মমতাজ এখন মৃদুকে পাশে নিয়ে নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে, সে কি ওই স্বপ্নটা আবার দেখছে, আবার কি মমতাজ ওই স্বপ্নটা দেখতে চায়? মমতাজের এক অদ্ভুত অভ্যাস মহাযুদ্ধের মতো প্রসঙ্গগুলো সে তোলে যখন রাশেদ আর কোনো প্রসঙ্গ মনে রাখতে পারে না, সে-রাতেও তুলেছিলো, গলে ভেঙে ভেসে যেতে যেতে মমতাজ বলছিলো কয়েক রাত আগে সে একটা স্বপ্ন দেখেছে, যার কথা সে কাউকে বলবে না, কিন্তু একটু পরই মমতাজ বলে সে স্বপ্ন দেখেছে রাশেদের এক বন্ধুর সাথে ঘুমোচ্ছ সে, কিন্তু সে বন্ধুটির নাম বলবে না, তাতে রাশেদ বন্ধুটিকে হয়তো আর দেখতে পারবে না, হয়তো সে বাসায় এলে দরোজা খুলবে না। কিন্তু মমতাজ একটু পরে, রাশেদ জানতে চাইলে, বন্ধুটির নামও বলে; গলে যেতে যেতে রাশেদ জানতে চেয়েছিলো স্বপ্নে কী দেখেছে। মমতাজ, ভেঙে পড়তে পড়তে মমতাজ বলে সবই দেখেছে সে, কিছুই বাকি ছিলো না। তার কেমন লেগেছে রাশেদ জানতে চেয়েছিলো, মমতাজ শুধু বলেছিলো, ভালো। রাশেদ মমতাজের কাছে জানতে চেয়েছিলো বাস্তবেও ওই বন্ধুটির সাথে সে ঘুমোতে চায় কিনা; মমতাজ দ্বিধায় পড়ে, অনেকক্ষণ কোনো কথা বলে নি, শেষে বলে আমি ঠিক জানি না চাই কি চাই না। আসলে মমতাজ কি চায়? রাশেদ বুকে একটা কাঁটা। খোঁজ করে, কিন্তু কোনো কাঁটা খচ করে ওঠে না; রাশেদও কি অমন অনেক স্বপ্ন দেখে নি? রাশেদ নিজে কি স্বপ্নে ও দিবাস্বপ্নে অজস্র নারীর সাথে সময় যাপন করে নি? তালিকাটি কি খুব দীর্ঘ হবে না, ওই তালিকার সব নাম কি সে কখনো প্রকাশ করতে পারবে? কয়েক মাস ধরে একটি পরহেজগার মহিলা কি তাকে স্বপ্নে কল্পনায় সুখ দিচ্ছে না? পরহেজগার মহিলাটির সাথে তার দেখা হয়েছিলো বেইলি রোডে এক। বিবাহ-অনুষ্ঠানে, তার বোরখার ভেতরে তাল তাল সোনা লোকোনো আছে বলে মনে হচ্ছিলো রাশেদের, এবং আশ্চর্য, তারপর থেকে সে কি রাশেদের স্বপ্নে দেখা দিচ্ছে না? মমতাজ আর কী কী স্বপ্ন দেখে? রাশেদ জানতে চেয়েছিলো মমতাজ আর কারো সাথে ঘুমোতে চায় কিনা, অন্য কারো সাথে ঘুমোতে তার কেমন লাগবে; অন্ধকারে রাশেদ মমতাজের মুখ দেখতে পায় নি, মমতাজ বলেছিলো, তুমি তো তা পছন্দ করবে না। অর্থাৎ মমতাজ চায়, আর মমতাজের বিশ্বাস রাশেদ তা পছন্দ করবে না। সত্যিই কি রাশেদ তা পছন্দ করবে না? ওই পরহেজগার মহিলাটি কি স্বপ্নে ঘুমোয় না কারো সাথে, বাস্তবে কি তার সাধ হয় না অন্য কারো সাথে ঘুমোতে?
