এ-মাঝরাতে এক সামান্য বাঙালি/বাঙলাদেশি/বাঙলাস্থানি/ মুসলমান আমি হাঁটছি হাঁটতে পারছি না পা কোন দিকে পড়বে আমার পা বুঝে উঠতে পারছে না আমার কোনো গন্তব্য নেই কোনো বাঙালি/বাঙলাদেশি/বাঙলাস্থানি/মুসলমানের কোনো গন্তব্য নেই দশকে দশকে উল্টেপাল্টে যাচ্ছে গন্তব্য বাবা আপনিও এমন কোনো মাঝরাতে হেঁটেছেন হাঁটতে পারেন নি বুঝতে পারেন নি কোন দিকে যাচ্ছেন আপনাকে নিয়ে। একটা বড় গোলমাল রয়ে গেছে গোলমালটি রয়ে গেছে আমার রক্তে বাঙালি/ বাঙলাদেশি/বাঙলাস্থানি/মুসলমানের রক্তে আপনাকে ডাকতে পারি নি নিজের ভাষায় ডেকেছি ডাকছি তাদের ভাষায় যারা পরাজিত করেছিলো আপনার আমার পূর্বপুরুষকে জনক আপনাকে ডাকছি তুর্কি ভাষায় আমার কি জন্মের ঠিক আছে জনক আমার কন্যা যার মগজে দুঃস্বপ্ন ঢুকে গেছে বুট ঢুকে গেছে ট্রাক ঢুকে গেছে আমার পুত্র যে এখনো। জন্মে নি যে মগজে দুঃস্বপ্ন নিয়ে ট্রাক নিয়ে বুট নিয়ে জন্ম নেবে মাঝরাতে দুপুরবেলায়। হাঁটবে বুঝতে পারবে না কোথায় যাচ্ছে আপনার পিতার দেশ ছিলো না আপনার পিতা উদ্বাস্তু ছিলেন তিনি একটা দেশ চেয়েছিলেন কিনা জানি না আপনি দেশ চেয়েছিলেন একটা দেশ আপনার দরকার হয়েছিলো পাকিস্থান নাম দিয়েছিলেন দেশটার আপনি যে-পাকিস্থান চেয়েছিলেন আপনার নেতারা সে-পাকিস্থান চায় নি আপনি বছরের পর বছর দেখেছেন আপনার পাকিস্থান আর নেতাদের পাকিস্থানের মধ্যে মিল ছিলো না। নেতারা একটা দেশ চায় নেতা হওয়ার জন্যে কায়েদে আজম জাতির পিতা হওয়ার জন্যে আপনার আমার মতো মানুষ দেশ চায় বেঁচে থাকার জন্যে ধানের পাটের। কুমড়োর স্বাদের জন্যে নারীকে ভালোবাসার জন্যে এই দুই চাওয়ার মধ্যে মিল নেই আমি একটি দেশ চেয়েছিলাম আমার একটি দেশ দরকার হয়েছিলো তার নাম দিয়েছিলাম বাঙলাদেশ আমার নেতাদের বাঙলাদেশ আর আমার বাঙলাদেশ এক নয় আপনি বিশ্বাস করেছিলেন আপনার নেতাদের আমি বিশ্বাস করেছি আমার নেতাদের আপনার নেতারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আপনার সাথে আমার নেতারা। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমার সাথে আমার পুত্রকন্যার নেতারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমার পুত্রকন্যার সাথে দেশটা মানুষের নয় যারা দখল করে তাদের এই এখন মাঝরাতে দেশটাকে আমি আমার বলে ভাবতে পারছি না দেশটা পাঁচতারাদের চারতারাদের বুটদের তাদের দাসদের চাকরদের দেশটা আমার নয় যারা রাস্তায় শুয়ে আছে তাদের নয় ভোরে উঠে যারা খেতের দিকে যাবে নদীর দিকে যাবে দেশটা তাদের নয় দেশটাকে একদিন দখল করবে রাজনীতিবিদরা তখনো দেশটা আমার হবে না হবে রাজনীতিবিদদের পাঁচতারা চারতারারা দখল করে বন্দুক দিয়ে জনগণ তাদের ব কিনে দিয়েছে বন্দুক দিয়ে তারা কী করতে পারে দেশ দখল করা ছাড়া রাজনীতিবিদদের বন্দুক নেই তাদের বন্দুক জনগণ দেশ দখল করার জন্যে তারা জনগণের ভেতর বারুদ ঢোকায় যেমন এখন তার প্রস্তুতি চলছে আমিও বারুদ হিশেবে ব্যবহৃত হচ্ছি একদিন রাজনীতিবিদরা দেশটা দখল করবে তবে তখনো দেশটা আমার হবে না জনগণের হবে না চাষীর হবে না রিকশঅলার হবে না।
