রাশেদ তখন দরোজায় শুনতে পেলো তার পায়ের শব্দ। বাদ্যযন্ত্রের মধুর ধ্বনির থেকে মধুর সে-স্যান্ডলের শব্দ, যে-শব্দে পাহাড় ভেঙে পড়ে দেয়াল ভেঙে পড়ে, মূখের নির্বোধ উচ্ছাস বলে মনে হয় সমাজ সভ্যতা গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র সামরিক শাসনকে। ভেঙে পড়া দেয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে সে রাশেদের ঘরে ঢুকলো; নতুন আমপাতার কম্পন অনুভব করলো রাশেদ, ওই কম্পনে তার ময়লাধরা আত্মা আর শরীর থেকে অনেকখানি ধুলো ঝরে পড়লো। রাশেদ তার নাম জানে না, অনেক আগে সে রাশেদের ঘরে ঢুকেছিলো, রাশেদ তার নাম দিয়েছিলো গোলাপ-মেয়ে, যাকে সে আর দেখতে। পায় নি, মাঝে একবার যাকে দেখার পিপাসা জেগেছিলো রাশেদের। রাশেদ একদিন। তাকে দেখার জন্যে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো, সামনের দিক থেকে আসা প্রত্যেক রিকশায় তাকে দেখতে পাচ্ছিলো, আর মনে হচ্ছিলো রিকশাগুলো তাকে নিয়ে রাশেদকে পেরিয়ে দূর দূরান্তে চলে যাচ্ছে, যতো দূরে রাশেদ কখনো যেতে পারবে না। রিকশাঅলাকে রাশেদ মালিবাগের দিকে যেতে বলেছিলো, যদিও রাশেদ জানে না। মালিবাগ কোথায়, শুধু জানে শহরের কোথাও মালিবাগ রয়েছে, নামটি সে অনেকের মুখে শুনেছে; তারপর যেতে বলেছিলো কলাবাগানে, তল্লাবাগে, র্যাংকিন স্ট্রিটে, ইস্কাটনে, মগবাজারে, আজিমপুরে, আরমানিটোলায়, জিগাতলায়, টিকাটুলি, ইব্রাহিমপুর, কচুখেত, নাখালপাড়ায়; একবার গোলাপবাগ নামের একটি জায়গায় যেতে বলেছিলো রিকশাঅলাকে, আর রিকশাঅলা এমনভাবে হেসেছিলো যার অর্থ শহরে। এ-নামে একটা পাড়া থাকলে ভালো হতো, তবে এ-নামের কোনো পাড়া নেই। তাকে খুঁজতে বেরিয়ে রাশেদ তাকে পায় নি, যদিও শহরের প্রায় সবার সাথেই তার দেখা হয়; একটা মন্ত্রী যাবে বলে পুলিশ পাগলের মতো বাঁশি বাজিয়ে তাকে মন্ত্রী দেখিয়েছিলো, পেট-ফোলা মন্ত্রীটাকে দেখে রাশেদ আনন্দ পেয়েছিলো, তার ইচ্ছে হয়েছিলো গাড়ির পতাকাটি তুলে নিয়ে ওই কোলাব্যাংটির পেটে একটা খোঁচা দিতে; মালিবাগের মোড়ে একটা রিকশা থেকে সালাম চোকদার নামে একজন, যে নাকি তার এক পুরোনো বন্ধু, ডাকাডাকি করতে থাকে, রাশেদের রিকশার সাথে তার রিকশা লাগিয়ে রাশেদকে থামায়। রাশেদ কোথায় যাচ্ছে, কেনো যাচ্ছে, মাঝেমাঝেই এদিকে যায় কিনা, গেলে কখন যায়, সপ্তাহে ক-বার যায় সব বিষয়ে জানতে চায়; রাশেদ তার অন্তরঙ্গতায় মুগ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু রাশেদ কি তাকে বলতে পারে যে সে গোলাপ-মেয়েকে। খুঁজছে? রাশেদের ইচ্ছে হচ্ছিলো চোকদার গোয়েন্দা বিভাগে কতো দিন ধরে আছে। সে-সংবাদ জানার, কিন্তু রাশেদ কিছু না বলে হাত নেড়েছিলো। রিকশায় রিকশায় রাশেদ তাকে খুঁজেছে, প্রত্যেক রিকশায় তাকে দেখতে পেয়েছে, এবং সে রাশেদকে। পেরিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। রাশেদের অবশ্য এম খোঁজা শাস্ত্রসম্মত নয়, কোনো রকম খোঁজাখুঁজিই তার জন্যে সিদ্ধ নয়, তবু রাশেদ খুঁজতে বেরিয়েছিলো, যা কেউ। কোনোদিন জানবে না। সে আজ এসেছে, চড়ুইটির মুখ আবার মনে পড়ে রাশেদের; রাশেদ তাকে বসতে বলে, সে দেয়াল-ঘেঁষে একটি চেয়ারে বসে, রাশেদ আবার পুরোনো গোলাপের গন্ধ পেতে থাকে।