অনেক দূর যেতে হবে রাশেদকে। মুজিব ফিরছে, দেখতে পাচ্ছে রাশেদ, অনেক দিন পর তার মুখের ওপর রোদ পড়েছে বলে মনে হচ্ছে; ট্রাকে মালা, আর যারা একদিন তাকে ডোবাবে, তাদের চাপে দম ফেলতে পারছে না মুজিব, সে খুব উপভোগ করছে, উল্লসিত পতঙ্গের মতো বাঙালির ভিড় চারপাশে, পতঙ্গপুঞ্জের মধ্যে শুধু সে-ই মানুষের মতো দেবতার মতো আচরণ করছে, রাশেদ দেখছিলো এক অপরিচিত প্রবেশ করছে। দেশে, মুজিবের চোখে দেশটাকে অচেনা লাগছে, দেশটার অচেনা লাগছে মুজিবকে। সে বুঝতে পারছে না সে কোথায় ফিরে এসেছে। যোলোই ডিসেম্বর থেকে দশই জানুয়ারির ওই দিনটা অনেক দূরের, অনেক আবেগ বদলে গেছে এর মাঝে, বাঙালি ভাগ হয়ে গেছে হাজি আর রাজাকারে। ভারত-ফেরত হাজিদের ভঙ্গি দেখার মতো, রাশেদ এখানে সেখানে দেখা পাচ্ছিলো হাজিদের, উপভোগ করছিলো তাদের মহত্ত্ব। যে ভারতে যায় নি, সে-ই রাজাকার, এমন ভাব করছে হাজিরা, যে ভারতে গেছে হাজি হয়ে ফিরেছে সে, তার অনেক পুণ্য জমেছে, পুণ্যের অনেক ফল তাকে পেতে হবে, পেতে শুরুও করেছে। কয়েক দিন আগে রাশেদের দেখা হয়েছিলো এক মহাহাজির সাথে, যে দেশে থাকলে আলবদরদের নেতা হতে পারতো, হতোই, যে এখন একটা বড়ো পদ খুঁজছে, সেও রাশেদকে বলেছিলো, তোমরা তো রাজাকার, দেশে ছিলে নিশ্চয়ই রাজাকারি করেছে। রাশেদ কষ্ট পায় নি, বেঁচে থাকার জন্যে তো অপমান সহ্য করতেই হবে। রাশেদ তখন দিকে দিকে দেখতে পাচ্ছিলো তার জ্বলজ্বলে পরিচিতদের, তারা ভারত থেকে ফিরেছে, রাশেদকে চিনতে পারছে না; একেকজন গাড়ি থেকে নামছে গাড়িতে উঠছে, ভারতে যাওয়ার আগে ছিলো সামান্য ফিরে এসেছে অসামান্য হয়ে। স্বাধীন। দেশটা হয়ে উঠেছে সাড়ে সাতকোটি রাজাকারের দেশ, সবাই পাপী, শুধু পুণ্যবান তারা। যারা ফিরে এসেছে ভারত থেকে পুণ্য অর্জন করে। শেখ মুজিব ফিরছে, সে ফেরার পর আর কোনো সমস্যা থাকবে না, সে যাদু জানে, তার যাদুতে সব সোনা হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই সোনা হচ্ছে না, বরং মুজিবের মুখে দাগ লাগছে, সে আরো অচেনা হয়ে উঠছে। আমি, আমি, আমি, মুজিবকে মনে পড়লেই মনে পড়ে আমি, আমি, আমি। মুজিবকে জাতির পিতা হতে হবে, তাকে জাতির পিতা করে তুলতে হবে; কায়েদে আজমের পর বাঙালিকে পেতে হবে জাতির পিতা। একটি চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, দূরে সরে যাচ্ছে, নিজে বুঝতে পারছে না, দূরে সরে গিয়ে সুখ পাচ্ছে। বীরেরা খুন। হওয়ার আগে ধারাবাহিকভাবে আত্মহত্যা করতে থাকে, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না, মুজিবও আত্মহত্যা করে চলছে, আত্মহত্যা করে চলছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না। রাশেদকে অনেক দূর যেতে হবে। মুজিব কি মুহূর্তের জন্যেও ভাবতে পারতো সে আছে, কিন্তু ক্ষমতায় নেই? সে ও ক্ষমতা একই অর্থবোধক হয়ে উঠেছিলো তার কাছে, সে-ই বাঙলাদেশ এমন মনে হয়েছিলো তার। সে কি একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত করছিলো না? সে-রাজবংশের ক্রিয়াকলাপের ফল কি পেতে শুরু করে নি বাঙালি? রেডিওতে জিয়ার ঘোষণাটি রাশেদ শুনেছিলো ঢাকা থেকে পালানোর সময়, হাতের ছোটো রেডিওটি শিউরে উঠেছিলো ওই ঘোষণায়, সে তার ঘোষণাকে ব্যর্থ হতে দেয় নি, ঘোষণার। পুরস্কার কড়ায় গণ্ডায় নিশেব করে নিয়েছে। আরেক অপরিচিত সে, অত্যন্ত অপরিচিত, ওই ঘোষণার মুহূর্তে ছিলো অচেনা, খুন হওয়ার সময়ও রয়ে গেলো অচেনা। মেজর, মেজর, মেজর, মেজরের ওপরে সে কখনো উঠতে পারে নি, যদিও সব কিছু হয়েছে সে। সে কি আর মুক্তিযোদ্ধা ছিলো? সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এখন আরেক অচেনা ভর করেছে। এই মাঝরাতে রাশেদকে অনেক দূরে যেতে হবে, সে জানে না কত দূর যেতে হবে।