তারা নদী খোঁজে, কোনো নদী খুঁজে পায় না; ঘাটের মাঝিরা তাদের ঘিরে ধরে, বলতে থাকে এটাই তুরাগ নদী, ডাকতে থাকে নৌকোয়। ওঠার জন্যে, নৌকো করে তারা রাশেদ ও বালিকাকে নদী দেখিয়ে আনবে। ঘাটে বড়ো ধরনের একটা ভিড় জমে গেছে, তাদের কি বড়ো বেশি অচেনা লাগছে এই সব। মানুষদের; তাদের দেখে কি বিস্মিত হচ্ছে মাঝিরা, নাকি তাদের ছিঁড়ে খাওয়ার স্বপ্ন দেখছে? বালিকার দিকে মাঝিদের চোখ পড়ে থাকছে, মনে হচ্ছে শাড়ি খুলে তারা। দেখছে বালিকাকে, মরিচ দিয়ে পান্তাভাতের মতো তাকে খাচ্ছে, এবং রাশেদের বুকে ছুরি ঢুকিয়ে তুরাগ নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। হয়তো তারা এমন কিছুই ভাবছে না, ভাবছে তাদের বেড়াতে নিতে পারলে বেশ টাকা পাবে। রাশেদ ও বালিকা বুড়ো মাঝিটির নৌকোয় ওঠে, মাঝিটিকে বুড়োই মনে হয়, চুল পেকে এসেছে, খুব রোগা; বালিকা এবং রাশেদ দুজনেই তাকে পছন্দ করে। তারা দুজনেই এ-রোগা মাঝিটিকে পছন্দ। করলো কেনো? ডাকাতের মতো সবল কয়েকটি মাঝি তো তাদের নেয়ার জন্যে কম দামও বলছিলো, কিন্তু তারা একে পছন্দ করলো কেননা? রাশেদ ও বালিকা কি একেই নির্ভরযোগ্য মনে করেছে, এর থেকে ভয়ের সম্ভাবনা কম বলে? গলুইর দিকে দাঁড়িয়ে তারা নদী দেখছে, হাত দিয়ে পানি ছুঁয়ে দেখছে, বালিকার শাড়ির পাড় উড়ে এসে রাশেদের মুখের ওপর পড়ছে, দূরে সারিসারি তালগাছ দেখা যাচ্ছে, বালিকা তার। মুঠোতে রাশেদের বাঁ হাতটি তুলে নিচ্ছে। রাশেদের মনে হচ্ছে সে অনেক দূরে এসেছে, এতো দূরে বহু বছর সে আসে নি। মাঝিটি এমন সময় ডাকে রাশেদকে, তারা দুজনই, মাঝির দিকে তাকায়। মাঝিটি বলে, খাড়ইয়া খাড়ইয়া পানি দেইখ্যা কি অইব, ঝাঁপ লাগাইয়া দুইজনে হুইয়া আনন্দ করেন, আনন্দ করনের লিগাই ত সাবরা নাও ভাড়া। নেয়। বুড়োটার মুখের দিকে তাকিয়ে রাশেদের ঘেন্না লাগে; তার মনে হয় এক নদী মলের ওপর দিয়ে চলছে নৌকোটি, এখনি ডুবে যাবে, তারা দুজন মলের ভেতরে তলিয়ে যাবে। বালিকা মাথা নিচু করে থাকে, সে পানি থেকে তার হাত তুলে নিয়েছে, দূরের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, সব কিছু বড়ো বেশি নোংরা হয়ে গেছে, এই মাঝিটি তো নোংরা না হলেও পারতো। দূরে জঙ্গলের ভেতর থেকে কয়েকটি নৌকো বেরিয়ে আসছে, নৌকোগুলো এদিকে আসতে পারে, ওখানেও থাকতে পারে, তারা এক সাথে বেরিয়ে এলো কেনো? ওই নৌকোর মাঝিরা কি দেখতে পেয়েছে তাদের, দেখেছে একটি বালিকা দাঁড়িয়ে আছে ছইয়ের সামনে, এবং এ-নৌকোটিকে ঘিরে ধরতে পারলে চমৎকার হবে? রাশেদ মাঝিকে নৌকো ফেরাতে বলে, তাদের আর মলের নদী দেখার সাধ নেই। মলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে তাদের নৌকোটি এসে ঘাটে লাগে।
এখন কোথায় যাবে বালিকা আর রাশেদ? ফিরে গিয়ে মনে মনে দেখতে থাকবে মলনদী, দেখবে মলের ভেতরে ভয়ঙ্করভাবে ডুবে যাচ্ছে তাদের নৌকো, তারা সাঁতার কাটছে মলের ভেতরে, উঠতে পারছে না, আর নিঃশব্দে চিৎকার করবে? নাকি সম্পূর্ণ শহরটাকে ভীষণভাবে ভয় পাইয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠবে? তাদের কি এখনো সাধ আছে দূরে যাওয়ার? রাশেদের নেই, সে নরকে ফিরে যেতে পারলেই স্বস্তি পাবে; কিন্তু বালিকার চোখ থেকে এখনো দূরের স্বপ্ন মুছে যায় নি। বালিকাটির পাখি হওয়া উচিত ছিলো, ছোটো কোনো পাখি, তাহলে সে উড়ে উড়ে যেতে পারতো; আরেকটি পাখিও হয়তো সে পেতো, উড়ে যেতে পারতো তার সাথে অরণ্যে নদীর পারে শাপলার বিলে। রাশেদ পাখি নয়, অন্তত দশ বছর ধরে পাখি নয়, কখনো আর পাখি হয়ে উঠবে না। বালিকা অরণ্যে যেতে