কতো দূরে যেতে হবে, কতো দূরে গেলে বেঁচে উঠবে রাশেদ, বালিকা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? রাশেদের ফিরে যেতে ইচ্ছে করে বাল্যকালে, এ-বালিকা, যার মাংস থেকে গোলাপের গন্ধ বেরোচ্ছে, সে কি রাশেদকে বাল্যকালে, খেজুরডালের নিচে কুমড়োপাতার পাশে, নিয়ে যেতে পারবে? বালিকার পাশে হাঁটতে গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেনা ভবনটিকেই তার অচেনা মনে হচ্ছে, যেনো এই প্রথম এখানে ঢুকেছে, তিনটি নদী পেরিয়ে বহু মেঠো পথ হেঁটে এখানে এসেছে, দেয়ালের কুৎসিত ভুল বানানের লেখাগুলোকেও মনোরম লাগছে। বাইরে এসে দাঁড়াতেই একটা ঝলমলে আলো এসে পড়লো তার মুখের ওপর, মনেই হচ্ছে না এখানে কিছুক্ষণ আগে লড়াই হয়ে গেছে, তিনজন নতুন শহিদ জন্ম নিয়েছে; দূরে আমগাছের নিচে বসে আছে। একজোড়া বালকবালিকা, দুজনই খুব ক্লান্ত, বড়ো বেশি ক্লান্ত, তাদের হৃদয় আর শরীর কোনোটিই আর প্রেমে রাজি নয়, বা তারা কখনোই প্রেম অনুভব করে নি তবু দিনের। পর দিন বসে আছে আমগাছের নিচে, দুজনই নিজেদের পরিত্যাগ করে তাকিয়ে আছে রাশেদ ও বালিকার দিকে। ওই বালকবালিকা দুটি এখন আর তারা নয়, তারা হয়ে। উঠেছে রাশেদ ও এই বালিকা; রাশেদ কি তাদের ডেকে বলবে এখানে নয়, এ-জীর্ণ আমগাছের নিচে কিছু পাবে না, অনেক দূরে যাও? রাস্তায় আসতেই অনেকগুলো রিকশা ভিড় করে এলো, দুটি বালক যারা রাশেদকে দেখলে মহাপুরুষের মতো সাধারণত চলে যেতো, আজ তারা সালাম দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, গুরুত্বপূর্ণ জরুরি কিছু আলোচনার আছে তাদের; দাঁত-উঁচু ছেলেটাকে বেশ লাগলো রাশেদের, এইমাত্র গাঁজা টেনে সুন্দর হয়ে এলো হয়তো। অধ্যাপক সালামত আলিও এদিকেই আসছেন, নিশ্চয়ই কোনো নতুন তত্ত্ব তাঁর মাথায় ঘুরছে, তিনি হয়তো প্রাথমিক বিদ্যালয়টি কয়েক বছরের জন্যে বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছেন, রাশেদকে তা শুনতে হবে। তিনি রাশেদের সামনে এসে কোনো তত্ত্বই আলোচনা করলেন না, শুধু বললেন, বাহ্, মেয়েটি তো সুন্দর, তবে একে তো আপনার মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না। রাশেদ ব্ৰিত বোধ.করছে তিনি বুঝতে পারছেন, তবে তার দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে। রাশেদ কি এ-লোকটিকেও সাথে নিয়ে নেবে, তার তো অনেক আগেই অনেক দূরে। যাওয়া উচিত ছিলো, এখন গেলে কি কোনো উপকার হবে? এখন যদি মমতাজ এসে উপস্থিত হয়? রাশেদ তাকে কী বলবে? মমতাজ এসে যদি দেখে সে বালিকার পাশে রিকশার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাঅলারা তাদের ঘিরে ধরেছে, মমতাজ কি বলবে, বাহ্, সুন্দর মেয়ে তো, যাও একটু বেড়িয়ে এসোর বালিকা রিকশায় উঠে বসেছে, রাশেদ কী করে ওই রিকশায় উঠবে? রাশেদের মনে হচ্ছে রিকশাটি মেঘের সমান উঁচু, সে অতত উঁচুতে উঠতে পারবে না; এক সময় সে মেঘকে জুতোর মতো পরে আকাশ। জুড়ে হাঁটতে পারতো, এখন আর তার পা অত উঁচুতে উঠতে অভ্যস্ত নয়। বালিকা বা হাত বাড়িয়ে দিলে রাশেদ একটি আশ্রয় পায়, হাত ধরে সে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে। থাকে, মেঘের ওপর উঠে বসে।