অনেক দূর যেতে হবে রাশেদকে, তার তা-ই মনে হচ্ছে, যদিও সে জানে না কতো দূর। অনেক দিন এ-রাস্তায় আসে নি রাশেদ, অচেনা লাগছে সব কিছু, রাত ব’লে আরো অচেনা লাগছে, তার ভয় লাগছে না যদিও ভয়ই লাগার কথা বেশি। একটা ট্রাক এসে। তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, পিষে যেতে পারে, একটা ছুরিকা এসে বলতে পারে। আমার সাথে চলো, বা সে যাতে আর চলতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে পারে, কিন্তু তার ভয় লাগছে না। পথে লোকজন দেখা যাচ্ছে দু-একজন, তারাও কি গন্তব্য খুঁজে পাচ্ছে না, তারাও কি অনেক দূরে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছে। তারা হয়তো শহিদ মিনারে যাবে, মিমারকে ভুলতে পারে নি তারা, তাদের বুকেও অনেক ময়লা জমেছে, পরিষ্কার। করতে যাচ্ছে ময়লা? শহিদ মিনার, হৃদয় দেয়ার ঝরনাধারা, যেখানে বুকের নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে আরো অনেক বেশি ময়লা জমিয়ে এসেছে রাশেদ, ঝরনার জলের ছোঁয়া সে পায় নি। বিমানবন্দরমুখি সড়কটায় উঠে এলো রাশেদ, দূরে একটা সেতু দেখা যাচ্ছে, অনেক আগে একটা কুষ্ঠরোগীকে ওই সেতুর ওপর দেখেছিলো সে, তার মুখ মনে পড়লো; রাস্তার পুব পাশে সে-বাড়িটা চোখে পড়লো, যে-বাড়িটা হোটেল ছিলো, যার ভেতরে একটা ছোট্ট পানশালা ছিলো, ওয়েসিস যার নাম ছিলো, যেখানে সে প্রথমবার পান করতে এসেছিলো বন্ধুদের সাথে, একটা বিয়ার চারজনে ভাগ করে খেয়ে মনে করেছিলো তারা মাতাল হয়ে গেছে। ওয়েসিস নামটা সে ভোলে নি দেখে অবাক হলো, বাড়িটা দেখামাত্রই নামটি মনে পড়লো, না দেখলে মনে পড়তো না; মাহমুদার মুখটিও মনে পড়লো। আশ্চর্য, আজ রাতে তার সব স্মৃতি জেগে উঠছে, জাতিস্মর হয়ে উঠছে সে। মাহমুদাকে নিয়ে রাশেদ এপ্রিলের এক রোববার একটি নরম নির্জন স্থান খুঁজেছিলো, কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলো না, বারবার ইস্কুটার নিয়ে স্থান বদলাচ্ছিলো, যেখানেই যাচ্ছিলো সেখানটাকেই মনে হচ্ছিলো বড়ো জনাকীর্ণ, শেষে তারা এ-হোটেলটিতে এসে চা খেয়েছিলো; এক ঘণ্টা মুখোমুখি বসে থেকেও রাশেদ মাহমুদাকে কিছু বলতে পারে নি। রাশেদ চৌরাস্তায় দাঁড়াতেই শুনলো একদল শিশু খলখল করে হাসছে, এমনভাবে হাসছে যে তাদের হাসি কোনো দিন থামবে না, সব ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও তারা হাসতে থাকবে। সে কোন শিশু দেখতে পেলো না, কিন্তু তার মনে হলো শিশুরা তাকে ঘিরে ফেলেছে, তাকে ঘিরে খলখল করে হাসছে; হয়তো এখনি তারা তাকে আক্রমণ করবে। একটু পরেই রাশেদ শিশুদের তীব্র চিৎকার শুনতে পেলো। এ-শিশুদের রাশেদ কখনো দেখে নি, কিন্তু তারা তার বুকের ভেতরে। ঢুকে গেছে, এ-মধ্যরাতে তার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে খলখল হাসছে আর তীব্র আর্তনাদ করছে মৃত শিশুরা। শিশু, তোমরা ইস্কুলে যাচ্ছিলে ভোরবেলা, তোমাদের। ফ্রকে তোমাদের শার্টে এসে পড়েছিলো ভোরের আলো, ভোরের আলোর মতো তোমরা ইস্কুলে যাচ্ছিলে, তোমাদের সবাই ভুলে গেছে, পিতামাতারাও হয়তো ভুলে গেছে, আমি ভুলি নি, একটা ট্রাক এসে লাফিয়ে পড়েছিলো তোমাদের ওপর তোমাদের আলোকমালাকে অন্ধকার করে দেয়ার জন্যে, তোমরা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলে, তোমাদের আমি আজো বুকে বয়ে বেড়াই।