চায়, কয়েক মাইল উত্তরেই অরণ্য, যেখানে শালগাছ দেখা যাবে, পাখি দেখা যাবে, ঘাসের ওপর দিয়ে লাউডগার মতো প্রবাহিত সাপও দেখা যেতে পারে। রাস্তায় আসতেই বাসগুলোর বাচ্চাগুলো উত্তেজিত হয়ে ওঠে তাদের দেখে, রাশেদ ও বালিকার চোখমুখ দেখেই বাচ্চাগুলো বুঝে ফেলেছে তাদের অরণ্যে যেতেই হবে। বালিকা আর রাশেদ একটি বাসে উঠে বসে, তাদের ওঠার সময় বাসটি তার সম্পূর্ণ ভূখণ্ড জুড়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে তাদের সম্পর্কে বিচারবিবেচনা শুরু করে। পেছনের আসনের বুড়ো লোকটি ঘুমোচ্ছিলেন, এখন তিনি চোখ মেলে বালিকা ও রাশেদকে বিশ্লেষণ করছেন; দু-আসন আগের মাস্তান, বা উত্তরের কোনো এলাকার গৌরব দুটি, যারা রাজধানিকে ধন্য করে নিজেদের সাম্রাজ্যে ফিরছেন, পকেট থেকে সোনালি বাক্সের সিগারেট বের করে দামি ধুয়োয় এদিকটা আচ্ছন্ন করে ফেলছেন। গৌরব দুটি তাদের সাথে সাথে বাস থেকে নামবে না তো? অরণ্যের পাশে এসে বালিকা আর রাশেদ বাস থেকে নামে, তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে, কাঞ্চন জ্বলছে সবুজের ভেতর, মুঠো ভরে ওই সোনা বুকে রাখতে পারলে অনেক দিন কোনো অসুখ করবে না। রাশেদের জানা ছিলো না অরণ্যে ঢুকতে হলেও টিকেট কিনতে হয়, পঞ্চাশজনের টিকেট কিনতে হয়। তারা এখন পঞ্চাশজন কোথায় পাবে? রাশেদ কি। বাসের সকলকে অনুরোধ করবে তাদের সাথে অরণ্যে দেখার জন্যে ঢুকতে? তারা কি অরণ্য দেখতে রাজি হবে? আবার সবায় যদি বালিকাটির সাথে অরণ্য দেখার জন্যে বাস থেকে নেমে আসে? রাশেদ ও বালিকা ভেতরে ঢোকে, ঢুকেই বুঝতে পারে তারা নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়েছে, বা অত্যন্ত দূষিত মানুষ তারা, পবিত্র অরণ্য নষ্ট করতে এসেছে; অরণ্যের পবিত্রতা অক্ষত রাখার জন্যে একপাল প্রহরী পাহারা দিচ্ছে তাদের। নাকি এরা অরণ্যের বাঘ, একটু ভেতরে ঢুকলেই লাফিয়ে পড়বে তাদের ওপর? বালিকা প্রায় প্রতিটি গাছের নাম জানে, রাশেদকে গাছের নাম শোনাচ্ছে মন্ত্রের মতো, নামগুলো। রাশেদের ভেতরে ঢুকছে না, সে দেখতে পাচ্ছে দূরে একটা গাছের আড়ালে একটি লোক লুকোনোর চেষ্টা করছে। রাশেদ বালিকাকে নিয়ে ডান দিকের পথটিতে ওঠে, লোকটি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে তাদের দিকে আসতে থাকে; রাশেদ একটা প্রস্তুতি নেয় মনে মনে, লোকটিকে অবশ্য হিংস্র মনে হচ্ছে না, বিনীতভাবেই সে রাশেদের সামনে। এসে দাঁড়ায়। লোকটির দেশিবিদেশি সব ধরনের জিনিশ আছে; কিন্তু রাশেদের। দেশিবিদেশি, কেরু বা স্কচ, কিছুই লাগবে না; বালিকা প্রথমে বুঝতে পারে নি, বুঝতে পেরে খুব মজা পায়; লোকটিকে বলে, নিয়ে আসুন না, খেয়ে দেখি কেমন লাগে। লোকটি উৎসাহিত হয়, জামার ভেতর থেকে একটা বোতল বের করে বালিকার দিকে বাড়িয়ে দেয়, বালিকা না, না করে ওঠে; লোকটি উত্তর হিশেবে না শুনতে রাজি নয়, বলে যে আফারা আজকাল জঙ্গলে এসেই জিনিশ খেতে পছন্দ করেন। এক আফা তো বোরখা পরেই আসেন, আধা বোতল তাঁর একারই লাগে। বাঙালি মুসলমান বেশ হুইস্কি খাচ্ছে, জঙ্গলে এসেও খাচ্ছে, বা খাওয়ার জন্যেই জঙ্গলে আসছে, বেশ বিকাশ ঘটছে তাদের;–লোকটিকে এড়ানো যাচ্ছে না, চলে যাচ্ছে, আবার ঘুরে আসছে; সে কি ভাবছে রাশেদ সাড়া দেবেই অবশেষে, একটি বালিকাকে নিয়ে জঙ্গলে বসে মাতাল হওয়ার সুখ সে হারাবে না? রাশেদ গাছের দিকে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছে না, বালিকা পাতার সবুজের দিকে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছে না, মনে হচ্ছে তারা মেথরপট্টিতে এসে পড়েছে।