সেই পরিচিত ভাঁড়টিই ক্ষমতা দখল করেছে, এখন সে দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তার সঙ্গে আরো দুটি ছোটো ভাঁড়ও রয়েছে। সে এখন বাঙলার সম্রাট সুলতান শাহানশাহ, তার ক্ষমতার শেষ নেই; সে সংবিধান স্থগিত করেছে, বাতিল করেছে সংসদ ও সরকার, এবং পুরোনো প্রেসিডেন্টটিকে না মেরে আলুর বস্তার মতো বাড়িতে ফেলে দিয়ে এসেছে। ওই বুড়োটা হয়তো এরই মধ্যে ক্ষমতা হারানোর শোকে মারা গেছে। মরুক সেটা, রাশেদের কিছু যায় আসে না, দেশের কারোই কিছু যায়। আসে না, অনেক আগে মরলেই ভালো হতো; তবে সেটাকে এখনো যদি ডেকে এনে ওরা আধটুকরো গোশত দেয়, তাহলে সে ওদের ‘স্যার, স্যার’ করবে; কিন্তু ভাঁড়টা এখন ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের আল্লাতাল্লা। রাশেদ ঘোষণা শুনতে পেলো : আমি যে কোনো ব্যক্তিকে দেশের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করতে পারি, যিনি বাঙলাদেশের প্রধান। বিচারপতি অথবা আমার মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের যে কোনো বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ করে দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। আমি সময়ে সময়ে এমন মনোনয়ন বাতিল বা। রদ করতে পারি এবং আরেক ব্যক্তিকে বাঙলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করতে পারি। আমার মনোনীত প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান হবেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকরূপে। আমার উপদেশ অনুসারে কাজ করবেন এবং আমি তাকে যে-সব দায়িত্ব দেবো, তা পালন করবেন। রাশেদ একটা চাকর নিয়োগের ঘোষণা শুনলো, সে জানে বাঙলায়। এখন ওই চাকরের পদটির জন্যে অনেকের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে; কোনো একটা বিচারপতিকে হয়তো সে এর মাঝেই নিজের চাকর হিশেবে পেয়ে গেছে। দু-এক দিনের মধ্যেই দেখা যাবে একটি ঝুঁটিপরা বিচারপতি আরেকটিকে শপথ করাচ্ছে। চাকরের পদে। শপথটি হবে আমি ভড়ের চাকর হিশেবে শপথ করছি যে মহাভাঁড় আমাকে যে-আদেশ দেবেন, তাই আমি পালন করবো; যদি তার বুট চাটতে বলেন, আমি আনন্দের সাথে চাটবো; যদি তার আন্ডারওঅ্যার ধুতে বলেন, আমি ধুয়ে দেবো; যদি পা মর্দন করতে বলেন, তাহলে তার পবিত্র পদযুগল মর্দন করে ধন্য হবো; যদি ট্রাউজার খুলে…
দেশটিকে এখন ভাগাভাগি করা হচ্ছে, কুমড়োর ফালির মতো চাক চাক করা হচ্ছে, রাশেদ তার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। রাশেদ শুনতে পেলো বড়ো ভাঁড়টির নিচে নিয়োগ করা হয়ে গেছে দুটি উপপ্রধান ভাঁড়, সে-দুটির বুকফোলানো ছবিও দেখানো হলো, তারা এমনভাবে বুক ফোলানোর চেষ্টা করলো যে টেলিভিশনের পর্দাটি একবার কেঁপে উঠলো, চড়চড় আওয়াজ হলো। একটি ঘোষক ব্যাঙের ফুর্তিতে গলা ফুলিয়ে ঘোষণা করলো সারা দেশকে পাঁচটি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে; ক অঞ্চলে জেনারেল করমালি, খ অঞ্চলে জেনারেল খরমালি, গ অঞ্চলে জেনারেল গরমালি ইত্যাদি শুনতে পাচ্ছে রাশেদ। জেনারেল জেনারেল জেনারেল, জেনারেল জেনারেল জেনারেল, জেনারেল জেনারেল জেনারেল, জেনারেল জেনারেল জেনারেল, লেফটেনেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল, লেফটেনেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল, লেফটেনেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল, শুনতে শুনতে তার খুব অদ্ভুত অনুভূতি হলো। তার তলপেটে একটি নিম্নমুখি চাপ আর বুকের দিকে একটি ঊর্ধ্বমুখি বমির চাপ তাকে একসাথে আক্রমণ করলো, দুটি বিপরীতমুখি চাপে তার এমন অনুভূতি হলো, যার সে নাম দিলো জেনারেলস্রাব। অভিনন্দন বাঙলাদেশ, রাশেদ বললো, জেনারেলজননী, জেনারেলগর্ভা বঙ্গ, অভিনন্দন। তোমার রূপের সত্যিই সীমা নেই, তোমার এতোটুকু জরায়ুতে এতো জায়গা, মাতা? রাশেদ একটি দৃশ্য দেখতে পেলো, মাতা বাঙলাদেশ রাস্তার পারে কাতরাচ্ছে। প্রসববেদনায়, আর তার জননাঙ্গ ট্যাংক দিয়ে ঠেলে ছিঁড়েফেঁড়ে বেরোচ্ছে একের পর এক সানগ্লাসপরা জেনারেল, আর জেনারেল, আর জেনারেল।
টেলিভিশন থেকে গলগল করে পড়ছে গণতন্ত্র, ঝরঝর করে ঝরছে শান্তিশৃঙখলা, তরতর করে চড়ছে অর্থনীতি;–পড়ার, ঝরার, চড়ার নানা রকম শব্দে তার অস্তিত্ব। পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে লাগলো। দেশ জুড়ে এখন সান্ধ্য আইন; বারো কোটি বাঙালির। মতো রাশেদ বন্দী হয়ে আছে স্কুপ স্থূপ মিথ্যার মধ্যে, টেলিভিশনের নোংরা যন্ত্রটি কোনো কুৎসিত প্রাণীর মলত্যাগের মতো মিথ্যাত্যাগ করে ঢেকে ফেলছে তাকে, সারা দেশ মিথ্যার মলে ঢেকে যাচ্ছে। চারপাশে এখন আর কোনো সত্য নেই, দেশে কোনো সত্য আর উচ্চারিত হবে না, মিথ্যাই আধিপত্য করবে সত্যের মুখোশ পরে। রাশেদের ছেলেবেলায় প্রথম পুরব বাঙলার শ্যামলিমায় পঞ্চনদীর তীরে অরুণিমায় দেখা দিয়েছিলো এমন মিথ্যা, আবির্ভূত হয়েছিলো খানের পর খান, পাকিস্থান হয়ে উঠেছিলো খানস্থান; খানের পর খান ভাগ করে নিয়েছিলো জন্মদ্বিখণ্ডিত অদ্ভুত দেশটিকে। আইউব, আজম, ওমরাও প্রভৃতি রোমহর্ষক খানে ভ’রে গিয়েছিলো পাকিস্থান। পূরব বাঙলায় অর্থাৎ রাশেদের ছেলেবেলার জগতের দিকে দিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিলো; তারা কেউ তখনো মিলিটারি দেখে নি, বাজারের উত্তর কোণে পান বেচতো যে-লোকটি, পুবপাড়ার যে-বারেক গ্রাম ছেড়ে কখনো শহরে যায় নি, পাকিস্থান বলতে যে বুঝতো তার গরুগুলোকেই, বা তার গরুগুলোর গোবর যার কাছে অনেক বেশি সত্য আর পবিত্র ছিলো পাকিস্থানের থেকে, তাদের ভূগোলের স্যার বা ইস্কুলের ঘণ্টা বাজাতো। যে-দপ্তরি, তারা কেউ মিলিটারি বা আইউব খানকে দেখে নি, কিন্তু তাদের মনে যে সাড়া পড়ে গিয়েছিলো, রাশেদ তা বুঝতে পেরেছিলো। তাদের চাকরটিও খুশি হয়ে। বলেছিলো, দাদা, আইউব খার চ্যাহারা দেহার মতন। এক মাঝির খুশির চিৎকার আজো তার কানে বাজে : দ্যাশে মার্শাল ল আইন আইছে। মেষপাল যখন দূরে নেকড়ের গলার আওয়াজ শুনতে পায়, তখন এমনই খুশি হয়।