রিকশাঅলা ব্যস্ত হয়ে পড়ে হুড তুলতে; মনে হচ্ছে সে অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ, নাম-না-জানা কোনো শরিয়াবিশেষজ্ঞও হতে পারে, আজকাল পথে পথে শরিয়াবিশেষজ্ঞরা ছড়ানো, বা সে জানে রাশেদ আর বালিকার মতো যারা রিকশায় ওঠে, তারা ওঠে হুডের ভেতরের ঘন ছায়াটুকুর জন্যেই, বাইরের আলোর জন্যে ওঠে না, চারপাশে ছায়ার আকাল আজকাল। রাশেদ কি লুকিয়ে দূরে যাবে? সে কি অপরাধ করে চলছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, জেনার মতো পাপ করছে, তাকে ধরে কি পাথর ছুঁড়ে মারা হবে, সাথে এ-বালিকাটিকেও? সে কি ব্যাংকক সিঙ্গাপুর যাচ্ছে বালিকাটিকে নিয়ে, সে যদি তিরিশ কোটি ঋণকরা শিল্পপতি হতো, তাহলে কি আজ সে থাই বিমানের এক জোড়া। টিকেট কিনতো? বালিকাটি বাসায় বলে আসতো দিল্লি যাচ্ছে, একটি বৃত্তি পেয়েছে এক সপ্তাহের জন্যে, আর রাশেদ গম্ভীরভাবে রটিয়ে দিতো দশ মিলিয়ন ডলারের একটা কাজে টোকিয়ো যাচ্ছে। রাশেদের এক বন্ধু তো মাঝেমাঝেই এমন ব্যবসায়ে দিল্লি ব্যাংকক যাচ্ছে, তার স্ত্রীটিই গর্বের সাথে সংবাদটা পোঁছে দেয় মমতাজকে; ফেরার সময় এতো শাড়ি আর লিপস্টিক নিয়ে আসে যে স্ত্রীটি পাগল হয়ে যায়, স্বামীর যন্ত্রপাতির খবর নেয়ার কথা মনে থাকে না। অবশ্য স্ত্রীকে নিয়ে বছরে একবার সে হজে যায়, দুজনেই নতুন নতুন মাথার পাগড়ি কিনে ফেরে, স্ত্রীটি নামাজ পড়তে পড়তে আর স্বামীর হায়াতের জন্যে দোয়া করতে করতে দুনিয়ার কথা ভুলে যায়। সে কি তেমন। কিছু করছে? রিকশাঅলাকে সে হুড তুলতে নিষেধ করে, সে দূরে যেতে চায় আলোর। ভেতর দিয়েই, গাছের জলের শিশিরের ঘাসের দিগন্তের কাছে যাওয়ার সময় সে নিজের কাছে কোনো পাপ করবে না। তবে সামন পেছন থেকে যে-গাড়ি, ট্রাক, রিকশাগুলো আসছে, আর পথ দিয়ে যারা হাঁটছে, তারা যদি ঘিরে ধরে তাদের? রাশেদ যার মুখের দিকেই তাকাচ্ছে তাকেই মনে হচ্ছে খুব ক্রুদ্ধ, তারা যেনো রাশেদ ও বালিকার সম্পূর্ণ বিবরণ চাইছে, বিস্তৃতভাবে জানতে চাইছে তাদের সম্পর্ক। রাশেদের মনে হয় সবাই। রাশেদ ও বালিকার দিকে তাকিয়ে আছে, এখনই তারা রিকশা থামিয়ে জানতে চাইবে, তারা কোথায় যাচ্ছে? বালিকার সাথে সে রিকশায় উঠেছে কেনো? বালিকার শাড়ির। মসৃণতা সে টের পাচ্ছে, তার শাড়িতে লেগে বাতাসও মসৃণ হয়ে উঠেছে, বালিকার ডান বাহুটি নিশ্চয়ই রাশেদকে ঘেষে পড়ে আছে, রাশেদের মনে হচ্ছে তার বা বাহুটি কয়েক জন্ম ধরে স্থাপিত হয়ে আছে কোনো কোমল বস্তুর ওপর। বালিকা কথা বলছে, শুধু দূরের কথা বলছে, মনে হচ্ছে সে কখনো কাছাকাছি কোথাও যায় নি, কয়েক জন্ম আগে থেকে সে শুধু দূরেই যাচ্ছে। কিন্তু রিকশার শেকল পড়তে শুরু করেছে অনবরত, রিকশাঅলা সম্ভবত শেকল পড়ার ব্যবস্থা করেই বেরিয়েছে, সে নেমে শেকল লাগাচ্ছে, উঠতে না উঠতেই আবার পড়ছে; দূরে যাওয়া সহজ নয়। রিকশাঅলা আর যেতে পারবে না। দু-মাইলও আসা হয় নি, অনেক দূরে যেতে হবে, রাশেদ রিকশাঅলাকে দশটি টাকা দেয়। রিকশাঅলা তা নেবে না, তাকে পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে, রাশেদ আর বালিকা খুব অবাক হয়। রিকশাঅলার মুখটা বদলে গেছে, শুয়োরের মুখ এসে সেঁটে বসেছে তার মুখে, ঘোৎ ঘোঁৎ করে সে বলে, মাইয়ালোক লইয়া বেড়াইতে বাইর অইছেন, পঞ্চাশ ট্যাকা দেন, নাইলে অপমান অইয়া যাইবেন। লোকটিকে তো এমন বদমাশ মনে হয় নি, সে তো বালিকাকে আফা আফা করছিলো ওঠার সময়; তবে কি সে রাশেদ ও বালিকার সম্পর্ক এরই মাঝে ভালোভাবে পড়ে উঠেছে, বুঝতে পেরেছে তারা কোনো পরিস্থিতিতে পড়তে চায় না? রাশেদ বালিকার দিকে তাকায়, বালিকা শুধু বলে, অসভ্যে দেশ ভরে গেছে। সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে একটি নোট বের করে রিকশাঅলাটিকে কাছে ডেকে বলে, আপনার মতো ইতর আমি দেখি নি, এবং নোটটি তার মুখে ছুঁড়ে দেয়।