রাশেদকে সে তার নামটি বলে; নামটির গায়েই অনির্বচনীয় সুগন্ধ আছে বলে মনে হয় রাশেদের। রাশেদ গোলাপের গন্ধ পাচ্ছে, অভাবিত গন্ধ, তার ঘরে এমন অভাবিতভাবে কেউ আসে নি, রাশেদের জীবনে অভাবিত বলে কিছু নেই, যেমন আর কারো জীবনেই কোনো অভাবিত শিহরণ নেই। রাশেদ কেনো গোলাপের গন্ধ পাচ্ছে? সে কেনো এসেছে। রাশেদের ঘরে তার মতো বালিকারা নিয়মিতই ঢোকে, যারা কোনো বিস্ময় নিয়ে আসে না, সব বিস্ময় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আসে, এমনভাবে আসে যেনো শুকনো কাঠ দিয়ে তৈরি, আর একে মনে হচ্ছে সবুজ উদ্ভিদ, ডাল মেলছে, ডালে ফুল ফুটে আছে। রাশেদ শিউরে ওঠে, এবং বিব্রত বোধ করে। শিউরে উঠে সে অস্বস্তি বোধ করছিলো, বিব্রত বোধ করে সে স্বস্তি পায়। বাইরে গুলির শব্দ শোনা গেলো, মাঠে প্রস্তুতি চলছে গণতন্ত্রের, থেকে থেকে টাশ টাশ শব্দ হচ্ছে, বোমা ফাটছে, মনে হচ্ছে বারান্দায়ই; দৌড়োচ্ছে সবাই, রাশেদ শুকনো বোধ করতে শুরু করছে, কিন্তু বালিকা গোলাপের মতোই ফুটে আছে। রাশেদ বিস্মিত হয়। বালিকা বলে, আপনাকে আমি এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাই। গুলি আর বোমার শব্দের রাশেদ ভয়। পায় নি, কিন্তু বালিকার প্রস্তাব রাশেদকে ভীত করে তোলে;-বালিকা কি জানে না তার বের হওয়ার অধিকার নেই, দেয়ালের ভেতরে থাকাই তার ও সকলের জন্যে স্বস্তিকর, বাইরে যাওয়া বিপজ্জনক? সে বাইরে গেলে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙে পড়তে পারে, সমাজ ধসে পড়তে পারে। বালিকা আবার বলে, চলুন আমার সাথে, অনেক দূরে নিয়ে যাবো আপনাকে। বালিকা এমনভাবে কথা বলছে, রাশেদের মনে হচ্ছে সে একটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ওই হাত নিয়তির মতো কাজ করছে, রাশেদ তা ফিরিয়ে দিতে পারছে না। রাশেদ তার সাথে ঘর থেকে বেরোয়, তার মনে হতে থাকে সে হাঁটতে ভুলে গেছে, বা কখনো হাঁটে নি, দরোজায় তালা লাগাতে গিয়ে তার ভুল হয়, আবার ভেতরে ঢুকে দেশলাই বাক্স খোঁজে, শেষে পকেটেই খুঁজে পায়। বালিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রাশেদ বুঝতে পারে বালিকা খুব উপভোগ করছে তার অবস্থা। বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় রাশেদ অনুভব করে সব কিছু কাঁপছে, দালানটি আর ছাদগুলো ধরে রাখতে পারছে না, মাথার ওপর ভেঙে পড়ছে। বাইরে তখন প্রচণ্ড কোলাহল, কজন মারা গেছে রাশেদ জানে না; দূরের বারান্দা দিয়ে দৌড়ে আসছেন ডক্টর আহমেদ, ৬৪, চিৎকার করে বলছেন তিনজন মারা গেছে, ভয় পেয়ে তিনি নিজের ঘরের দিকে দৌড়োচ্ছেন, কিন্তু রাশেদ আর বালিকার কাছে এসে তিনি হঠাৎ দাঁড়ান। বালিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ, যেনো শেষ মুহূর্তের আগে তিনি শান্তিদায়ক কিছু দেখছেন, তার প্রাণ ভরে উঠছে, এখন তিনি গোলাগুলির ভেতর দিয়ে শান্তভাবে চলতে পারবেন। বালিকা ডক্টর আহমেদের মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে, যেনো সে কোনো ডালে ফুটে আছে, এবং ডক্টর আহমেদের হাত ধরে বলে, আপনার ঘরে চলুন। শিশুর মতো তার সাথে হাঁটতে থাকেন ডক্টর আহমেদ, নিজের ঘরের সামনে এসে বালিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, বলেন, আর ভয় পাবো না।